শারদীয়া চিরহরিত
দ্বিতীয় সংখ্যা
****************************************
শিল্পী - কাকলি শেঠ |
****************************************
সম্পাদকীয়
ঋতুর সারণি বেয়ে শরৎ ঠিক হাজির আবার দোরগোড়ায়। আকাশ বাতাস তার আগমনী উৎসবে মুখরিত। বন্যা, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সংঘাত সবকিছু পেরিয়ে মা আসছেন শারদসমারোহে। কাশ, শিউলিরাও ফুটছে। দোকানে, বাজারেও নামছে বেচাকেনার ঢল যার যেমন সাধ্য সেই অনুসারে। ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধেক কাজ সেরে ফেলেছে নানা পুজোমন্ডপ তাদের সজ্জার লাখো লাখো টাকার বাহারি আয়োজন। কুমোরপাড়াতেও মা সবান্ধবে সেজেগুজে প্রায় তৈরি প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে হাজির হতে। বিদেশে যেসব পূজো হবে সেই প্রতিমার দল তো ইতিমধ্যেই সাগর পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন।
তবু, এই মনের ভেতর কোথায় যেন তালটা কেটে যাচ্ছে। কিছুতেই সুরে লাগছে না। এত যে চতুর্দিকে এত অনাচার, ধর্মের নামে ধর্মগুরুদের দ্বারা কুসংস্কারগ্রস্ত, মূর্খ মানুষের নিরন্তরভাবে শোষণ যা তারা নিজেরাই ধর্মান্ধতার বশে দেখার চোখ হারিয়েছে। নারী ও শিশুর অবমাননা। দরিদ্র বন্যাদুর্গত মানুষের কান্নার জলে ধুয়ে যায় বাহারি প্যান্ডেলের গরিমা।
উৎসবের প্রকৃত অর্থ তো মিলন। সবাইকে খুশি করে সবার খুশি নিয়ে একসাথে হাঁটা। মানুষ কবে বুঝবে উৎসবের, ধর্মের প্রকৃত অর্থ? সেই অঞ্জলির মন্ত্রেও তো সেই নিজের জন্য চাওয়ারই তুচ্ছ বাসনা। " পুত্রং দেহি, ধনং দেহি, সর্বং কামাংশ্চ দেহি মে..... "। একজন নারীদেবী যার কাছে বরপ্রাপ্ত হয়ে ধন্য হবার দুরন্ত বাসনা তার কাছেও কন্যা নয়, পুত্রলাভের আর্জি??
হৃদয়ের ভেতর থেকে যত প্রজ্ঞা মূর্তিমতী হন, তত মনে হয়, না তিনি আসেন না, শুধু মাটির উপর রঙের প্রলেপ পড়ে, গড়ে ওঠে কল্পনার এক অসীম ক্ষমতার অধীশ্বরী নারীমূর্তি, তার পায়ে ফুল দিই, বেল পাতা দিই, তাকে ভক্তি বা সম্মান দেখানোর ভান করি অথচ রক্তমাংসের এক নারীকে একা অবলা পেলে নির্দিধায় ধর্ষণ করি, নারী বৃদ্ধা টিকে বা নারী শিশুটিকেও ছেড়ে কথা কই না।
তিনি মৃণ্ময়ীরূপে আসেন,আলোকমালায় সাজানো মন্ডপে এসে বসেন বহুসম্ভারে সাজানো ভোগ সামগ্রীর সামনে, যা তিনি সতত গ্রহণ করেন না, যথানিয়মে চারদিনবাদে তিনি জলের সাথে মিশে আবারো মাটি হয়ে যান, চিন্ময়ী দূর্গা, দীন নিরন্ন রক্তমাংসের দূর্গা প্যান্ডেলের বাইরে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে, তার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে না।।।।
কলেজ গ্রূপের সবাইকে শারদীয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
উষ্ণা রায়
তনিমা হাজরা।।
****************************************
সূচীপত্র
সম্পাদকীয়
কবিতা বিভাগ -
১. মৃত্তিকা মুখার্জি চট্টোপাধ্যায়
২. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
৩. কৌশিক সরকার
৪. ভজন দত্ত
৫. সোমালি চৌধুরী
৬.মানবেন্দ্র ব্যানার্জী
৭. দেবাশিস মন্ডল
৮. অনন্যা চ্যাটার্জী
৯. সঙ্গীতা হালদার
১০. চঞ্চল রায়
১১. তনিমা হাজরা
১২. মহুয়া দাস
১৩. কঙ্কনা মুখার্জী
১৪. শান্তব্রত সেন
১৫. শ্যামলী দাস
১৫. শ্যামলী দাস
ভ্রমণ কাহিনী বিভাগ -
১. চূর্ণী পাত্র
২. তপতী সন্নিগ্রাহী
রম্যরচনা বিভাগ -
১. সুজন সেনগুপ্ত
২. সংঘমিত্র মাকুড়
৩. তনিমা হাজরা
প্রবন্ধ বিভাগ -
১. সুব্রত চৌধুরী
২.জয়শ্রী কুনডু
৩. চন্দ্রিমা চ্যাটার্জী
গল্প বিভাগ -
১. দোলা সেন
২. চিন্ময় সিনহা
৩. তাপসী কর
৪. অনন্যা ব্যানার্জী
৫.বিথিকা নাথ
প্রচ্ছদ অলংকরণ - কাকলি শেঠ
কারিগরি সহায়তা ও ব্লগবিন্যাস - উষ্ণা রায়
****************************************
কবিতা
দহনসুখ : মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়
হাতের ওপর হাত-
দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে
স্নিগ্ধ অগ্নিপাত।
চোখের পাতায় চোখ -
আয়নাটা আজ সরানো থাক্
সময় নদী হোক্।
কিছু প্রগলভ সংলাপ -
ব্যাকুল হাতে কুড়িয়ে নেওয়া
শীতলতার তাপ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
জাগো মন : অনন্যা চ্যাটার্জি
হাত ভরেছে শিউলি ফুলে
বুক ভরেছে গন্ধে
তবুও তো উদাস মন
রয়েছে আজও দ্বন্দ্বে।
সাবধানে তে পা ফেলো আজ
সজাগ রাখো দৃষ্টি ,
মেঘের পরে মেঘ জমছে
রাতভোর চাই বৃষ্টি ।
বাজ হেনেছে কঠিন আঘাত
মেঘ কেঁদেছে তাই সারারাত
এখনো বুকে ভারি নিশ্বাস
উথাল পাথাল শ্বাস প্রশ্বাস।
সাবধানে তে পা ফেলো আজ
সজাগ রাখো দৃষ্টি,
দারুণ রোষে সূর্য ও তাই
উল্টো করছে মেরু
শক্তিশালী আয়নিত কনার স্রোতে
কাঁপবে ভূতল হতে মরু।
আমিও তো চাই প্রবল প্রলয় ,
আশ্বিনে ঝড়
নটরাজের প্রলয় নাচন,
আগ্নেয়গিরি ফাটবে যখন
লাল লেলিহান হবে গগন ।
সেই আগুনেই নিধন হবে
শরীর মনের অসুরগণ।
কালো চিলের বুক চিরে
তারপর সেই সকাল হবে ।
নরম তবুও মাটি এখন
পথ রয়েছে পিচ্ছিল,
বৃষ্টিতে মন এখনো ভিজে
চোখের তারায় ঝিলমিল ।
সাবধানে তে পা ফেলো আজ
সজাগ রাখো দৃষ্টি,_
অসুরশক্তিরনাশ হয়ে
বাঁচুক আবার সৃষ্টি ।।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সৈনিকের রোজনামচা : শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
এক
হুটারের একটানা একঘেঁয়ে সুর
রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে করে খানখান,
প্লেটুনের পেটা ঘড়ি
বুটের আওয়াজ,
গলা টিপে
মেরে ফেলে পাখীদের গান।
একদা শৈশব ছিলো
স্বপ্নের মতো,
লাট্টুর মাছিদমে,
সুর্তির টানে,
ঠাম্মার হাত ধরে
গঙ্গা স্নানে,
কৈশোর এসেছিল
নিজ মন্ত্র বলে,
শরীরের তটভূমি
তার ছায়া তলে
করেছিল অগ্নি স্নান
অজানা উৎসাহে।
তারপর ধীরে ধীরে
কলেজের খাতা,
ছেয়ে গেলো
আমাদের বিষণ্ন ব্যথা ।
হুটারের একটানা
একঘেঁয়ে সুরে,
একগুঁয়ে যৌবন
মাথা খুড়ে মরে ।
সৈনিক ও প্রেম - দুই
বহুদিন হলো
তোমাকে স্যালুট করি নি,
তোমার কক্ষপথ থেকে
বিচ্যুত আমি,
সারি সারি
বাতিস্তম্ভ সাথে,
ইনসাস্ কিংবা স্টেনগান হাতে।
একতোড়া গোলাপ
ভগ্নপ্রায় সেতু র ওপারে,
অপেক্ষায় ছিলো
যেন নক্ষত্রের মতো,
আগামী সন্ধ্যে হবে
তারকাখচিত।
দ্বিধা হীন চুম্বন
প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষণ প্রতিরাত্রি
প্রতীক্ষায় জেগে থাকে
পদাতিক তরে।
প্রিয়তমা আমার
আসবো আবার ফিরে
তোমার উঠোনে,
তেরঙ্গা মোড়া
এক বিবর্ণ কফিনে।
মুখোমুখি - তিন
নিজেকে দেখছি আমি,
টানটান অঙ্গীকারের মতো,
ঋজু , দৃঢ় , বলিষ্ঠ, বহ্নিমান।
আমার তীব্র চোখে
অগুণিত সূর্যের আলো,
মুছে দ্যায় অন্ধকার ,
ঢেকে ফেলে পৃথিবীর কালো।
আমার শাণিত বাক্য ,
কাব্য যন্ত্রণা,
অসহ্য করে তোলে
পদপিষ্ঠ মানুষের
চরমবঞ্ছনা।
বিপ্লব বেঁচেছিলো
জারজের মতো,
অতি সংযত,
অন্তরের অন্তস্হলে,
পিঠোপিঠি যুদ্ধক্ষেত্র,
ককপিট্ , ট্রেন্চ ,আর
বাংকার যতো,
কেড়ে নিলো যৌবন ,
একেঁ দিলো ক্ষত।
মৃতপ্রায় আমি ,
অপেক্ষায় আছি,
ফির যদি
ফিরে আসে
হারানো সুনামী।
আপোষ - চার
বজ্রপাতের পর
শ্রেণীবদ্ধ সুপুরীর মতো,
অতি সংযত নাকি অর্ধমৃত,
রসহীন প্রশ্ন হীন দ্বিধা হীন,
পুতুলের দল , অতি দুর্বল ,
জলপাই পোশাকের
আভরণে মোড়া,
নির্বাক, নিশ্চুপ নির্দেশের তরে
আমরণ অপেক্ষা করে ।
ভূকম্পন শেষে
বিধ্বস্ত শহরের মতো,
চৌচির , বিপর্যস্ত ,
সমর্পিত, ভণিতার স্রোতে _
পদাতিক দল , আকণ্ঠ গরল,
কুচকাওয়াজ, বুটের আওয়াজ ।
পরাশ্রয়ী গুল্মদের মতো
বাঁচিবার তরে
বিস্বাদ জীবনকে
আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শরৎ : সঙ্গীতা হালদার
শরৎ তুমি কখন এলে মধুর হাওয়া নিয়ে?
কবেই এসেছি বললো শরৎ মেঘের মধ্য দিয়ে।
কাশের বনে লাগলো দোলা
ভোরে উঠলো শিউলি তলা
আমলকি বন উঠলো সেজে নতুন মঞ্জরিতে
দুববো ঘাসও পা ধোয়াল শিশির বিন্দুতে
শরৎ তুমি বলত এবার
মেঘের রূপের এ কি বাহার
পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো ভাসতে কেন থাকে?
কোথায় যায় সে কতদূরে
কোন অচেনা অচিনপুরে?
যাচ্ছে কি সে দশভুজা দুগ্গা মাকে আনতে?
শরৎ তুমি খবর দিও দোয়েল পাখির কাছে
নতুন রঙে নতুন ঢঙে থাকবো সবাই সেজে
দোয়েল এসে বললো হেসে
মা আসছেন নতুন বেশে।
তাইতো শরৎ বলছি তোমায়
আলোর প্রতি কনায় কনায়
শরৎ তুমি তোমার রূপের প্রদীপ খানি জ্বেলো
উমা এসেছেন,বরণ করে ,ঘরে তাকে তোলো।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
হাসিকান্না : সোমালি চৌধুরী
শহরের প্রতিটি কানাগলিতে ঢাকের আওয়াজ
আলোর রোশনাই এ ঝলসানো চোখ
চারিদিকে মানুষের ঢল
অগুনতি মনমাতানো চকমকি।।।
তার ই মাঝে দুগ্গা র আর্তনাদ
বীভৎস যন্ত্রনা র উচ্ছাস
লাল দুর্বার ব্যঙ্গ হাসি
মুছিয়ে দেয় দুর্গার আবাহন র
যান্ত্রিক ভর্তুকি।।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শুক, তোমাকে : ভজন দত্ত
কিছু হাওয়া বুকপকেটে ,কিছু ডান হাতের মুঠোয় বন্দি করে তোমার কাছে যেতে যেতে রিক্ত হয়ে যাই
পকেট কেটে রেখে গেছে কারা
কারা শুকনো পাতায় বিড়ি জ্বালিয়ে জঙ্গলে আগুন দিয়েছে মশকরায়
সব পড়ে থাকে, শুক
সারি সারি হিসেবের খাতাও
পকেটে যে হাওয়াখানি সযত্নে রেখেছিলাম সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তে পিচ্ছিল হচ্ছে পথ
যেতে গিয়ে পিছলে যাই কোনো হাত নেই বাড়ানো
পোড়া মাংসের গন্ধে ফুসফুসে কালি পড়ছে তবুও স্বপ্নে দেখা পথে পা পা হাঁটা
থেঁতলে থেঁতলে দিয়ে যাচ্ছে যে যখন পারছে যেমন ভাবে
ছোট্ট শিশুর মত টলমল পায়ে দুটি হাত বাড়িয়ে আগিয়ে যাই কিনারায়
সে কিনারায় খাদ ছিল শুক,
পারলে এ পথের পথিকদের তুমি বলে দিও...
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
চার লাইনের হাফ ডজন কবিতা : দেবাশিস মণ্ডল
কবিতা - ১ : ভালোবাসার কোলে
দু’চোখের পাতা যার
ভেসে যায় জলে
ভালোবাসা দিয়ে তারে
টেনে নাও কোলে ।
কবিতা - ২ : সেবা মন্ত্রে
পরনে যাদের জীর্ণ বসন
শীর্ণ হয়েছে দেহ
সেবা মন্ত্রে করহ পূজন
ছিন্ন না হও কেহ ।
কবিতা - ৩ : মমতার সুর
পথহারা সব পথশিশু
কষ্ট তাদের শীতের ঋতু
দান করি বস্ত্র, কষ্ট কর দূর
বাজে হৃদি মাঝে মমতার সুর ।
কবিতা - ৪ : সুখ
দিনের শেষে আঁধার জাগে
যায় না চেনা মুখ
শেষের দিনে সঙ্গে থাকে
একটু খানি সুখ ।
কবিতা - ৫ : প্রেম
যখন চাঁদের আলোর বন্যা এসে
ভাসিয়ে দিল ধরায়
তোমার কথা ভাবছি বসে
দোলন চাঁপার তলায় ।
কবিতা- ৬ : একাকীত্ব
দৈর্ঘ্য- প্রস্থে সমকোণী
দৈর্ঘ্য দৈর্ঘ্যের সমান্তরাল
দৈর্ঘ্য মাপে একাকীত্ব
জীবন মাঠে তখন বিকাল ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অন্ধকার ডাকবাক্স : মানবেন্দ্র ব্যানার্জী
অদ্ভূত আঁধারে হাঁটতে থাকি পথ
পকেটে নিয়ে পায়রা আঁকা চিঠি
অন্ধকারে পাইনা খুঁছে ঠিকানা
কোথায় গেলো সেই ডাকবাক্সটি?
গৃধ্নুর দল পেতে থাকে ওৎ
শিকার পেলেই শুষে নেবে রক্ত
চিল শকুনের ডানা আছে খোলা
ওরাও তো ওই গৃধ্নুদেরই ভক্ত।
সিংহ যদিও বীর পুঙ্গব রাজা
রাজকর্মে নাইকো মনোনিবেশ
আকাশ পথে উড়ে চলে বিমান
চিল শকুনের থাকেনা তো দেশ।
তুমি আমি এবং হরিণ যত
জপতে থাকি শান্তির পূতবাণী
অন্ধকারের বোঝা নিয়ে পিঠে
ছুটছে সময় রানার মহাজ্ঞানী।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শেষের কবিতা : কৌশিক সরকার
উড়িয়ে দিলাম সব কবিতা
অনুরাগে নয় - অপার রাগেই ,
পুড়িয়ে দিলাম কাব্য খাতা
দাফন দেওয়ার অনেক আগেই ।
তিক্ততা নয় একটু জমুক
মনখারাপের গন্ধেভরা ,
অল্প কথায় গল্প সাজুক
রাতবিরেতে সন্ধ্যেতারা ।
তারা তো নয় , সূর্য্যি এ তো
মাথার ওপর গনগনে আঁচ ।
সব কাব্যিই লাগছে তেতো
ছোট্ট কোরে , স্বল্পেতে বাঁচ ।
সেই বাঁচাটাই বাঁচতে চেয়ে
কাব্যি কলম দিব্যি তুলে ,
কান্না থামুক , অলপ্পেয়ে ,
গদ্য ফুটুক তীব্র হুলে ।
সব কবিতা নীলাকাশে ।
কাব্য খাতা অগ্নিগ্রাসে ।
হাহাকারের অন্ধকারে ,
গদ্য চাবুক , সময় শাসুক ।।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বনবাস : কৌশিক সরকার
যা কিছু দৃশ্যমান
সশব্দে বর্তমান
জেগে রয় দর্পে বারোমাস ।
তবুও মনের ঘরে
গোপন অদৃশ্য চরে
হেরো কিছু ইচ্ছা করে বাস ।
সেইসব ইচ্ছেরা
হেরেও যে না হারা
চাপা স্বর , মৃদু ফিসফাস ।
মনের অলিন্দ বেয়ে
গুনগুন গান গেয়ে
অভিমানে সে সুর উদাস ।
একাকী সময় গুনে
স্বপ্নের জাল বুনে
আধোরাতে খোঁজে মধুমাস ।
অসময় এ ফাগুনে
ধিকিধিকি সে আগুনে
পোড়ায় , জ্বালায় হাড়মাস ।
পাছে তারা হৃদিপটে
বিদ্রোহে জেগে ওঠে
দাবি রাখে , চায় পুনর্বাস ।
ইচ্ছের উঁকিঝুঁকি
তাই তো সামলে রাখি
ম্লানমুখে দিই বনবাস ।।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ভিনগ্রহী : চঞ্চল রায়
সেই সব মজ্জা কথাগুলি
এই সব এপিড্যারমাল কথাদের সমারোহে
ভিনগ্রহী
জীবনের পৃথিবীতে
পৃথিবী হারাতে হারাতে
কালতুল্যর সঙ্গে হয় অবধারিত দেখা ।
ছেঁড়া হৃদয়ের সেই ছিঁড়ে যাওয়া শব্দ মোহনায় আজ কত যে মধুর
মহাকালে লীন ভ্রূক্ষেপ পীযূষ;
সব কথা যেন
সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে
প্রাচীন শিরীষের ঠাকুরমা বিটপ
আহা প্রথম বসন্ত মন
এখনো এখানে সুমধুর কথাগুলি স্পষ্ট কয় ।
কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে দূরে
গতি অন্ধকার আগুন বিস্ফোরণে
অবায়ু প্রশ্বাস টেনে টেনে
স্ব স্ব জীবন নক্ষত্র ঘুরে ঘুরে
ফেলে আসা নীল গ্রহটিরে
ফিরে ফিরে ক্ষণিক অদৃশ্য দেখা
এই সব কথাদের ভীড়ে
হৃদয় শুনিতে পায় সেই সব ভিনগ্রহী
মনোহরা মধুময় 'গভীর দুখের নীরব সুখের ' কথা ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এবার পূজোয় : তনিমা হাজরা
এবার পূজোয় শিশিরভেজা মহালয়ার ভোর
শুকতারাটির আলোয় মাখা আমার এবং তোর।
তোর ঘুমচোখে হই আলতো আকাশ, নীলের ছড়াছড়ি,
পঞ্চমীতে লাটাই ছিঁড়ে ভোকাট্টা ঘুড়ি।
এবার পূজোয় শিউলিতলায় আবার মুখোমুখি,
কত শরৎ পেরিয়ে এসে অবাক হয়ে তোকেই দেখি।
এবার পূজোয় চারটেদিন ই তোর সাথে
বোধন,যাপন, অঞ্জলি আর ঠাকুর দেখা মাঝরাতে।
এবার পূজোয় তোর আবাহন শিউলি, কাশে,
জড়িয়ে থাকিস, ভরিয়ে থাকিস তুই প্রতিটি নিঃশ্বাসে,
এবার পূজোয় তোর জন্য রাখছি কিনে নতুন জামা,
তোর ব্যালকনিতে রোদ হয়েই নয় তোর পায়ের কাছে একটু থামা।
এবার পূজোয় তোর জন্য বই কিনেছি শারদীয়া,
কোজাগরীর চাঁদের সাথে আবার হব প্রিয়ম-প্রিয়া।
এবার পূজোয় ছুটির বিকেল চায়ের কাপে,
আমার জন্য একটুসময় বাঁচাস কিন্তু কাজের চাপে।
এবার পূজোয় নীল আকাশে মেলব আমার ইচ্ছেডানা
তোর হৃদয়ের অলিগলি পাড়ি দেবার কিনে নেব টিকিট খানা।
এবার পূজোয় তুই বলে দিস কোন দিন কি পরব শাড়ি,
তোর হাসিতেই ভুলে থাকি বিষণ্ণতার কমা- দাঁড়ি।
এবার পূজোয় জীবন মোড়ে, আমরা দুজন ফিরতি পায়ে গোল্লাছুট,
নৌকোটাকে দিক ঘুরিয়ে উল্টো স্রোতে হরির লুট।
এবার পূজোয় জ্বালব রাতে হাজার তারার রঙমশাল
আমরা দুজন অনায়াসেই পেরিয়ে যাব ভালবাসার এই দ্রোহকাল।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পরকীয়া : মহুয়া দাস
ঠিক দুপুর একলা রাতে
আলো আধার ছলনাতে
ঘুমের ঘোরে জেগে শুনি
Hello madam,excuse me.
ঠাহর কিছু হয়না চোখে
কে যেন ঠিক ছায়ার মতো
এসে দাড়ায় আমার পাশে।
একটু কেশে বললো হেসে
Madam আমি গোপেন গোঁসাই,
বছর দশেক ভূত হয়েছি।
চমকে উঠে খিচিয়ে বলি
রাত দুপুরে মামদোবাজি?
চটেন কেন শোনেন কথা
মনে আমার দারুন ব্যথা,
বছর তিনেক হলো বিয়ে
কাটছিল দিন ফুরফুরিয়ে।
পেতনি আমার সুন্দরি গো,
মনটা যে তার পদ্মকলি,
দুখের কথা কি আর বলি।
Face book আর what's app এ
সর্বদা ই মেতে থাকে,
এও তো সই ছিল ভালো,
এখন আবার কবি হলো,
গোদের উপর বিষ ফোড়াটার
এখন আমি কি যে করি।
সদয় হয়ে জিগাই তাকে
আমার কাছে কি চাও তুমি
লাজুক হেসে বললো শেষে
একলা রাতে ঘুরে মরি,
রোজই দেখি আপনি জেগে
সাধ হলো তাই গল্প করি,
পরকীয়ায় নাই অরুচি
আপনি যদি থাকেন রাজি।
শর্তো একটা আছে আমার
কবিতা লেখা চলবে না আর।
আপনি যদি রাজি না হন,
চেনা জানা যত আছে
বলুন গিয়ে তাদের কাছে
নইলে এবার মরেই যাবো
pls একটু help করে দিন
এই বলে সে মিলিয়ে গেল।
offer টা তাই দিলাম তোমায়
একটা কথা রেখো মাথায়
কবিতা লেখা চলবে নাকো
pls একটু ভেবে দেখো
কিগো রাজি?বোলো আমায়
ভূতের সাথে পরকীয়ায়।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পিছুটান : কঙ্কনা মুখার্জী
প্রত্যয়ের কাছে নতজানু হয়ে
বুনে নিয়েছি জীবনের নকশিকাঁথা
শেষ বিকেলের রোদ্দুর গায়ে ।
মেঘবালিকার হাতছানি ,
রূপকথা রং
মুখ ও মুখোশের যুগলবন্দী
চিলেকোঠার একান্ত
আঁকা হয়
মোছা হয়
থেকে যায় বয়সের জলছবি
আমার আমিকে খুঁজবার অন্তরাল।
আমার নকশিকাঁথা
আমার পিছু টান।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
শেকড় : শান্তব্রত সেন
চলো একটু আকাশ দেখি
বন জংগল পাহাড় বাসি,
শিশির ভেজা ঘাসে দাঁড়াই
কাদা-মাটির ঘর বানাই,
দেহটারে প্রাণ দিই
জীবনটারে গান দিই।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ফিরে ফিরে আসে শারদীয়া : শ্যামলী দাস
ফিরে ফিরে আসে শারদীয়া
চুপিচুপি আসে শারদীয়া...
নীল ক্যানভাসে ছবি ভেসে ওঠে..
কিশোরী বেলার স্বপ্নেরা জোটে..
চুপিসারে আসে শারদীয়া
হলুদ শাড়ী তে মন্ডপ ভরা
একজোড়া চোখ খুঁজে খুঁজে সারা
পুষ্পাঞ্জলি, আড়চোখে দেখা
মন বুঝে নেয়," আর নই একা"
ভিড়ের মাঝেতে কভু চোখাচোখি
শারদ আলোয় হয় দেখাদেখি...
ফিরে ফিরে আসে শারদীয়া
কতজোড়া চোখ হয়ে বেসামাল...
উড়ুউড়ু মন, টুকটুকে গাল..
সবার আড়ালে বাঁধন ছাড়ায়
কেউ তারে পায়, কেউ বা হারায়...
চুপিচুপি আসে শারদীয়া
এখোনো শারদ ফিরে ফিরে আসে...
মাঝবেলাতে, শিউলি ও কাশে..
বৃদ্ধ কাশের চোখ রাঙানি
শিউলিও দেয় কান ভাঙানি
তবুও তো প্রেম উঁকি দেয় প্রাণে
শারদ এলো যে! কেমনে সে জানে?
এই অবেলায় শিশিরের গান
উদাসী বাউল, মন আনচান
পার হয়ে আসা রঙিন শারদ
দুই কুড়ি তে ও জমছে পারদ
প্রেম ফেরি করে শারদের হাওয়া
যত জমা প্রেম, গলে গলে যাওয়া
শারদ আকাশে যাদুর কাঠি
সময় মানেনা বয়সের ফাঁকি
শারদোৎসবের মিলন মেলায়
প্রাণ হারাবার অবাধ খেলায়
শারদ আসে শারদ যায়...
ছুঁতে চাওয়া দিন ফিরে ফিরে পায়
****************************************
ভ্রমণ কাহিনী
জেরুজালেমে একদিন : চূর্ণী পাত্র
এই গ্রুপে শারদীয়া ব্লগে ভ্রমণ কাহিনী দেবার বার্তা পাওয়ার থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, কি লিখি কি লিখি। হঠাৎ করেই সুযোগটা এসে গেল।
ইজরায়েলের সবথেকে প্রসিদ্ধ এবং বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও ধর্মস্থান জেরুজালেম যাবার। সুশান্তর অফিস কলিগ দুজন(একজন ভারতীয় ও অন্যজন স্থানীয় ইহুদী)আমাদের সপ্তাহান্তে নিয়ে যাবে। ৯ই সেপ্টেম্বর শনিবার অর্থাৎ ইহুদীদের কাছে শাবাথের দিন ভ্রমন। খাবার দাবার নিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের নিবাস হাদেরা থেকে জেরুজালেমের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। শাবাথ মানেই রাস্তাঘাট প্রায় জনশূণ্য।তাই বেশ তাড়াতাড়ি তেল-আবিবের কাছাকাছি অর-ইহু্দা নামে এক শহরে পৌঁছালাম,এখান থেকে স্থানীয় বন্ধু ও গাইড হেজী আমাদের সাথে যোগ দিল। সেখান থেকে প্রায় ৪৫ মিনিটের রাস্তা জেরুজালেম। দশটা নাগাদ প্রবেশ করলাম সেই আশ্চর্যজনক শহরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পুরানো জেরুজালেম শহর। কিছুটা পাহাড়ী রাস্তায় উঠে Haas Promenade এ গাড়ী থামল। অপূর্ব এক ভিউ পয়েন্ট যেখান থেকে পুরো জেরুজালেম শহরটাই দেখতে পাওয়া যায়। ডান দিকে মরুভূমি আর ডেড সি র কিছুটা অংশ দেখা যায় আর পাহাড়ের পিছন থেকে শুরু হয়েছে জর্ডন উপত্যকা। ভিউ পয়েন্ট থেকে শহরের প্রায় সব বিখ্যাত স্থাপত্যের আন্দাজ পাওয়া গেল। আমাদের হেজী প্রতিটির নাম ও ইতিহাসের সাথে আমাদের পরিচিত করাতে থাকল। অলিভের বাগান বরাবর হেঁটে এগোলাম কিছুটা,বাঁদিকে দূরে লম্বা আঁকাবাঁকা পাঁচিল যার এপারে জেরুজালেম অন্যপারে প্যালেস্তাইন। এখন অলিভের সিজন তাই সব গাছগুলিই ফলে ভরা। একটা তুলে মুখে দিতেই মুখটা তেতো হয়ে গেল।
আধঘন্টা অলিভ আর পাইন ঘেরা বাগান ঘুরে পুরানো জেরুজালেম রেলওয়ে স্টেশনে এলাম। ইরগুনরা এই স্টেশনকে ১৯৪৬ এ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল,তারপর পুনরায় তৈরী করা হয়,এইটুকু শুনে আমি তড়িঘড়ি পা ফেলে এগিয়ে কেমন স্টেশন দেখব বলে যেই ঢুকেছি দেখি জোরকদমে কনসার্ট চলছে অথচ রেললাইনও রয়েছে,কি হচ্ছে ব্যাপারটা ভাবছি যথন দেখি হেজী ততক্ষণে আমার কাছে পৌঁছে গেছে,জানলাম এই স্টেশনে আর ট্রেন চলেনা,কালচারাল আর এনটারটেনমেন্টের জায়গায় পরিবর্তিত হয়েছে| অন্য জায়গায় নতুন স্টেশন তৈরী হয়েছে।
এখান থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে একটা বড়সড় পুরানো দিনের উইন্ড মিলের কাছে এলাম।নেমে হেজীর পিছন পিছন এগোলাম, ছোট্ট একটি কলোনি,নাম Mishkenot Sheramim,প্রথম ইহুদী বসতি যা পুরানো জেরুজালেমের বাইরে ১৮৬০ সালে স্থাপিত হয়। লক্ষনীয় হল এখানের সমস্ত ঘরবাড়ীর দেওয়াল পাথরে তৈরী,পরে যা আমরা পুরো যাত্রাতেই দেখতে পেয়েছি| গাছগাছালি ফুল ফলে ভরা পাহাড়ের ওপর মনোরম এক বসতি। হেজী এই কলোনি গড়ে ওঠার ইতিহাস গড়গড় করে বলে যাচ্ছিল,আমি সেই ডিটেলসে আর যাচ্ছি না।
ঘুরতে ঘুরতে সাড়ে বারোটা,খিদেতে পেট চুঁইচুঁই,খাবার তো সাথেই আছে,আর এখানে পার্কেরও অভাব নেই,একটা পার্কে ঢুকে খাওয়াদাওয়া সারলাম। ইতিমধ্যে দুপুর দেড়টা,কড়া রোদ্দুর,তার ওপর জেরুজালেমে কালো পোষাক পরতে হয় শুনে কালো পরেছি,বেশ গরমও লাগছে.....কিন্তু না এখন ঐসব ভাবার সময় নেই ,আসল জায়গাগুলোই তো দেখা বাকী!
রাস্তার ডানদিকে পড়ল কিং ডেভিড হোটেল,এই হোটেলেই সেই হোটেল যেখানে ট্রাম্প ও মোদী তাদের ইজরায়েল ভিসিটে এসে ছিলেন| সেই স্যুইটটি হল পৃথিবীর সম্ভবত সবথেকে সুরক্ষিত জায়গা,যা হল যে কোনরকম আক্রমণপ্রুফ। উঠলাম গিয়ে King David's Tomb এ। কথিত যে রাজা ডেভিড(1000 BCE)ছিলেন ইজরায়েলের দ্বিতীয় রাজা,তার ছেলে সলোমন এই সমাধিটি বানান। ইহুদীদের কাছে এ এক পবিত্রস্থান।
এখান থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়েই ডানদিকে পেলাম Room of the Last Supper.এই সেই রুম যেখানে যীশুখৃষ্ট তাঁর শিষ্যদের সাথে বসে তাঁর জীবনের শেষ খাবার খান।
এখান থেকে একটু হেঁটেই দেখতে পেলাম Dormition Abbey ।কথিত আছে মা মেরী এখানে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তার সমাধিতে মাথা ঠেকিয়ে যখন বেরোলাম পা বেশ টনটন্ করছে,অগত্যা কফি ব্রেক।
এবার এলাম Zion Gate এ।পুরানো জেরুজালেম শহরে যাবার জন্য আটটা গেটের একটি গেট এটা।অজস্র বুলেটের দাগ এর দেওয়ালে| এই গেটকে Wounded Gate বা Gate of the Jews ও বলা হয়ে থাকে।১৫৪০ সালে সুলতান সুলেমান তৈরী করেছিলেন এই গেট।
গেট পেরিয়ে কিছুটা এসে পেলাম বাজার ,বাজার শব্দটা এখানেও চালু সম্ভবত আরবী উৎস থেকে আসা বলে।রকমারী পণ্যের দোকান। কোথাও নানান মশলা,কোথাও খৃশ্চানদের ধর্মীয় সামগ্রী,পানীয় বা ড্রাই ফ্রুটস আবার কোথাও বা পোশাক আশাক হঠাৎ করেই মনে হল যেন হর-কি-পেড়ীর গলিতে ঢুকে পড়েছি। বাজারের ওপর ছাদ,লোকজন খুব একটা এখানে ওঠেনা। কারণ একদম কাছেই পাঁচিলে ঘেরা সেই বহু আলোচিত মসজিদ। ওপরে উঠে বেশ কাছের থেকে দেখতে পেলাম আল-আসকা মসজিদ যা হল ইসলামদের তৃতীয় পবিত্রতম ধর্মস্থান ,মক্কা আর মদীনার পর আর অবশ্যই বহু বিতর্কিত। এর চূড়ো ৮০ কেজি সোনার পাত দিয়ে মোড়া। জানা গেল পুরো এলাকাটায় প্রায় ৩০০০০ ইসলাম ধর্মীয় থাকে এবং অন্যদের ঢোকা মানা। নেমে এসে Ramban Synagogue গেলাম। তার সামনেই আবার এক মসজিদ,গাইড বন্ধু বলল আগে নাকি প্রতিযোগিতা হত মসজিদ বনাম সাইনাগগের চুড়ার উচ্চতা বাড়ানোর!এই এক এমন জায়গা যেখান পাশাপাশি মুসলিন,ইহুদী আর খ্রীষ্টানদের পবিত্র ধর্মস্থান দেখতে পাওয়া যায়!
Western Wall যা হল ইহুদীদের সবথেকে পবিত্র স্থান এবার সেখানে এলাম।কাগজে মনের ইচ্ছা লিখে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে সেই কাগজ গুঁজে আসলাম।একে দুঃখের প্রাচীরও বলা হয়(The Wailing Wall)কারণ ইহূদীরা তাদের মন্দির ধ্বংসের শোকে এই দেওয়ালে মাথা রেখে কাঁদত।
কিছুটা হেঁটে এবার পৌঁছালাম Church of Holy Sepulchre....খ্রীষ্টানদের দ্বিতীয় পবিত্রতম ধর্মস্থান| ভিতরে যেয়ে ডানদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সেই জায়গা যেখানে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় , কালভারী পাহাড় যেখানে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তারই নিদর্শন বয়ে চলেছে এই চার্চ।বিভিন্ন দেশের দর্শনার্থীরা সারি দিয়ে এক এক করে ঐ কাঁচে ঘেরা পবিত্র পাথরে মাথা ঠেকাছ্ছিল। তার ঠিক নীচেই সেই পবিত্র পাথরের বেদী (the Stone of Anointing) যেখানে তাঁর দেহকে নামিয়ে এনে রাখা হয়েছিল এবং অন্তিম সমাধির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। আর আরেকটু বাঁদিকে এগিয়ে তাঁর সমাধিস্থল| চার্চের পুরোহিতদের প্রার্থনার সুরের মুর্চ্ছনায় পুরো জায়গাটা একটা মায়াবী রূপ নিয়েছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রতিদিন শ্রদ্ধা জানাতে এখানে জড় হয়| এইসব জায়গার কথা বইয়ে পড়েছি ও শুনেছি,এখানে আসার কথা কোনদিন কি ভেবেছি?....এককোণে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ! বাইরে এসে পা যেন আর চলে না সারাদিনের ক্লান্তি,রাস্তায় মাঝেমাঝেই দু একজনের প্রশ্ন ....."হোদু"?(ভারতীয়দের হোদু বলে এখানকার ভাষায়),মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললেই কেউ বলে সলমন খানকে জান?বা গান গেয়ে ওঠে ইচকদানা মিচকদানা.....বা বলল I love তন্দুরী চিকেন,ইত্যাদি।পার্কিংএ যাওয়ার পথে আর্মেনিয়ন কোয়ার্টার দিয়ে গেলাম।ফেরার সময় রাস্তায় দেখতে পেলাম জেলখানা,আর্মেনিয়ন চার্চ এবং বিখ্যাত আর্মেনিয়ন সিরামিকের দোকান।
হেজী বারবার বলল জেরুজালেম দেখত মিনিমাম সাতদিন সময় লাগবে, সঙ্গে এটাও জানাল পুরানো এই শহরের নীচে আরও কোন শহর বা সভ্যতা হয়ত লুকিয়ে আছে,ভবিষ্যত প্রত্নতাত্ত্বিকরা তার হদিশ দেবে। তাই আবার আসার ইচ্ছা রেখে এবারের মতো বাই বাই জানালাম জেরুজালেমকে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আন্দামান ভ্রমণ : তপতী সন্নিগ্রাহী
Andaman -The land of Emerald blue she and silvery sand !
দীর্ঘদিনের আন্দামান ভ্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল অবশেষে! কর্তার চাকুরিসূত্রে আন্দামানে conference হওয়ার দরুন সুযোগটা হাতের মুঠোয় এসেই গেল!
গত এপ্রিলের 12 তারিখে রওনা হলাম। কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের ফ্লাইট একদম ভোর পাঁচটা চল্লিশে। বিমানসেবিকাদের দেওয়া প্রাতরাশ খেতে খেতে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চললাম কালাপানির দেশে।নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ! মন বলেছিল ' আজ ম্যায় উপর, আসমা নীচে! ' বিমানযাত্রার অভিজ্ঞতা নতুন নয় যদিও তবু আন্দামান যাওয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চকর অনুভূতি! স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্বাসনের দ্বীপ !
দু'ঘন্টাও লাগলো না- নামলাম কালাপানির বুকে। খুবই ছোট্ট এয়ারপোর্ট Veer Savarkar International Airport.রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার তকতকে!থাকার ব্যবস্থা ছিল হোটেল Anbu International এ। দুপুরের খাওয়াদাওয়া এবং বিশ্রামের পর যাওয়া হল সেলুলার জেল এর Light & Sound program দেখার জন্য।
খুবই আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান! ওমপুরীর ভাষ্যে জেলের প্রাচীন ইঁটপাথর আর অশ্বত্থগাছের কথোপকথন ইংরেজ অত্যাচারের বিবরণ মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে!
দ্বিতীয়দিন ওখানকার conference program এ সামিল হলাম ।আন্দামান যে এতো সুন্দর তা আগে জানা ছিলনা! সমুদ্রের ধারে সারি নারকেলের শ্রেণী ।খুবই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য।ছবির মতো সাজানো CIARY কেন্দ্রটি।ওখানেই জানলাম আলু পেঁয়াজের চাষ তো ওখানে হয়ই না! অন্যান্য খাবারদাবারের প্রচুর দাম !একটা তরমুজের দাম কমপক্ষে তিনশো টাকা। হ্যাঁ যে জিনিসটি সবচেয়ে শস্তা আর সুস্বাদু সেটি হল ডাব।
হোটেলের প্রায় সব কর্মচারীই বাঙালি। পরের দিন Ross Island যাওয়ার প্রোগ্রাম কিন্তু বিধি বাম! আন্দামানের উপর নিম্নচাপের অবস্থান ! জোর বৃষ্টি আর উত্তাল সমুদ্র-প্রশাসন থেকে কাউকেই সমুদ্রে যাওয়ার permission দেওয়া হচ্ছিল না। ওয়ান্ডুর বীচে গেলাম ওখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর যাওয়া হল করবিনস্ কোভ বীচে।এখানে সমুদ্র আরও অশান্ত খুবই উঁচু উঁচু ঢেউ। দূরেরস আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিতে হোটেলে ফেরা ছাড়া গত্যন্তর রইল না!
পরের দিন Havlock Island যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। সকালে আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার কিন্তু আগের দিনই সমুদ্রে যেতে মানা করে দেওয়া হয়েছে তাই আন্দামানের মধ্যেই ঘোরাঘুরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
চিড়িয়াটাপু সী বীচে বেশ অনেক সময় কাটল।পুরুষমানুষেরা সবাই নেমে পড়লেন সমুদ্রস্নানে। দুপুরের লাঞ্চ প্যাকেট ব্যবস্থা ছিল।সমুদ্রের ধারে কাঠের গুঁড়িতে বসে চিকেন বিরিয়ানি সবাই মিলে খুব মজাসেই খাওয়া হল।
ওখান থেকে আবার সেলুলার জেলে গেলাম । অত্যাচার আর নৃশংসতার প্রতিমূর্তি! স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য বৃটিশদের তৈরি পেনাল সেটলমেন্ট!লম্বা বারান্দা ফাঁসিঘর লোহার দরজা সবকিছুই ইংরেজ অত্যাচারের জীবন্ত সাক্ষী ! জেলের ছাত থেকে সমুদ্র দেখে মন শান্ত হল।
আমি তো কবি বা লেখক নই। আন্দামানের সৌন্দর্য কে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই! অনেক কিছুই অদেখা রয়ে গেল! 'ভরিল না চিত্ত' ! আবার একবার নিশ্চয় যাবো শুধু ঘোরার জন্যই - নিজেকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এলাম।
****************************************
রম্যরচনা
নামস্য পরিবেদনা : সুজন সেনগুপ্ত
“ কাল সকাল নটার ফ্লাইটে দিল্লী থেকে উমা মহান্তি আসছে আর দুপুর দুটোর ফ্লাইটে কলকাতা থেকে আসছে সতীনাথ। কাউকে বিমানবন্দরে যেতে হবে ওদের আনতে। কে কে যেতে চাও?” বেশ উচ্চস্বরে প্রশ্নটি করলেন ডঃ সলিল ব্যানার্জী, সবার সলিলদা, ন্যাসভিলের বাঙ্গালী সমিতির সভাপতি। ন্যাসভিলে যে এত ভারতীয় আর বাঙ্গালী আছে তা কল্পনা করিনি। আসলে সারা মার্কিন যুক্তারাষ্ট্রে মেক্সিকানদের পরেই বোধহয় ভারতীয়দের সংখ্যা। ফলে, ভারতীয় সমিতি ছাড়াও তেলেগু, তামিল, মালয়ালী, গুজরাতি, মারাঠা প্রভৃতি সব প্রদেশের সমিতি তৈরি হয়েছে। ভারতীয়রা তাদের নিজের নিজের প্রাদেশিক সমিতির মধ্যেই মেলামেশা করেন। কদাচিৎ ভারতীয় সমিতির মিলন উৎসব আয়োজন করা হয়। কিন্তু অভারতীয়দের সাথে মেলামেশা এরা সযত্নে এড়িয়ে যান। বাঙ্গালী সমিতির সাথে ভাষাগত মিল থাকায় বাংলাদেশীরাও এই বঙ্গ সমিতির অঙ্গ। ফলে বাঙ্গালী সমিতির আকার অন্য প্রদেশের সমিতির আকার অপেক্ষা বেশ বড়। দুর্গা পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সব পূজার আয়োজন হয় এই সমিতির পরিচালনায় শনি বা রবিবার। শ্রী বালক ব্রহ্মচারীর সন্তান দল থেকে, অনুকূল ঠাকুরের সৎসংঘ, এমন কি আনন্দমার্গী সম্প্রদায়, সবার সাদর আমন্ত্রণ থাকে তাদের বালখিল্য, সত বা আনন্দময় ভাষণ শুনিয়ে অনেককে মোহিত করার। সময়ের অভাবে প্রতি বছর একটি দিনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা মিলিত হয়ে খুব ধুমধামের সাথে রবীন্দ্র-সুকান্ত-নজরুল জয়ন্তী পালন করেন। আমাদের মত ফাজিলরা আড়ালে আবডালে একে “রসুন” উৎসব বলে ব্যঙ্গ করে। এইসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, বাপের জন্মে নাম না শোনা আফ্রিকার কোন দেশের সাহায্যার্থে স্বদেশ থেকে স্বনামধন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠান আয়োজন করে অর্থ সংগ্রহ করাও বাঙ্গালী সমিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকাণ্ড। কিছু বাঙ্গালীর অদম্য উৎসাহ দেখে মনে হয় স্বদেশে সমাজসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েই তারা সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছেন।
এছাড়াও বেশ কিছু, ছোটখাট সমাজ সেবা বাঙ্গালী সমিতির সদস্যদের করতে হয়। যেমন, কোন অবিবাহিত প্রবাসী যুবকের সাথে কোন বাঙ্গালীর দেশে পড়ে থাকা মাসতুত বোনের বিয়ের সম্বন্ধ করে দেওয়া, যুক্তারাষ্ট্রে প্রথমবার পদার্পণকারী বাঙ্গালীকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে এসে তার থাকার ব্যবস্থা, ভাড়া বাড়ী খোঁজা ইত্যাদি। প্রত্যেক শনিবার সমিতির সদস্যারা কোন না কোন বাঙ্গালী সদস্যের বাড়িতে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় প্রাণ খুলে আড্ডা দেবার সুযোগ পান। তার সাথে নৈশ ভোজ। এই রকম এক সন্ধ্যায় তুষারদার বিশালাকায় বাড়িতে অনেকেই একত্রিত হয়ে ভারতবর্ষের দুর্দশার কথা, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র, ওয়াল মারটে কবে কী ছাড় পাওয়া যায়, কে কি নতুন গাড়ী কিনেছে আর কার শাড়ী নিউইয়র্ক থেকে এসেছে এসব নিয়ে জোরদার আলোচনা চালাচ্ছিলেন। সলিলদার কথা শেষ হওয়া মাত্রই, কাজলদা হাত নেড়ে জানালেন যে দুপুরে তার অন্য কাজ আছে। সুতরাং সকালে উমাকে আনতে বিমানবন্দরে তিনিই যাবেন। কাজলদা অর্থাৎ কাজল সামন্ত একজন সুদর্শন, সর্বদা ফিটফাট বাহারি পোশাক পরিহিত এক সপ্রতিভ মানুষ। পুরুষদের সাথে কথা বলে তিনি সময় নষ্ট করা পছন্দ করেন না। কিন্তু শুনেছি মহিলাদের সাথে তিনি খুবই মিষ্টভাষী আর তাদের প্রয়োজনে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গিত করতে পারেন। বছর দুয়েক আগে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়ায় এখন সমাজসেবায় তাঁর আর কোন বাধা নেই। মহিলারা কেন যে অবলীলায় মাথার কার্তিককে পায়ে ফেলেন তা আমার বোধগম্য হয়নি কখনো। সে যাই হোক, সতীনাথকে আনতে কে যাবে কাল দুপুরে? কেউ কোন কথা বলছেন না। সলিলদা আবার জিজ্ঞেস করলেন “সতীনাথকে আনতে কে যেতে পারবে?”। আমার পাশে গা ঘেঁষে বসে থাকা সুবীরদা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন “সুজন, তুমি যাবে আমার সাথে? তুমি আমার সাথে এলে আমি যেতে পারি। আমার আবার অপরিচিত লোকদের ঘামের গন্ধ আর অযথা বকবকানি ভালো লাগেনা”। সুবীরদা খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কথা কম বলেন। কথা বললে ফিসফিস করেই বলেন যাতে সাত কান হয়ে বৌদির কানে না পৌঁছায়। আমি তো এক পায়ে খাড়া। না আছে সংসার, না আছে রান্নাবান্নার ঝামেলা। অন্যের গাড়িতে চেপে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো আর অন্যের বাড়ীতে বিনামূল্যে উদরপুরন করা আমার ছুটির দিনের একমাত্র ব্রত। চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। আগে নিজের সেবা তারপর সমাজের কথা। সুতরাং ঠিক হল, পরদিন সকালে কাজলদা যাবে উমাকে আনতে আর দুপুরে সুবীরদা আর আমি যাব সতীনাথকে আনতে। এত সহজে ঠিক হয়ে যাওয়ায় বাকীরা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
পরেরদিন ঠিক বারটা নাগাদ সুবীরদা আমার বাড়িতে হাজির। আমি তৈরিই ছিলাম। দুজনে প্রায় দুঘণ্টার পথ নিঃশব্দে পেরিয়ে বিমানবন্দরে এসে পৌছালাম। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও সতীনাথের দেখা নেই। যেসব যাত্রীরা আসছেন তাদের মধ্যে কোন ভারতীয়কেই দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় পনের মিনিট পর টাই স্যুট পরা ধোপদুরস্ত এক ভারতীয়কে দেখে সুবীরদা বললেন “মনে হচ্ছে এটাই। সুজন যাও জিজ্ঞেস করে এস”। আমি ভদ্রলোকের পথ আটকে বীরের মত জিজ্ঞাসা করলাম “এক্সকিউস মি। আপনি কি সতীনাথ?” ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হয়ে বললেন “না, ধন্যবাদ।” সুবীরদার কাছে ফিরে আসা মাত্রই এক শার্ট প্যান্ট পরা ফর্সা সুন্দরী মহিলা আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন “আচ্ছা, আপনারা কি বাঙ্গালী?” মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলাতেই তিনি বললেন “আমার নাম সতী। আমি কলকাতা থেকে আসছি। আপনাদের কি সলিল দা পাঠিয়েছেন?” সুবীরদা বললেন “হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের সলিলদা পাঠিয়েছেন সতীনাথ বাবুকে নেবার জন্য”। ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন “আরে আমার নাম সতী আর পদবী নাথ। আমার কথাই বলেছেন সলিলদা।”
বিমানবন্দরের বাইরে এসে সুবীরদা আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ছুটলেন পারকিং প্লেস থেকে তাঁর গাড়ী নিয়ে আসতে। গাড়ী নিয়ে আসার পর আমাকে বললেন “সুজন, তুমি পেছনে বস, সতী আমার পাশে সামনে বসুক যাতে ও যেতে যেতে শহরটা দেখতে পায়”। আমি নিশ্চিন্তে পেছনে গিয়ে বসলাম কারণ গাড়ী চালাতে চালাতে সুবীরদার দৃষ্টি সবসময় পথের উপর থাকবে কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ ছিল।
সেদিন রাত্রে নিখিলদার বাড়ীতে “সাংস্কৃতিক” অনুষ্ঠানে উমার সাথে দেখা হল। টাক মাথা, খোচাখোচা দাড়ি মুখে এক শীর্ণকায় মানুষ যেন অরিজোনা প্রদেশের কোন বাদামী ক্যাকটাস। কেউ আলাপ করিয়ে দিতে বললেন তাঁর নাম উমাপ্রসাদ মহান্তি। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গবেষণা করেন। অনেক খুঁজেও কাজলদার দেখা পেলাম না। সলিলদা গম্ভীর হয়ে বললেন “ও ব্যাটা বোধহয় এখন ঘরে বসে মাল খাচ্ছে রে।”
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে। অনিবার্য কারনে উমাপ্রসাদ আর সতীর নাম ছাড়া বাকী সব নাম কাল্পনিক করা হয়েছে)
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মায়ের কদিন : সংঘমিত্র মাকুড়
মা নিজেও ক্লান্ত I অনেকটা পথের ধকল I তবু তীক্ষ দৃষ্টি তে সামনের দিকে চেয়ে আছেন I উঁচু নিচু জোলো জমি ,ঢেউ খেলানো ধান ,কাশ I নীল পাগড়ি পরা লোকের মত তাল গাছ ,আকাশে মেটেতে কালোতে মেঘ I হঠাত্ই বাম হাত দিয়ে ডান হাতের বাজুতে চাপড়ানি I শব্দে বিরক্ত গানু একটু নড়ে উঠল I
"দেখলি নাকি মশু ?"
"শুনলাম I "
"ডেঙ্গু নাকি ?"
এ সময় এদেশে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার ছড়াছড়ি I
বুড়ো মাঝি লগি ঠেলতে ঠেলতে জবাব দিল "ওরে বাবা রে বাবা !তোমার হবার চান্স নাই I "
ছেলে মেয়ে গুলো এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে I দু দিন দু রাতের কষ্ট I পথের অবস্থা কহতব্য না ,ঘাটের অবস্থা বরং ভাল I মা লক্ষ্য করেন এদের গায়ের ওপর থেকে হালকা চাদর সরে গেছে I সবার পরনে তো এক রকম কাপড় চোপড় ঢোলা হাফ প্যান্ট কারো ,কারো তারও খানিক ছোট সংস্করণ ওপরে গেঞ্জির মত কিছু I চাদর ঢেকে দেন I আকাশে অল্প চাঁদ মেঘের চাদরে মুখ ঢাকছে তখন I কালো জল I
গানু র টি শার্টের তলা দিয়ে নধর কান্তি উঁকি মারছে I একেবারে বাপের ধারা পেয়েছে ! এখন তেলে জলে যেন আরো শ্রী বৃদ্ধি হচ্ছে I দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায় I
"হ্যারে ,গানু র নাকি খুব কদর ?খুব মাতামাতি ওকে নিয়ে ?"
বুড়ো মাঝি নৌকা টানতে টানতে উত্তর দেয়
"সত্যি কথা ,তবে কি জানো মাঠাকরুন এ দিগরে সেরকম মাতামাতি শুধু গানু কেন ,হনু কে নিয়েও -এতে কি কিছু হয় মা !"
"মানে ?ওই ত্রেতা যুগের রামের চেলা ?"
মাঝি আঙ্গুল দিয়ে দিক নির্দেশ করে
"তবে আর বলছি কি ,হুই দেখো "
মা ভাল করে ঠাহর করে দেখেন দূরে ডাঙ্গায় পোঁতা দু দুটো লম্বাটে পতাকা I আঁধারে রং বোঝা যায়না I
"তোমার কথা এদের চেয়ে আলাদা ,তুমি হলে আদি মোহিনীমোহন ,কোন শাখা নেই "
মা কিছু বলেন না I
ছেলে মেয়ে গুলো আর আগের মত নাই I কথা শোনেনা I এভাবে নৌকা বিহারে আসা নিয়েও ওদের বিস্তর আপত্তি ছিল I জোরজার করে ধরে আনা I বলেছে এই শেষ বার I শুনছেন কেটি ,লাখু ,সরু ,কারুরই ভাল চলছে না I মায়ের একটি দীর্ঘ শ্বাস পড়ে I
পুরনো কিন্তু বড় সড় ,পাল তোলা নৌকা I বুড়ো মাঝি সামনে বসে I হেঁটো ধুতি ,টাক মাথায় গামছা জড়ানো I নৌকার ভিতর কেমন কেমন গন্ধ I পুরোনো বলে নাকি গলুইয়ের ভেতর জন্তু গুলোর জন্য ,কে জানে I ঘড়ি দেখেন I
"একটু জলদি জলদি বৈঠা চালা I সূর্যোদয় হতে তো আর দেরী নাই বাবা ,পাঁচটা বারো বাজে I "
"টানছি তো মা ঠাকরুন ,প্রায় মেরে এনেছি I বুড়ো বয়সে এত এক্সারসাইজ পোষায় -তুমিই বলো"
"বকিস না ,লোকজন উঠে পড়ার আগেই বঙ্গ দেশে ঢুকতে হবে ,আর আঠারো মিনিট I "
মাঝি গজর গজর করতেই থাকে
"কি যে তোমাদের বাপু বুঝিনা ,সুজ্জিও তোমাদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি ,তাকে বললেই তো একদিন একটু দেরী করে উঠবে !"
মা ভুরু কুঁচকে ,মুখে কিছু বলেন না I
সংসারে সবই নিয়ম মত হয় I কে কার জন্যে থেমে থাকে I প্রতিবছর নিয়ম মত বাপের বাড়ি পাড়ি দেওয়া I এত কষ্ট ,মড়ক ,বন্যা ,ডেঙ্গু ,দাঙ্গা -- তবু সময় হলেই এদের জন্যে মন টা হু হু করে ওঠে I
আর মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই টুপ করে সূর্যদেব উঠে পড়বেন I তার আগেই ছেলে মেয়ে সহ এ দেশের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মাটির মূর্তি হয়ে যেতে হবে I কিন্তু সর্বাগ্রে চাই মেক ওভার I
মা নৌকার পাটাতনে উঠে দাঁড়িয়েছেন I
"এই ওঠ ওঠ তোরা ,লাখু দিদি কে তোল !সব তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নে ,রেডি হবার আর সময় পাবিনে !"
ব্যাজার বদনে ছেলে মেয়েরা ওঠে ,ঢুলু ঢুলু নয়নে ওরা যেন ফ্যান্সিড্রেস পার্টির জন্য তৈরি হচ্ছে I বয়েজ কাট ঢাকা পড়ছে লেয়ার করা চুলে I স্প্যগোটি স্ট্র্যাপএর ওপর উঠছে জরিদার ব্লাউজ I গানু রংচংএ টি শার্ট খুলে গলায় একটা পৈতে ঝোলালো I মা ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছেন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি I অন্ধকার কমে আসছে I পুব দিগন্ত লাল I মায়ের মুখ উদ্ভাসিত I
"কেট ,ধনুক টা তোমার কাঁধে নেই কেন ?,দেখ কোথায় রাখলে I "
গানু হাই তুলছে I সরু চট করে মোবাইল রেখে বীণা তে হাত দেয় I সবাই যে যার পজিশনে I বাহন গুলোও খবর পেয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে ,জেগে উঠেছে I
"শোন বাছারা ,এ কদিন কষ্ট হলেও নো এদিক ওদিক ,নো ওড়া ওড়িI আর হ্যাঁ বছরের এই চারটে দিন মাদার'স ডে মনে করেই তোমরা সব বাধ্য ছেলের মত মৃন্ময় মূর্তি তে ঢুকে পড়বে I আমি বলার সাথে সাথে ,এক .দুই ....."
শেষে একটা কান্ড হলো I শাড়ির খস্ খস্ আর গয়নার রিন্ ঝিনির মাঝে কেট চিত্কার করে ওঠে "মা ! সাম বডি ইস মিসিং ! তোমার সেই লেগ পুলার আংকেল ,হোয়ার ইস হি ?"
একই সাথে সিংহ টাও কেঁউ কেঁউ আওয়াজ করে ওঠে I তাইতো ,পায়ের কাছটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে খেয়ালই করেন নি I নৌকা জল ঠেলে ঢুকে পড়েছে বড়সড় প্যান্ডেলে ,স্তিমিত আলো ,মঞ্চ ফাঁকা I এমন সময় নৌকার গলুই কাঁপিয়ে আওয়াজ আসে
"হুম্ হুম হা -হা -হা -হা -হা !" বার দুই I
সেই পরিচিত গগন বিদারী মহিষাসুর নাদ বটে তবে জলে কিঞ্চিত মিয়ানো I সবাই কেঁপে কেঁপে ওঠে I সিংহ টা ফিক করে হেসে ফেলে I
"তিন বলবেন না গো মা ঠাকরুন ,একটু প্যাকটিস দিচ্ছিলাম ! অত টা পথ নৌকা ঠেলে এলুম ,আবার চার চারটে দিন তো একঠেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে I "
নৌকার বুড়ো মাঝি গোঁফের আঠা টা লাগাতে লাগাতে দেখে নেয় মাথার পরচুলা টা ঠিক ঠাক মত সেট করেছে কিনা I ধুতির ওপর কালো কোমর বন্ধ I শান দেওয়া খড়গ টা তুলে মায়ের পায়ের কাছে আসতে আসতে হেসে বলে
"ভাবছিলে বুড়ো বুঝি এবার পালালো !"
মা লাজুক হাসলেন
"সে ভরসা আমার আছে ,এক মাত্র তোর ওপরেই ."
"উই আর ফিলিং বোর মামা !"
মা বললেন "....তিন !"
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বেন্দাবন দা আর কচুর কচুরি : তনিমা হাজরা
বেন্দাবনদা দরজার এক সাইডে ডেকে আমাকে বল্লে, এ্যাই মণি শোন। তোর কাছে গোলাপি লিপগ্লস আছে রে? একটু দিবি। ঠোটটা ভারি চড়চড় করছে।
আমি কৃত্রিম ঊষ্মা দেখিয়ে বলি, লাগাতে ইচ্ছে হয়েছে লাগাও, অত বাহানাবাজির কি আছে? এই তো সেদিন তুমি লুকিয়ে ফাউন্ডেশন আর ফেস পাউডার চাইলে, আমি কি একবারো মানা করেছি, না কাউকে বলে বেড়িয়েছি। আর তাছাড়া আজকাল শহুরে ষ্টাইলিষ্ট হাল ফ্যাশনের ছেলেরা ওরকম অনেক মুখে হাবিজাবি মাখে, কানে দুল পরে, বড় বড় চুল রাখে,এ তোমার রাইমণিপুর নয়, এটা কোলকাতা।
বেন্দাবনদার পানখেকো বত্রিশ পাটি কৃতজ্ঞতায় এক্কেবারে বিগলিত। তার ফজলি আমের বা আরো নিখুঁতভাবে বর্ণনা দিলে যাকে বলে বাটার বারো নম্বর জুতোর মতো মুখচন্দ্রিমায় ঈষৎ রক্তিমাভা দেখা যায়। তদুপরি কৃষ্ণভক্ত বলে তার গলায় কন্ঠি ও নাকে রসকলি আঁকা থাকে।
তাই তিনি কিঞ্চিত নারীস্বভাবা আর সর্বভূতে তাঁর কেষ্ট দর্শন ঘটে থাকে।
বেন্দাবনদা আসলে আমাদের মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়ির ভাগচাষী। বছরের কিছু বিশেষ বিশেষ সময়ে সে গ্রামের বাড়ি থেকে আমাদের জন্য খেজুরগুড়, কুসুম বীজ আর ছোলাবাদাম দেওয়া মুড়ি, নারকেল ইত্যাদি নিয়ে আসে। আর আনে রাইমণির হাটের সুন্দর নরম গামছা আর তাল লবাত।
অফিসের কাজের চাপে বাবার বছরে এক আধবার ছাড়া আর গ্রামের বাড়িতে যাওয়াই হয় না আজকাল। আগে তবু দুতিন মাস অন্তর একবার করে যেত। দাদু মারা যাবার পর ঠাকুমাও এখন আমাদের সাথে থাকেন তাই দেশে যাবার টান ও ক্ষীয়মাণ। কিন্তু বেন্দাবনদা তার ভালবাসা ভরা পুঁটুলি নিয়ে ঠিক এসে হাজির আর সে আমাদের বড় প্রিয় একজন মানুষ।
বন্ধুদের সাথে চায়নাটাউনে খেতে যাচ্ছিলাম। বেন্দাবনদা বায়না ধরলো সেও যাবে আর এট্টু কোলকেতা ঘুরবে। আমার বন্ধুদের অবশ্য তাকে নিতে আপত্তি নেই। সে সবারি চেনা আর প্রিয়।
দোকানে বসে বেন্দাবনদার জন্য ভেজ নুডলস আর আমাদের সবার পর্ক মোমো অর্ডার দিয়েছি কারণ কেষ্টভক্ত বেন্দাবনদা চিরশাকাহারী।
দুচামচ নুডলস মুখে তোলার পর ই বেন্দাবনদা বলে ওঠে, দূর দূর এই মাগীগুলান মোটেও ভালো বানায় নাই। এ তো হলুদ প্যাকেটে আমাদের গাঁয়ের গণশার গুমটিতেও পাওয়া যায়, টিভিতে সেবছর শুনেছিলুম ওর মশলাতে নাকি কি বিষফিষ মেশানো থাকে। ও আমি খাবনি বাপু। দেকি, দেকি, ওই পুঁটুলি পুঁটুলি তোরা কি খাচ্ছিস?? বলেই খপাৎ করে একখানি পর্কমোমো তুলে কিছু বাধা দেবার আগেই সটান মুখে। তাপ্পর তার পরম তৃপ্তিমাখা মুখখানি এক্কেবারে দেকবার মতো। আহা বেচারীর তৃণভোজী জিভে শুয়োরের বাচ্চার মজ্জা মজেগলে একাকার।
আহা কি সুখাদ্য রে এটা, কি নাম রে এর? দে, দে, আমি এটাই খাব।
আমি অক্লেশে নিজের প্লেট তাকে দিয়ে বলি, সেদ্দ কচুরি গো বেন্দাবন দা, খাও খাও, এই ঝাল ঝাল চাটনি মাখিয়ে খাও, এক্কেবারে সরেস গাঁঠিকচুর পুর করে বানানো।
বেন্দাবনদার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে, একবার ক্লাস নাইনে বর্ণালী মিস
ভাবসম্প্রসারণ লিখতে দিয়েছিলেন,
রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু।
তার উত্তরে আমি লিখেছিলাম, যারা নিজেদের ওপর চালাক বা রতন বলে মনে করে সেই রতনেরা অর্থাৎ ঘোড়েল লোকেরা যতই অন্য ওপর চালাক বা ঘোড়েল লোকেদের সহজে চিনে ফেলুক সমাজের ধূর্ততম অর্থাৎ শুয়োরের ছানাদের অত ইজিলি কচু পোড়া আইডেন্টিফাই করা যায়। তারা তাই দেশের এত তেরটা বাজাচ্ছে অনায়াসে।
আমার এই বেখাপ্পা, অবান্তর উত্তর লেখার জন্য সেদিন ক্লাসে বর্ণালিদির কাছে কানমলা খেয়েছিলাম।
কিন্তু আজ চাক্ষুষ দেখলাম বেন্দাবনদার তৃণভোজী রসনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ব্যাটা শুয়োর কেমন কচুসেজে দিব্যি পাকস্থলীতে ইমপোর্ট হয়ে যাচ্ছে আর বেন্দাবনদার ব্রেন দেশের পাব্লিকের মতো অকেজো বসে আছে, কিছুতেই ফাঁকিটা আইডেন্টিফাই করতেই পারছে না।
****************************************
প্রবন্ধ
শেষ সাহেব : সুব্রত চৌধুরী
বাঁকুড়া মানে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যাকে অনেকে বলেন ভারতীয় সাংবাদিকতার পিতৃপুরুষ। বাঁকুড়া মানে রামকিংকর বেজ, শুধুমাত্র সাঁওতাল পরিবারের জন্যই যাকে চিরকাল মনে রাখা যায়, অন্যসব ভাস্কর্য্যগুলোকে না হয় হিসেবেই ধরলাম না। বাঁকুড়া মানে টেরাকোটার হাতিঘোড়া, যে ঘোড়া ভারত সরকারের ক্ষুদ্রশিল্প দপ্তরের প্রতীকচিহ্ন।
বাঁকুড়া জেলার নামের সাথে জড়িয়ে আছে শুশুনিয়ার শিল্পীদের পাথর কেটে তৈরী শিল্পকর্ম কিংবা বিষ্ণুপুরের শাঁখের গয়না। বাঁকুড়া জেলার সাথে জড়িয়ে আছে বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়িও। খাদ্যরসিকরা বাঁকুড়া বলতে বোঝেন চিত্তরঞ্জন সন্দেশ আর রস টুপটুপে নিখুতি, যা অন্য কোথাও পাবেন না। ভ্রমনবিলাসীরা ছুটে আসেন বিষ্ণুপুর, মুকুটমনিপুর, ঝিলিমিলি কি শুশুনিয়ার টানে।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন বাঁকুড়া নামটা শুনলে লোকে বলত, ওহ ক্রীশ্চান কলেজ। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হওয়া ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ, যা নাম বদলে হয় ক্রীশ্চিয়ান বা খ্রীষ্টান কলেজ তা এক সময় ছিল বাঁকুড়ার পরিচয়। সাহেবদের প্রতিষ্ঠিত এই কলেজটার ছাত্রের দল চিরকালই গ্রামবাংলা থেকে এলেও এই কলেজ বা তার ১০০ বিঘার বিরাট ক্যাম্পাসটা দীর্ঘকাল সাহেবদের সুশৃঙখল পরিচালনায় চালিত হয়েছে। অর্ধশতাব্দী আগে প্রথম যখন এই ক্যাম্পাসটা দেখি তখন সাহেবদের যুগ শেষ হয়ে গেছে।মিচেল, ব্রাউন সাহেবদের কলেজটার প্রিন্সিপাল তখন রবীন্দ্রনাথ দাস। বেশ স্থুলকায় ভদ্রলোক, উনি পরে বাইবেল সোসাইটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কলেজে অধ্যাপকদের মধ্যেও কোন সাহেব ছিলেন না। সাহেব অধ্যাপকদের মধ্যে ব্লো সাহেবেরই নাম শুনেছি, উনি ফিজিক্সের শিক্ষক ছিলেন। ওনাকে নিয়ে একটা ছড়া শুনেছিলাম: ব্লো বাজায় ব্লো পাইপ, বোল হরি বোল।
তবে তখনো ওই ক্যাম্পাসে এক সাহেবকে দেখেছি, তিনি রেভারেন্ড বন্ড। চার্চের পক্ষ থেকে ছিলেন ওই ক্যাম্পাসের দায়িত্বে। মিশন স্কুলে পড়ার সময় সাহেবকে দেখতাম প্রায়ই স্কুলে আসতে। আমাদের স্কুল স্পোর্টসের পুরস্কার দিতেও আসতেন। পরের দিন ছুটির জন্য নিপাট বাঙলায় ওনাকেই আবেদন করতাম। সে সময়ে পুরো ক্যাম্পাসটা খন্ডবিখন্ড হয় নি। প্রচুর সাল সেগুন মেহগনি গাছ ছিল। ভিতরের রাস্তাগুলো ছিল মোরাম বেছানো।
বন্ড সাহেব ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশে ফিরে যান। তারপরেই মিশন স্কুলের হেডমাস্টারের বাসস্থান কোন এক অফিসকে ভাড়া দেওয়া হয়। এখন হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। তারপরেই দেখলাম কম্পাউন্ডের ভিতরে দোকানঘর তৈরী করে ভাড়া দেওয়া হল, নাকি বিক্রি হল! পরের দিকে ক্যাম্পাসের দামী গাছগুলোও গায়েব হয়ে গেল। কোনদিন হয়তো শুনব যে কলেজ ট্যাংকটা মাছ চাষের জন্য কারোকে লিজ দেওয়া হয়েছে! আজ অনেক বছর পর গিয়ে ওই খন্ডবিখন্ড কলেজ ক্যাম্পাস দেখে বারবার বন্ডসাহেবকে মনে পড়ে। সাহেব, তোমাদের নমস্কার।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
স্মৃতিতে ভাদুপূজা : জয়শ্রী কুনডু পাল
আকাশে যখন সাদা মেঘেরা তুলোর রাশি ভাসিয়ে দেয়, মেঘ-রৌদ্রের চলে লুকোচুরি খেলা, মাঠকে মাঠ কাশফুলে ভরে যায়। খরা-জীর্ণ নদী গুলোও বর্ষার জলে একটু লাবণ্যবতী হয়, বাগানে শিউলি গাছটাও জানান দেয় শরৎ আসছে! পুজোর সানাই বাজলো বলে!
ঠিক তার আগেই আমাদের ছেলেবেলায় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামে গ্রামে শুরু হত ভাদুপূজা। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতি। রঙীন কাগজে লেখা ভাদুরগানের বই ও বাজারে প্রচলিত ছিল। সারামাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় ভাদুরগান গেয়ে পূজা করা হত ।
তারপর ভাদ্র মাসের শেষরাত্রে হত জাকজমকে পুজো। কথিত আছে কাশীপুরের রাজার মেয়ে ভাদু বিয়ের রাত্রে কনে-সাজে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই থেকে ভাদুপূজা গ্রামীণ সংস্কৃতিতে রয়ে গেছে। গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েরা ভাদুর মাটির প্রতিমা নিয়ে আসত ভাদ্র মাসের যে কোনো দিনে এবং প্রতিমা আনার পর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় ফুল-মিষ্টি সহযোগে চলত ভাদুর বন্দনা গান। আমার এক দিদি সেও তখন খুব ছোটো। সুর দিয়ে গাইত ভাদুরগান। এরকম একটি গান- 'মাসি বাঁকুড়াতে তোদের জামাই নিয়ে গেছল রথ দেখাতে।' এ গানের অর্থ তেমন না বুঝেই গাইতো। আর সেই গান শুনে বাড়ির বড়ো রা খুব হাসতেন। আর মজা করে বলতেন 'আমাদের জামাই এর রথ দেখানোর গানটা শোনা'।
ভাদুপূজার শেষ রাতকে বলা হত জাগরণের রাত। পাড়ার, ঘরের বউদের বাক্সে তোলা রঙীন শাড়ি জোগাড় করে মন্ডপ সাজিয়ে তার মধ্যে জল-চৌকিতে প্রতিমা বসিয়ে ফুল- লতা- পাতায় সাজানো হত। নানাবিধ ফল মিষ্টি নৈবেদ্য হিসাবে দেওয়া হত। তখন মফস্বলে মিষ্টির দোকানে থালার সাইজে জিলিপি ও খাজা বানানো হত ভাদুপূজা উপলক্ষে। সেই সব মিষ্টি নিয়ে আসা হত ভাদুপূজার জন্যে। এখন যেমন শহরাঞ্চলে থিমের পুজোর প্রতিযোগিতা হয় তখন তেমনি গ্রামে ভাদুপূজার ও প্রতিযোগিতা হত। রাত্রে লুচি, হালুয়া, ঘুঘনী ইত্যাদির ফিস্ট হত।সারারাত জাগরণের পর ভোরবেলায় গান গাইতে গাইতে পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন। পাড়ার ছেলেরা বিসর্জনের সময় পুকুরে নেমে জলে ডুব দিয়ে প্রতিমার মুখ তুলে আনত। আমার দাদা একবার ওই মুখ তুলে এনেছিল। সুন্দর ভাদু প্রতিমার ছিন্ন মুখ দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি লুকিয়ে খুব কেঁদেছিলাম।
এখন গ্রামের সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। সেখানেও এখন শহুরে আবহাওয়া। কেউ কারোর বাড়ি কারণে- অকারণে যায় না। চাঁদা তুলে পাড়ার মেয়েরা ভাদু-টুসুর পুজোও করে না। কালের ঝাপ্টায় মুছে গেলো বাঁকুড়া পুরুলিয়ার নিজস্ব সংস্কৃতিটা ।ভাদ্র মাস এলে এখনও আমি মনে মনে গ্রামের বাড়িতে ভাদুপূজার দিনটিতে ফিরে যাই। হায়! একটি বার যদি সেই দিনটা ফিরে পেতাম!
'রোজ তো কত ঘটে যাহা তাহা, এমন কেন সত্যি হয় না আহা!'
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দূর্গাপূজোর ভোগ ও উপাচার : চন্দ্রিমা চ্যাটার্জী
বাঙালীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হল দূর্গাপুজো।এখন অবশ্য বাঙালী বলে কিছু নেই।সব রাজ্যেই সবাই এই পুজো নিয়ে মেতে ওঠে।এক একটা এলাকায় কত বড় বড় পুজো হয়।প্যান্ডেল , জাঁকজমক , কত লোকজনের আনাগোনা সব মিলিয়ে মিশিয়ে অন্যরকম একটা আড়ম্বর। এর সাথে আছে বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের বাড়ির পুজো।
বাড়ির পুজোর কিন্তু আলাদা একটা আনন্দ আছে। আমি অনেক জায়গায় অনেক পুজো দেখেছি।কিন্তু যখন আমি দেশের বাড়ি যাই প্রতিবছর মা'কে যেন নতুন রূপে পাই।গ্রামের বাড়িতে প্রায় দুশো বছর ধরে আমাদের পুজো হয়ে আসছে।পিতৃপক্ষ অবসানের পর দেবীপক্ষ শুরু হবার সাথে সাথে মায়ের বেদীতে মাটি দেওয়া শুরু হয়ে যায়।আমাদের বাড়িতে আবার রথের সময় মাকে প্রথম মাটি দেওয়া হ য়ে থাকে।অন্নভোগ দিয়ে আমাদের মায়ের পুজো হয়।মহালয়ার পরের দিন বাড়ির বৌরা (এয়োরা) সবাই মিলে স্নান সেরে একসাথে ঢেঁকিতে চাল কোটাতে নিয়ে যাই।কোটানোর পর সেই চাল আর আঁখের গুড় দিয়ে গুড়পিঠে তৈরি হয়।খই দিয়ে মুড়কি আর নারকেল দিয়ে নাড়ু বানানো হয়।আজ প্রায় দুশো বছর ধরে বংশ পপরম্পরায় এই গুলো দিয়েই মাকে শীতল দেওয়া হয়।পুরোহিত রাও বংশানুক্রমিক ভাবে আমাদের বাড়িতে পুজো করে আসছেন।ওনারা বলেন এগুলো ছাড়া মায়ের পুজো অসম্পুর্ন।
এত গেল শীতলের কথা।সপ্তমী অষ্টমী নবমী এই তিন দিন অন্নভোগ দেওয়া হয় মাকে।মহালয়ার একদিন কি দুদিন বাদেই বিউলির ডাল ভিজিয়ে রেখে বড়ি দেবার প্রস্তুতি শুরু হ য়ে যায়। স্নান সেরে সবাই মিলে শুদ্ধ ভাবে শিল নোড়া দিয়ে একসাথে বসে ডাল বাটি। কিন্ত খুব সাবধানে বাটার সময় কথা বলার উপায় নেই। তারপর বড় বড় বগি থালায় তেল মাখিয়ে বড়ি দিয়ে সেগুলো শুকনো করে কাঁচের জারে তুলে রাখা হয়। শুক্তো , পাঁচ রকমের ভাজা, মুগের ডাল, তরকারী , গোবিন্দভোগ চালের ভাত , পায়েস, চাটনি -- এইসব দিয়ে মাকে অন্নভোগ দেওয়া হয়।
আবার অষ্টমী র দিন সন্ধিপুজোর সময় গাওয়া ঘীয়ের লুচি সুজির হালুয়া আট রকমের ফল আর মিষ্টি দেওয়া হয়। বলীর আগে যখন মায়ের হাত থেকে আশীর্বাদী ফুল পড়ে তখন সারা শরীরে যেন একটা শিহরণ দিয়ে ওঠে।মনে মনে অনেক নিশ্চিন্ত লাগে কোন খুঁত হয়নি , মা হয়ত প্রসন্ন হয়েছেন আমাদের পুজোয়।এমনি করে কিভাবে যে চারটে দিন পেরিয়ে যায় বোঝাই যায়না।
দশমীর দিন সিঁদুর খেলার পর মায়ের যখন বিসর্জন হয়ে যায় তখন মন টা কেমন যেন ভার হয়ে ওঠে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।তবু মনের কোনে একটা ই আশা , আসছে বছর আবার হবে। সকল দুঃখকে পাথেয় করে আগামী বছরের অপেক্ষায় বসে থাকি আবার নতুন করে পাবো বলে।
****************************************
গল্প
জীবন যে রকম : দোলা সেন
• যখন কুড়ি –
ছিপছিপে মিষ্টি চেহারার তনয়া কলেজের করিডোর দিয়ে হাঁটছিল। হয়ত অন্যমনস্কতার জন্যই হোঁচটটা খেল, আর হাতের বইগুলো ছিটকে পড়ল চতুর্দিকে। কোথায় ছিল নিলয়, দৌড়ে এসে বইগুলি কুড়িয়ে তনয়ার হাতে তুলে দিল। বারবার জানতে চাইল কোথায় লেগেছে। পারলে পা কোলে তুলে নিয়ে দেখে নখে চোট লেগেছে কিনা! প্রেমিকের এ জাতীয় পাগলামিতে তনয়া সুখের লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে উঠল।
• যখন পঁচিশ –
বিয়ের পর বাড়ীতে নানা অতিথির সমাগম হয়েছে। তনয়া ভারী ব্যস্ত হয়ে চা-জলখাবার বানাচ্ছে। তাড়াহুড়োর চোটে হাত থেকে একটা প্লেট পড়ে খানখান। নিলয় উদ্বিগ্নভাবে দৌড়ে ঢুকল রান্নাঘরে, - ‘তোমার লাগেনি তো?’ বয়স্কা আত্মীয়াটি মুখ বাঁকালেন, - ‘যত্তোসব আদিখ্যেতা!’
• যখন তিরিশ –
দৃশ্যপট আগের মতই। শুধু এবার পাশের ঘর থেকে নিলয় চেঁচিয়ে উঠল, - ‘পুপুল পড়ে গেল নাকি?’ ছয় মাসের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে হাসল তনয়া, - ‘Priority টা পাল্টে যাচ্ছে রে পাপাইসোনা!’
• চল্লিশের পর –
প্রোমোশন আর কাজের চাপ বেড়েছে সমানুপাতিক হারে, আর ব্যাস্তানুপাতে কমেছে নিলয়ের সময় এবং ধৈর্য। কিন্তু তনয়ার বেখেয়ালে দ্রুত চলাটা একইরকম আছে। সেদিন সোফার কোণায় ঠুকে গিয়ে পায়ের নখ উড়ে গেল। ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বিরক্ত গলায় ধমকে উঠল নিলয়, - ‘বয়েস হচ্ছে, একটু দেখে চলতে পার না? বরফ থাকলে একটু ঘষে নাও।’ রক্ত জমা কলাগাছের মত ফুলো আঙুল, না কি বুকের ভিতর কিছু হারিয়ে ফেলার দুঃখ – কার যন্ত্রণায় বোঝা গেল না – তনয়ার বুকের গহনে নোনাজলের শ্রাবণ নামল।
• এখন পঁয়ষট্টি –
তনয়া আজকাল ব্যথা লুকোতে শিখে গেছে। সকালে খাট থেকে নামার সময় যে খিঁচটা লেগেছিল,সেটা নিয়ে টেনেটুনে দুদিন চললেও তিনদিনের দিন বিছানা থেকে নামতেই পারল না। তারপর যন্ত্রণা-ডাক্তার-নার্সিংহোম-স্ লিপ ডিস্কের হুমকি পার করে, বাড়ী ফিরে আবার যখন বিছানায় একা, নিলয় ওর হাত ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, - ‘আগে বলোনি কেন? আর কক্ষণো এমন করো না। তোমার কিছু হলে আমি.....’
তনয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে এক’দিনের দুশ্চিন্তা আর ছুটোছুটিতে শুকনো হয়ে যাওয়া নিলয়ের মুখখানা। ধীরে খুব ধীরে উচ্চারণ করে –
‘রাতের সব তারারাই তাহলে দিনের গভীরে লুকিয়ে থাকে?’
নিলয় সেই চিরকেলে ‘বছর কুড়ি’-র মাথার চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে হাসে। বলে, - ‘পাগলী!’
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আউট অফ সিলেবাস : চিন্ময় সিনহা
রিসেপসনে একটু যেন আজ বেশীই হট্টগোল। সাধারণতঃ সকাল দশটার পর ভিড় খুব একটা হয় না। পেশেন্ট যারা সরাসরি রক্তের নমুনা দিতে আসে তারা নটার মধ্যেই এসে যায়। আর আজকাল রেওয়াজ হয়েছে বাড়ি থেকে সরাসরি নমুনা সংগ্রহ করে রিপোর্ট পৌছে দেওয়ার। তবে তার জন্য দুরত্ব বিশেষে অর্থদণ্ডের রূপভেদ আছে। যারা সেটুকু টাকা সঞ্চয় করতে চায় তারা সরাসরি এসে নমুনা দিয়ে নিজেরাই সন্ধ্যের সময় রিপোর্ট নিয়ে যায়।
সেই জন্য দশটা নাগাদ এই চিৎকার চেঁচামেঁচিটা একটু হলেও কানে লাগল এবি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিক অলকবরণ তলাপাত্রর। আড়ালে আবডালে তাকে রক্তচোষণ মশাপাত্র বলেও অনেকেই ডেকে থাকেন।
আজকাল এই সেন্টার চালিয়ে ব্যবসায় লাভ করা বেশ কঠিন কাজ। তবে এবিডির কলকাঠিরা এ ব্যাপারে বেশ দড়। ডাক্তার ধরার জাল চারিদিকে যেমন ছড়ান তাদের হিসেবে কিতেবও মাস গেলে ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেন। এই সততার জন্য অলকবরণের বিশেষ সুনাম আছে। পাশাপাশি অনেকগুলি সেন্টার সবসময় তার পেছনে বাঁশ দেওয়ার জন্য তৈরী। কখন কে জল না হলে তেল নমুনা হিসেবে জমা দেয় জব্দ করার জন্য। তারপর খবরের কাগজ আর টিভিওলারা তো হাঁ করে বসেই আছে। পান থেকে চুন খসলেই সান্ধ্য বৈঠকের কিচিরমিচিরের পশরা।
সবকিছু সামলাতে একগাদা পয়সা দিয়ে কয়েকজন পরামর্শদাতাদের পুষছেন অলকবরণ। ডাক্তারবাবুদের আর সময় কোথায়। এখন আবার সব নূতন নিয়ম। আগে একজন প্যাথলজিষ্টে কাজ চলে যেত। এখন প্রত্যেক বিভাগের জন্য একেকজন করে স্পেশালিষ্ট চাই। তাছাড়া সর্বসময়ের জন্য ডাক্তারবাবুও অপ্রতুল। আর পুরোসময়ের জন্য পেলেও তাদের মাইনে দিতে গেলে ভিক্ষে করতে হয়। অলকবরণ নিজে সরকারি কলেজ পাশ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট। আরেকজন সিনিয়র টেকশিয়ান আর কয়েকটা জুনিয়ার নিয়ে সেন্টার চলে যায়।
ছেলে এখন ক্লাস নাইন। আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই ব্যাবসায় তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। রমলা অনেকবার বলেছে এটা বিক্রি করে দিতে কিন্তু অলকবরণের বড় মায়া আর দুর্বলতা এই সেন্টারটি ঘিরে। তিলতিল করে সারাজীবনের পরিশ্রমে এটাকে গড়েছে। এরই আয়ে ছেলেমানুষ সংসার চালানো আর রমলা সুন্দরীকে নিয়ে এদিকসেদিক বেড়ান গয়না গড়িয়ে দেওয়া সবই একহাতে সামলেছে। তবে শরীর আজ কাল একটু বেতালা হয়ে পড়ছে মাঝেমাঝে।
ইন্টারকমে রিসেপশনের মঞ্জরীকে ধরে।
"কি ব্যাপার এতো হইচই কেন?"
- স্যার একজন পেশেন্টের বাড়ির লোক এসে ঝামেলা করছে। রিপোর্ট নাকি ভুল হয়েছে। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
সেন্টারে লোকাল যারা রেগুলার দীর্ঘদিন ধরে আসে তাদের প্রত্যেককেই অলকবরণ চেনে। আর তার মুখমিষ্ট ব্যবহারের জন্য ছোটখাট অনেক ভূলত্রুটি ক্ষমা হয়ে যায়।
পরীক্ষাগারে জিরো এরার বা শুণ্য ত্রুটি কে ছুঁতে চাওয়া আর ভগবানকে ছোঁয়া একই ব্যাপার। তাকে তুমি মনে প্রাণে অনুভব করতে পার খুব কাছাকাছি পৌছতে পার কিন্তু কখনই ছুঁতে পারবে না।
রিসেপশনে মঞ্জরী নুতন এসেছে। আসলে এই ভুল ত্রুটি গুলো সাধারণতঃ তিন প্রকার। প্রিঅ্যনালিটিক্যাল, অ্যানালিটিক্যাল আর পোষ্টঅ্যনালিটিক্যাল। ভুলক্রুটি হলেই বলির ছাগল খোঁজা শুরু হয় আর তখন কাওকেই যদি না পাওয়া যায় তাহলে দোষটা রিয়েেজেন্ট তৈরী সংস্থা বা অ্যানালাইজার প্রস্তুতকারী সংস্থার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই রেওয়াজ। তবুও রিসেপশন আর জুনিয়র টেকনিশিয়ানরা বেশ চাপের মধ্যেই থাকে।
রিসেপশনে যারা থাকে তাদের রিপোর্ট টাইপ করার দায়িত্বও থাকে। আজকাল সব সফ্টওয়ারের মাধ্যমে হলেও টেষ্টের রেজাল্ট আপলোড করতেই হয়। আর উধোর ঘাড়ে বুধোর টা প্রায়ই চাপে।
অলকবরণ নিজেই সমস্ত রিপোর্ট টাইপের সঙ্গে টেষ্টের রেজিষ্টার খাতা আবার তার সঙ্গে অ্যনালাইজার মিলিয়ে দেখে নেয়। একেকটি রিপোর্টপ্যাড ছাপাতে দেড় টাকার কাছাকাছি খরচা। সুতরাং দৈনিক ছাপার ভুলের কারণে বা প্রিন্টিং যন্ত্রের কারণে পনের কুড়িটি পাতা নষ্ট মানে বছরে প্রায় দশ বার হাজার টাকার লোকসান। অলকবরণ প্রতিটি পাইপয়সা হিসেবে করে পদক্ষেপ করেন।
আগেরজন অনেকগুলি ভুল করায় তিরষ্কৃত হয়েছিল। তাই লজ্জায় কাজে আসা বন্ধ করেছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রেস্টিজ বোধটা খুব বেশী। বাড়িতে খাবার যোগান আছে। কাজ কম আর কাজের জায়গায় মোবাইলবাজি বেশী। মন সবসময় উড়ুউুড়ু। তা মানুষের জীবনের প্রশ্ন যেখানে জড়িত সেখানে এতো চঞ্চলমতি হলে চলে!
মঞ্জরী একটু সিনিয়ার। তাই এবার যখন মঞ্জরীকে নিয়োগ করে তখন বলে কয়ে নিয়েছিল যে টাইপিং এরার কিন্তু একদম নয়। তবে মেয়েটা একটু গম্ভীর। রিশেপসনে আজকাল একটু স্মার্ট হাসিখুসী ললনা না হলে পেশেন্ট সামলানো বেশ কঠিন। অরণ্যা টিকে গেছে বলেই রক্ষে না হলে বেশ মুশকিলে পড়তে হত অলকবরণকে।
"আচ্ছা আমি আসছি।"
রিসেপসনের সামনে দাঁড়িয়ে সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ জনার্দনবাবু। দীর্ঘদিন স্কুলে জীবন বিজ্ঞান পড়িয়ে এখন নিশ্চিন্ত অবসর। প্রত্যেক মাসে নিয়ম করে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করান আর তিন মাসে একবার এইচ বি এওয়ান সি। ওনার অখণ্ড অবসরের শান্ত পুষ্করিনীতে আবার কে ঢিল মারল আর কতটা ঢেউ উঠেছে দেখা যাক।
"নমস্কার স্যার! কি ব্যপার।"
-"আচ্ছা তুমি বাবা এই রিপোর্টটা দেখেছ। এটাতো মনে হচ্ছে ঠিক হয়নি। আমি তো আর তোমার বিরুদ্ধে কনজিউমার কোর্টে যেতে পারিনা।"
"আচ্ছা চলুন আমার ঘরে বসে কথা বলি আর তার সঙ্গে এক কাপ চা খাওয়াও যাবে।"
জনার্দন বাবুুর এক মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছে তা প্রায় বছর দশেক হল। একনাতি বিয়ের প্রায় সাত বছর পর জন্ম। জামাই শমীক অলকবরণের বন্ধু স্থানীয়।
বিয়ের প্রায় একবছর পর শমীকের বাইক দুর্ঘটনা হয় আর তারপর প্রায় ছমাস শয্যাশায়ী ছিল।
"বলুন কি ব্যাপার!"
"দেখ বাবা আমার নাতির ব্লাডগ্রুপের রিপোর্ট। এটা কি করে হয়। আমি "ও" পজিটিভ আমার স্ত্রী "ও"পজিটিভ তা আমার মেয়েও "ও"পজিটিভ। জামাইয়ের অ্যাক্সিড্যান্টের সময় আমি ব্লাড দিয়েছি জামাইকে। ওরও "ও"পজিটিভ। তাহলে নাতির রিপোর্ট কি করে "বি" পজিটিভ হয়! "
ততক্ষণে চা এসে গেছে।
অলকবরণ একটি দীর্ঘশ্বাষ ফেলে প্রশান্ত মুখে বলে
"নিন চা খেয়ে নিন। তারপর চলুন আমরা দুজনের মিলে ল্যাবে গিয়ে টেষ্টটা আরেকবার করে দেখি।"
ইন্টারকমে মঞ্জরীকে টেষ্ট রেজিষ্টারটা নিয়ে আসতে বলে।
"তা আপনার নাতির কোন ক্লাস?"
-"এই তো এবছরই স্কুলে ভর্ত্তি হয়েছে। ব্লাড গ্রুপের রিপোর্ট জমা করতে হবে।
-তারপর আইকার্ড তৈরী হবে। আজকাল অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার। তোমরা তো পাঁচটাকা মাইনেও ইস্কুলে দাওনি আর এখন পেট থেকে পড়েই স্কুল, আর পাঁচ হাজার টাকা স্কুলের ফি নিয়েও বলে তারা নাকি খুব কম নিচ্ছে। তা যে যুগের যা নিয়ম। তা বাবা তোমরা ইংরাজি স্কুলে না পড়ে কি অশিক্ষিত রয়ে গেছ!"
টেষ্ট রেজিষ্টার নিয়ে মঞ্জরী আসতেই তাকে আবার নিচে চলে যেতে বলে।
না কোন ভুল নেই। তার চেক করার টিক মারা আছে। তারমানে পোষ্টঅ্যানালিটিক্যাল এরার হয়নি।
কালকের আটচল্লিশ নাম্বার ব্লাড স্যাম্পল বাড়িতে থেকে টেনে এসেছে ব্লিডার বেণুগোপাল।
ইন্টার কমে নির্দেশ পেয়ে বেণুগোপাল এখানে হাজির।
"কি রে স্যারের বাড়ির ব্লাড তুই টেনেছিলি।"
- "হ্যাঁ কেন কি হয়েছে? স্যার বাচ্চাটা খুব বিচ্ছু! ব্লাড নিলাম তখন মায়ের পাশে বসে সামান্য একটু কাঁদল। আমি ব্লাডটিউবটায় লেবেল লাগাচ্ছি খপ করে কাঁধটায় কামড়ে দিল। কাঁধটা জ্বালা করছিল তাই ওখান থেকে স্যাম্পেল নিয়ে সোজা সেন্টারে এসে জমা দিয়েছি। আর কোথাও যায় নি।"
"আহ্! বাচ্চারা একটু বিচ্ছু হয়। তুই ওকে ব্যথা দিয়েছিস তাই প্রতিশোধ নিয়েছে। এবার গেলে টফি দিয়ে আসবি"
এগুলো অলকবরণের মার্কেটিং স্ট্র্যটেজি। তবে নিশ্চিন্ত হল প্রিঅ্যানালিটিক্যাল কোন এরার হয়নি।
"চলুন স্যার ল্যাবে। আমরা আরেকবার টেষ্ট টা করে দেখি।"
এত সকাল ল্যাবে কোনও টেকনিশিয়ান আসে না। কাজ শুরু হয় দুপুর থেকে।
ফ্রিজ থেকে কালকের স্যাম্পল ট্রে বের করে স্যাম্পেলটা তুলে নেয়। দুটো কোম্পানির রিএজেন্ট বের করে নিয়ে আসে। একটা শীতল অনুভব। দুই হাতের তেলোতে ঘষে একটু গরম নেয় রিএজেন্ট গুলো আর স্যাম্পলটা। দুটো স্লাইডে তিনটে তিনটে ড্রপ তৈরী করে রিএজেন্ট একড্রপ করে দেয়।
স্যার আপনি পড়িয়েছিলেন এগুলো আসলে অ্যন্টিজেন অ্যন্টিবডি বিক্রিয়া।
এই দেখুন দুটো স্লাইডেই হলদে মতো "বি"গুলো আর জলের মতো "ডি" গুলো লাল লাল ছানার মতো কেটে গেছে। আর এই নীল রঙের "এ"গুলো কাটেনি।
রেজাল্ট একদম ঠিক আছে "বি" পজিটিভ। আপনি ব্লাডটা নিয়ে যেতে পারেন অন্য যে কোন ল্যবে পরীক্ষা করিয়ে নিন।
-"আসলে কি জান এই নাতি আমার মেয়ের অনেক পুজো আর্চার ফল। কত সাধু সন্নাসী বাবার আখড়ায় গেছে। কত টাকা প্রনামী কত মন্দিরে মানত কিছুই বাদ দেয় নি। গুরুজী যা বলেছে তাই করেছি। অনেক বেশী বয়সের সন্তান। তাই চোখে হারায়।"
"আসলে স্যার আজকালকার সাধূ বাবাজীদের তন্ত্রমন্ত্র কবজ বশীকরণ যন্ত্রে খুব জোর তাই তাদের ওষুধে সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে জিনগত পরিবর্ত্তনও করে ফেলছে। সব বাছাই করা।"
"হবে হয়তো।" বিড়বিড় করতে করতে দরজার দিকে হাঁটা দেয়।
কোন অ্যানালিটিক্যাল এরার তাহলে নেই।
ব্যপারটা অতিসরলিকরণ করলেও অলকবরণ পিছিয়ে যায় আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের ঘটনায়। শমীক অ্যকসিডেন্টের পর রেগুলার চেকআপ করাতে আসলেও তাদের সন্তান না হওয়ার কারণ নিয়ে কোন আলোচনা আগে কোনদিন করেনি। সেদিন হঠাৎ ভেঙে পড়ে অলকবরণের কাছে। বাইক দুর্ঘটনায় তার শুক্রাশয় চোটগ্রস্ত হয়েছিল। ডাক্তার তখন সাবধানবানী দিলেও নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা ধরে রেখেছিল। সেদিন সিমেন পরীক্ষাতেই অ্যাজোস্পারমিয়া ধরা পড়ে।
দীর্ঘ আলোচনার পর শমীককে যোগাযোগ করতে বলে ডক্টর প্রীতম খাস্তগীরের সঙ্গে। আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশনের জন্য, তবে মনে হয় স্পার্মব্যাঙ্ক থেকে অন্য কোনও ব্যক্তির শুক্রানু নিতে হতে পারে।
তার প্রায় তিনমাস পর একদিন আবার হাজির। এসে সবিস্তারে আলোচনা করে ডাক্তার প্রিতম কি কি বলেছে।
সমস্যা একটাই ছিল। প্রায় তিন চার লক্ষ টাকার ব্যাপার। সে যাই হোক শমীক মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে ছিল যে সে আর পিছিয়ে আসবে না।
অলকবরণ সবকিছু গুছিয়ে আবার ফ্রিজে তুলে রাখে। মনেমনে ভাবে পৃথিবীর অনেককিছুই বিজ্ঞানের বইয়ের বাইরে থাকে যা অক্ষরে লেখা থাকে না।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েও ফিরে এসে জর্নাদন মাষ্টারমশাই প্রশ্ন করেন
"অাচ্ছা বাবা তোমার রক্তের গ্রুপে কি?"
আমার মা 'বি পজিটিভ' বাবা 'ও পজিটিভ' আর আামার মায়ের সূত্রে পাওয়া 'বি পজিটিভ'!
"ও আচ্ছা!"
জীবনের কিছু প্রশ্ন সিলেবাসের বাইরেই থাকে।
আবার বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় জর্নাদন মাষ্টার মশাইয়ের দীর্ঘ ছায়া।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সময় গেলে সাধন হবে না : তাপসী কর
টাপুর যখন থার্ড ইয়ার প্রাণের বন্ধু সীমার বাড়ি অনেকটা সময় পড়ে থাকত। আড্ডা নয় ওরা একসাথে পড়াশুনো করত, সাথে আড্ডা ও চলত। একসাথে খাওয়া দাওয়া ওঠা বসা করতে গিয়ে সীমার মা বাবা র কাছে ও আর একটা মেয়ে হয়ে উঠেছিল।সীমা আর টাপুর দুজনেই স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে, তবে সীমার একটা নিজস্ব ঘর ছিল যেটা ওদের দুজনের ই কল্পনার জগৎ ছিল,প্রাণ খুলে মনের কথা বলার জায়গা ছিল।পরীক্ষার পর টাপুরের বিয়ের কথা চলছিল, ঘটক আর আত্মীয় স্বজনের মারফৎ দু একটা সম্বন্ধ আসছিল, কিন্তু সীমার বাবা ছিলেন একদম অন্য রকম। তিনি মেয়েকে বলেই দিয়েছিলেন আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তারপর বিয়ে।তুমি সময় নাও, প্রিপেয়ার্ড হও, সফল হবে। কোন তাড়া তিনি দিতেন না।টাপুরের বাবা অন্য রকম, তাঁ্রর কথা গ্র্যাজুয়েশনের পর বিয়ে করতে হবে, পড়াশুনা বা চাকরি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে করার হলে করবে।ঠিক এই সময় সীমার এক কাজিন ওদের বাড়িতে এল, প্রায় ওদের ই সমবয়সী, একটু হয়ত বড়। তিনজনে একসাথে গল্প বেড়ানো খাওয়া দাওয়া চলতে লাগল।আর এ সবের মধ্যে সীমা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল প্রাণের বন্ধুকে বৌদি করার। তখন টাপুর ২১, সীমার কাজিন অরূপ ২৩, সদ্য যাদবপুর থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরিয়েছে, ট্রেনিং সুত্রে সীমা দের বাড়ি কয়েকদিন রয়েছে।যাই হোক দুই বাড়ির যোগাযোগ হল, মিষ্টি মেয়ে টাপুরকে অরূপের বাবা মা আর কাকু কাকীমার খুব পছন্দ হল। দুই বাড়ি না তিন বাড়ি তে তখন আনন্দের আবহাওয়া, একসাথে খাওয়া দাওয়া বেড়ানো চলতে লাগল,আর টাপুর অরূপ আলাদা করে সীমার অজান্তে দেখা করতে লাগল।সম্পর্ক যখন বেশ গাঢ় তখন একদিন অরূপের মা টাপুরের কাছে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন "হ্যাঁ রে তোর কি গণ জানিস? আসলে আমরা এসব অতটা মানিনা, কিন্তু অরূপের দাদু মানে আমার বাবা একটু অর্থোডক্স, টাপুর কিছু মাত্র চিন্তা না করেই বল্ল রাক্ষস গণ।অরূপের মা যাকে টাপুর ততদিনে মামাণি বলতে শুরু করেছে তিনি একটা অদ্ভুত গলায় আচ্ছা বলে রেখে দিলেন।সারাদিন কি যেন এক অস্বস্তি টাপুর কে ঘিরে রইল, রাতে একবার অরূপকে ফোন করতে গিয়ে ফোন বেজে গেল, কেউ ধরল না। পরদিন বেলায় টাপুরের মা ফ্যাসফেসে গলায় বললেন ওরা বিয়ে ভেঙে দিল, ওদের ছেলে দেব গণ, ওরা রাক্ষস গণে বিয়ে দেবেনা। বাড়িটা অদ্ভুৎ নৈশব্দে ছেয়ে গেল। মা যন্ত্রের মত কাজ করে যায়, বাবা সবসময় গম্ভীর। আর টাপুর তার কথা কে ভাবে? একদিন আর না পেরে ও মা বাবাকে ডেকে বল্ল যা হয়েছে তাতে তোমাদের বা আমার কোন হাত নেই।তোমরা এরকম করছ কেন, ভাবছ বোধহয় আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতি বেশী যাদের কাছে হবু ইঞ্জিনীয়ার জামাইয়ের গল্প করেছিলে তারা কই বলবে।মা গো সবাই সব ভুলে যাবে, শুধু তোমরা আমার পাশে থাক, সাথে থাক। এরপর বাড়ীর পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছিল, তিনটে মানুষ খুব কাছাকাছি এসে গেছিল।তবু টাপুরের বাবা গেছিলেন অরূপের বাড়ি, ওর মা বলেছিল বোঝেন তো সারা জীবনের ব্যাপার,অরূপের তো দেবগণ, দেব আর রাক্ষসে সারাজীবন ঝগড়া ঝাঁটি অশান্তি লেগে থাকবে অরূপের বাবা নীরব থেকে স্ত্রী কে সমর্থন করেছিলেন।টাপুরের বাবা ভগ্ন মন নিয়ে ফিরে এসে ছিলেন।আর টাপুর দুটো কাজ করেছিল।অরূপের সাথে দেখা করেছিল ওদের অফিসে কেষ্টপুরে, অরূপ নিজের অক্ষমতা জানিয়েছিল,দাদু আর মাকে সে উপেক্ষা করতে পারবে না বলেছিল, বন্ধু হয়ে সারা জীবন থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে চেয়েছিল।টাপুর কথা বাড়ায় নি, যে প্রথম প্রতিশ্রুতি রাখল না সে আবার একটা প্রতিশ্রুতি দিতে পারে নাকি? দ্বিতীয় কাজ করেছিল নিজেই সীমার বাড়ি গিয়ে সীমা আর ওর মা বাবার সাথে দেখা করেছিল। ওরা তো মরমে মরে ছিলেন,টাপুর কে জড়িয়ে ধরে সীমা আর সীমার মা অনেক কেঁদেছিলেন, সীমার বাবা মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন তুই অনেক বড় হবি।ওঁরা টাপুর কে সন্তানতুল্যই মনে করতেন।এরপর টাপুর জোরদার পড়াশুনো করে একটা সরকারী চাকরি পেয়েছিল।জল গড়িয়ে গিয়েছিল নিজের নিয়মে।কেটে গেছে অনেকটা সময়, প্রায় ৩০ বছর।এখন টাপুর তার এক সম্পর্কে মাসি আর হেল্পিং হ্যান্ডস দের নিয়ে ওর গিছানো সংসার। এক অফিস ফাংশানে দেখা হয়ে গেল ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অরূপ বোসের সাথে। দুজনেই চিনতে পারল, সবার মাঝে হাই হ্যালো হল।সেদিন সন্ধ্যে বেলাতেই সীমার ফোন এল অরূপ দা ফোন করেছিল, প্লিজ একবার ওর সাথে কথা বল।এত বছর সীমার সাথে ফোনে যোগাযোগ থাকলেও কোন দিন কোন পক্ষই অরূপের কথা উঠায় নি।এখন শুনল অরূপ সি ই এস সি র ইঞ্জিনীয়ার, বিয়ে করে নি।সীমা বলেছিল এখন ও তোরা দুজনে মিলতে পারিস, এখন আর কোন বাধা নেই।দেখা হয়েছিল সীমার বাড়ি তে বাগুইহাটিতে।কথা বেশি সীমা বলেছিল, সীমা বিয়ের জন্য আগ্রহী হয়েছিল,বলেছিল তোরা আসলে দুজন দুজনের জন্য। অরূপ কিছু বলে নি, টাপুর কিছু সময় চেয়েছিল।সারা রাত ভেবে সীমাকে মেসেজ করেছিল ভেবে দেখলাম এখন আর বিয়ে নামক বন্ধনের প্রয়োজন নেই। একে অন্যের অসুখ বিসুখ আর সমস্যার সাথী হবার জন্য কোন বেড়াজালে আবদ্ধ হতে পারব না।আরো বড় কথা দেহে বা মনে অরূপের জন্য কোন আকুতি নেই।কোথাও এফ এমে বাজছিল " সময় গেলে সাধন হবে না।"
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ফিরে পাওয়া পূজোর গন্ধ : অনন্যা ব্যানার্জী
বেড়ার গায়ে রাংচিতা ফুল লাল হয়ে ফুটলে ,দিদির কথা মনে পড়ে।ওড়কলমী ফুল যখন বাতাসে দুলে ওঠে ,ঠিক্ তখনই দিদির কথা মনে পড়ে যায় ।
অপু দিদিকে পূজো দেখাবে বলেছিল , সেদিন , যেদিন তারা দুইভাইবোন গরু খুঁজতে গিয়ে কাশবনে লুকিয়ে লুকিয়ে রেলগাড়ীর আওয়াজ শুনছিল।সেদিন ই অপু ভেবেছিল,দিদিকে একদিন ঠিক রেলগাড়ী চড়াবে ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ফিরে পাওয়া পূজোর গন্ধ : অনন্যা ব্যানার্জী
বেড়ার গায়ে রাংচিতা ফুল লাল হয়ে ফুটলে ,দিদির কথা মনে পড়ে।ওড়কলমী ফুল যখন বাতাসে দুলে ওঠে ,ঠিক্ তখনই দিদির কথা মনে পড়ে যায় ।
অপু দিদিকে পূজো দেখাবে বলেছিল , সেদিন , যেদিন তারা দুইভাইবোন গরু খুঁজতে গিয়ে কাশবনে লুকিয়ে লুকিয়ে রেলগাড়ীর আওয়াজ শুনছিল।সেদিন ই অপু ভেবেছিল,দিদিকে একদিন ঠিক রেলগাড়ী চড়াবে ।
পূজো আসবে ....
অপু ও তার দিদি আর একসাথে ঠাকুরদালানে ঠাকুর দেখতে যাবে না।দুর্গা আসে প্রতিবার । কিন্তু অপুর দুর্গা'র আর ফিরে আসা হয় না।
এক ঝড়বৃষ্টির রাতে আবাহনের আগেই ,অপুর দুর্গার বিসর্জন হয়েছিল।অপুর দুর্গা বুকের মাঝে মনখারাপ হয়েই রয়ে গেল আজীবন।
* *** ***** ***** *** *
মেট্রোতে যেতে যেতে যমুনা'র ধারে ফুটে থাকা কাশফুল দেখতে দেখতে ,"পথের পাঁচালী'র" অপু দুর্গার কথা মনে পড়ছিল রাই এর।সেই কোন ছোটবেলায় বাবা বইমেলায় কিনে দিয়েছিল "আম আঁটির ভেপু" । এখন ও ছেলেকে পড়ে শোনায় সময় পেলে। তখন থেকে অপু আর দুর্গা রাই এর মনের মাঝে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে।
এই বছরের পূজোও চলে এল ।কেন যেন মনে হচ্ছে,কিছু একটা নেই তাই ঠিক পূজো পূজো গন্ধ টা উপভোগ করতে পারছে না রাই। মন অস্থির,তবু বুঝতে পারে না ঠিক কি খুঁজছে সে ।
আজ চতুর্থী । সন্ধের পর,আর গরম লাগছে না ।সকাল আর সন্ধে বেলায় বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ ,ভোরের দিকে শিশির পড়া চালু হয়ে গেছে। পূজোর বাজার শেষ তবুও টুক্ টাক্ কিছু বাকী থেকেই যায় ,তাই আজও একটা shopping mall এ গেছিল রাই ।ছেলেকে একা রেখে গেছে ফ্ল্যাটে তাই একটু তাড়াও ছিল বাড়ী ফেরার।
সোসাইটির গেটের ভিতর ঢুকে জোরে জোরে পা চালাচ্ছিল রাই ।ফুরফুর করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে,এইবার দিল্লিতে ভাল বৃষ্টি হয়েছে।
হঠাৎ একটা ফুলের গন্ধ নাকে আসতেই ,দাঁড়িয়ে পড়ল রাই ।গন্ধটা পুরো আবিষ্ট করে ফেললো তাকে ।মনের ভিতর থেকে যেন কেউ বলে উঠল এই তো সেই চেনা পূজোর গন্ধ । এই গন্ধটায় তো কদিন ধরে খুঁজছিল রাই ।এক নিমেষে পৌঁচ্ছে যায় সেই মফস্বল শহরটায় ।
মহালয়ার দিন,ছোট্ট রাই বাবার হাত ধরে পূজোর নতুন জুতো কিনতে যেত। আগেই মা ,বাবা দুজনের সাথে গিয়ে জামা কেনা হয়ে যেত, কিন্তু জুতো কিনতে শুধু বাবার সাথে ।যেটা পছন্দ হতো সেটায় কেনা হতো ।বাড়ী ফেরার পথে ,জিলাস্কুলের সামনের রাস্তাটায় একটা ফুলের উগ্র গন্ধ নাকে এসে লাগত,আর ঠিক তখনই মনে হতো পূজো এসে গেছে । বাবার কাছে জেনেছিল ওটা ছাতিমফুলের গন্ধ ।
আজ ছাতিমফুলের গন্ধ নিয়ে এল চেনা পূজোর গন্ধ, আর মনে করিয়ে দিল ফটোফ্রেমে বন্দি বাবার গায়ের গন্ধটাকেও। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রাই এর কাছে ।
" মেমসাব্ "...... ধরাচূড়ো পড়া বিহারী গার্ডের আওয়াজে ঘোর কাটে রাই এর । গার্ড আবার বলে .."কুছ্ খো গ্যায়া ক্যা ???".......মুচকি হেসে রাই উত্তর দিল ...."নেহী..... মিল্ গ্যায়া "
লিফট্ এর বোতাম টিপেই লিফট্ এর কাঁচের কিউবিকল এ তেইশ তলা থেকে দূরের শহরটার দিকে তাকিয়ে রাই এর মনে হলো .... ওই তো তার মফস্বল শহরটা ,কোথা থেকে আসা চেনা ছাতিমফুলের গন্ধের অবশ আলিঙ্গনে ।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ফিরে দেখা : বীথিকা নাথ
ওয়ার্ডে রাউন্ড সেরে ফেরার মুখে পাঁচ নম্বর বেডের উপর হঠাৎ চোখ আটকে যায় তিথির । চলার গতি থমকে যায় । নিজের মনেই বলে ওঠে তিথি—‘আরে রাহুল না !’ - এ কি চেহারা হয়েছে রাহুলের !মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল,মুখ ভর্তি দাঁড়ি,শীর্ণ চেহারা– চট করে ঠিক চেনা যায় না । তবে শীর্ণ মুখটার মধ্যে এখনও সেই পরিচিত,বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তিথি মুহূর্তে অতীতে হারিয়ে যায় । -পঁচিশ বছর আগের সেই রা-হু-ল- স্মার্ট ঝকঝকে চেহারা, সারা কলেজ দাপিয়ে বেড়াত।
কলেজের কালচারাল সেক্রেটারী ছিল রাহুল। রবীন্দ্রজয়ন্তী,নবীন বরন ,স্বরস্বতী পূজো,অ্যানুয়াল ফাংশান যেকোন অনুষ্ঠানে রাহুল ছিল সবার আগে। ভারি দরাজ গলা ছিল রাহুলের,একাই অনুষ্ঠান মাতিয়ে দিত। রাহুলের সাথে হঠাৎই বন্ধুত্ব হয়েছিল তিথির। নবীনবরনের দিন ফ্রেশারদের পক্ষ থেকে গান গেয়েছিল রাহুল—“আমার খোলা হাওয়া”--- সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল ওর গান। করতালিতে ভরে গিয়েছিল অডিট্যোরিয়াম। তিথিও মুগ্ধ হয়েছিল রাহুলের গানে। রাহুল হয়ে উঠেছিল কলেজের মধ্যমনি। এরপর থেকে ক্লাসের শেষে,বাড়ী ফেরার পথে প্রায়ই দেখা হতে লাগল রাহুলের সাথে। ওর সাথে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছাটা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তিথির। একদিন নিজেই উপযাচক হয়ে আলাপ করে ফেলল ----‘আমি তিথি, ফার্স্ট ইয়ার’ । রাহুল একটুও অবাক না হয়ে একগাল হেসে উত্তর দিল----‘ভবানীপুর,রমেশ মিত্র লেন,-রাইট?’ তিথি তো অবাক ! তলে তলে রাহুল ও তার খোঁজ খবর নিয়েছে ভেবে মজা পায় তিথি ।
খুব অল্পদিনেই ওরা ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে । অফ পিরিয়ডে টেবিল বাজিয়ে গান ধরত রাহুল। মজার মজার জোকস বলে জমিয়ে দিত আড্ডা । কতদিন মাইলের পর মাইল একসাথে হেঁটেছে ওরা । যেকোন সমস্যায় রাহুলই ছিল তিথির মুশকিল আসান । একটু একটু করে রাহুলের ঊপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল তিথি। শপিং,কলেজ স্ট্রীটে বই কিনতে যাওয়া,থিয়েটার দেখা সব কাজে রাহুল ছিল তিথির সঙ্গী। এরকম একদিন বিকেলে একসাথে নন্দন চত্বরে হাঁটছিল ওরা। রাহুল গাইছিল------‘এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা’—তিথিও গলা মেলাচ্ছিল। এমনটা যে ঘটবে ভাবতেও পারেনি তিথি । রাহুল হঠাৎই তিথির হাত চেপে ধরে বলে –“আমি তোকে খুব ভালবাসি তিথি। তোকে একান্ত নিজের করে পেতে চাই”। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়েছিল তিথি। মজা করছে ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি হালকা করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে রাহুল যেন একদম অন্য মানুষ হয়ে যায়। অত প্রানবন্ত একটা ছেলে কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। বন্ধুরা মজা করে বলত—“রাহুল, তোর হল কি,প্রেমে পড়লি নাকি?” ও শুধু হাসত। সবই বুঝত তিথি, কিন্তু রাহুলের ভালবাসার ডাকে সে যে সাড়া দিতে পারেনি। জীবনসঙ্গী হিসাবে তিথি কখনো কল্পনাও করেনি রাহুলকে। কারণ তিথি অনেক ঊচ্চাকাংখী। দুচোখে ওর স্বপ্ন। সাদামাটা জীবন তিথির একদম পছন্দ নয়। তাছাড়া তিথি বন্ধুত্বকে ভালবাসায় রূপ দিতে চায়নি কখনো ।
বেশ কিছুদিন হল কলেজে আসছে না রাহুল।ফোনও ধরছে না।তিথির কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।কলেজ ছুটির পর একদিন রাহুলের বাড়ি গিয়ে হাজির হয় তিথি।– “কিরে কোন পাত্তা নেই, ফোনও করিস না,হল কি তোর”?একটা শূন্য দৃষ্টি মেলে তিথির দিকে চেয়ে থাকে রাহুল।সেই করুন আকুতি ওর চোখে।তিথির খুব কষ্ট হয় কিন্তু কি করবে সে।ও যে রাহুলকে বন্ধুই ভেবে এসেছে।প্রেমিকের আসনে রাহুলকে যে ও কল্পনাও করতে পারে না।কিভাবে ঠকাবে রাহুলকে?এ তো অন্যায়,পাপ।তবুও রাহুলের হাতে হাত রেখে বোঝাতে চায় তিথি-“কেন পাগলামো করছিস?আমরা বেশ তো ছিলাম”।রাহুল দ্রুত সরে যায় আর বলে-“তুই আর এখানে আসিস না তিথি।আমি নিজেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্ত আমি পারব না তিথি।তুই খমা কর আমাকে”-শেষের কথাগুলো কান্নায় ঢাকা পড়ে যায়,ঠিক বোঝা যায় না।ধীর গতিতে বেড়িয়ে আসে তিথি।
এরমধ্যে মেডিকেলে চান্স পেয়ে শিলিগুড়িতে চলে যায় তিথি।যাওয়ার আগে অনেকবার ফোন করেছিল রাহুলকে কিন্তু ধরেনি রাহুল।নতূন জীবনে,পড়াশুনার চাপে তিথির অন্তরের অতলে তলিয়ে যায় রাহুল।
মেডিকেল পাশ করে উত্তরবঙ্গেরই একটা হাসপাতালে পোস্টিং হয় তিথির।প্রায় পনের বছর ধরে এই হাসপাতালেই রয়েছে তিথি।মনপ্রান দিয়ে মানুষের সেবা করে। ইতিমধ্যে ঘরসংসার হয়েছে তিথির।নামকরা এক কারডিওলজিস্ট ওর স্বামী।দশ বছরের একটা ছেলেও আছে তিথির।হাসপাতাল,ঘরসংসার এসব নিয়ে তিথির নিশ্চিন্ত জীবন।রাহুলের কথা যে মাঝে মধ্যে মনে পড়েনা তা নয়।এই্তো বছর দুয়েক আগে ছেলে একটা ময়ূরের পালক এনে বলে-“মা,আলমারির তাকে এটা পেলাম,কার গো”?চমকে ওঠে তিথি।ভ্যালেন্টাইন্স ডে- তে রাহুল দিয়েছিল তিথিকে। তিথি ভাবে-স্মৃতি সততই মধুর।
নার্সের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় তিথি।পায়ে পায়ে রাহুলের বেডের কাছে এসে দাঁড়ায়।চোখ বুজে শুয়েছিল রাহুল।অবিন্যস্ত একমাথা চুলে হাত বুলিয়ে দেয় তিথি।ক্লান্ত চোখ মেলে তাকায় রাহুল।মুখে মলিন হাসি।–“কেমন আছিস তিথি”? তিথির চোখেও জল।
No comments:
Post a Comment