(১)
কদিন ধরেই খুব গরম পড়েছে কলকতায় I এমনিতে ইলেকশনের জন্য কলেজ বন্ধ,ভোরের দিকে একটু ঘুমোবার তাল করছি,হঠাৎ পেটের কাছে খোঁচা খেয়ে উঠে পড়লাম I "তোপসে ,উঠে পড়,কুইক্,তোর হাতে কিন্তু মোট সাড়ে এগারো মিনিট আছে!" ফেলুদার এই টোন্ টার পরে কি করতে হয় জানা আছে আমার,তাই বলতে হল না I দশ মিনিটের মাথায় জুতো গলাতে গলাতে লক্ষ্য করলাম,ফেলুদা এই সাতসকালেই সেভ্ করে নিয়েছে, পুবের লাল হয়ে যাওয়া আকাশটা দেখতে দেখতে চারমিনার ধরিয়েছে I ফেলুদার প্রিয় পুরোনো টাইমপিস্ জানান দিচ্ছে পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট I এখানে বলে রাখা ভাল,মোবাইল একটা থাকলেও তার সাহায্য কখনও সকালে ঘুম ভাঙাবার জন্য নিতে দেখিনি ফেলুদাকে I ফেলুদা রোজ সোয়া পাঁচটায় উঠে লেকে চক্কর দিতে যায় I ওকে ঘুম থেকে তোলে ওর ঐ পুরোনো টাইম পিস্ I গতবছর একটা সাইবার ক্রাইম ধরে খুব নাম হয়েছিল ফেলুদার,ওই সময় যে ল্যাপটপটাতে কাজ হয়েছিল সেটাও আর ব্যবহার করেনা!আমাকে দিয়ে দিয়েছে I
(২)
ফেলুদা বলে সব কিছু খুব ভালভাবে অবসার্ভ করবি আর সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনাও দিয়ে দিবি পাঠককে,তাই বলছি,রাস্তায় বেরিয়ে চোখে পড়ল অনেক গুলো নতুন ফ্লেক্স আলোর খুঁটিতে,বাড়ীর কার্নিশে লাগানো; প্রার্থী কে জেতানোর আরজি তাতে I সদ্য লাগানো হয়েছে কারন কাল পর্যন্ত এ জিনিস নজরে পড়েনি I ফেলুদাকে সেকথা বলতেই গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল"আমাদের বাড়ী থেকে রজনী চ্যাটুজ্জের মোড় পর্যন্ত মোট উনিশটা,দু দলের মিলিয়ে,ফেরার সময় মিলিয়ে নিস".."কিন্তু লালমোহন বাবু আর্লী এলেন না আমরাই লেট্?"
(৩)
যাঁকে দেখে এই উক্তি সেই ভদ্রলোক অর্থাৎ জটাযু় বড় রাস্তাটার মোড়ে তখন নিবিষ্ট মনে তাঁর হালে কেনা স্মার্ট ফোনে ঘাড় গুঁজে এতটাই মাঝখানে চলে এসেছেন যে দুধেরপ্যাকেট ও খবরের কাগজ বিক্রেতা দু দুজন সাইকেল আরোহী কলিশন্ করতে করতে বেঁচে গেল I জটাযু়র গাড়ী রাস্তার পাশে দাঁড় করানো I খেয়াল হতে, এগিয়ে এলেন,বাও করে বল্লেন"মর্নিং গাইস! আমি ভাবছিলুম লেট্ করে ফেলিচি নাকি মশায়?"লালমোহন বাবু এই ক বছরে অনেকখানি বদলে ফেলেছেন নিজেকে,গাড়ীর রং এক রেখে মেক্ ও মডেল বদলে ফেলেছেন I গড়পারের সেই সাবেকী বাড়ী ছেড়ে এখন ফ্লাটে উঠেছেন I ইদানিং আবার রহস্য রোমান্চ বিষয়ক ইন্টারনেট পত্রিকা প্রকাশ করছেন নিজের হাতে I শুধু উত্তর কলকাতার টিপিকাল ভাষাটাই যা পরিবর্তন হয়নি! ফেলুদার হাতের ইশারায় যে পথে ঢুকলাম আমরা তিনজনে,সেই পথের পাশে নতুন একটা নাম-ফলক I সেইটে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন জটাযু়"ধ-ধরনী টা কি কারেক্ট হল?ফেলুবাবু" দেখি নাম ফলকে জ্বলজ্বল করছে রাস্তার নাম-সত্যজিৎ ধরনী I"চলে আসুন,আমার আপনার ক্ষেত্রে কারেক্ট, রাস্তার ক্ষেত্রে বোধকরি নয়"
(৪)
বাড়ীর নাম্বার টা দেখলাম ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডই আছে I সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছি,দেখলুম একটা হৃষ্টপুষ্ট সাদা বেড়াল নীচে নামছে I পেছনে ধুতি পরা বছর পঞ্চাশের এক পরিচারক গোছের লোক I পুষ্যি ও তার পরিচারক,দুজন কেই বড্ড চেনা চেনা লাগল,কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না I ফেলুদাকে কিছু বলার আগেই ফেলুদাই বলল"আমাদের আগেই আরও একজন এসেছেন দেখছি..." "দরজা খুলেই রেখেছি, এসো তোমরা,ভিতরে এসে গুছিয়ে বোসো"দরজার পাল্লা ঠেলতে ঠেলতে ই জলদ্ গম্ভীর স্বর শুনতে পেলাম I গলার মালিক কোনার দিকে ইজি চেয়ারের উপর আধশোয়া,চেহারা অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে,শুয়ে থাকলেও বোঝা যায় হাইট গড় পড়তা বাঙালীর তুলনায় বেশীই I তিন জনই গিয়ে প্রনাম করলাম,খুশীই হলেন মনে হল I লালমোহন বাবু সারা ঘরে ছড়ানো বইএর পাহাড় দেখে,অন্যমনস্ক হয়ে,টি টেবিলের সাথে ঠোক্কর খেলেন I ঘরে বসা পঞ্চম ব্যক্তিটির দিকে চোখ গেল I ছোটখাটো, পাকা দাড়ি ভদ্রলোক কে চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়,ইনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসার ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু!জটাযু কে সে কথা বলাতে তিনি প্রায় হামলে পড়তে যাচ্ছিলেন,কিন্তু তার আগেই গৃহকর্তার প্রশ্ন ভেসে এলো"এখন তো খুব নামডাক আপনার ,মিস্টার জটাযু? ইন্টারনেটেও বিকোয় আপনার বই I ই-বুক I মানে আমার এ বি সি ডি(এশিয়াস বেস্ট ক্রাইম ডিটেকটিভ) এখন এ বি সি ডি ই!" লালমোহন বাবু একটা হেঁ হেঁ মতো শব্দ করলেন I এবার মুখ ঘুরে গেল ফেলুদার দিকে"আর তোমার ফেলু মিত্তির?লাগে ঐ ইন্টারনেট?"ফেলুদার বোধহয় জবাব তৈরীই ছিল,বলল"ন্যাশনাল লাইব্রেরী,এশিয়াটিক সোসাইটি,আর সর্বোপরি সিধু জ্যাঠা" -"বেশ বেশ, তা এ ঘরে ঢুকে কি পরিবর্তন দেখলে? " -"সবই আগের মতই,কেবল তিনটে নতুন বই, হ্যারি পটার সিরিজ,....আপনার বাবা মানে সুকুমার রায়ের পোট্রেট টার কাচ বদলানো হয়েছে, ...........আর বাইরে দেখলাম.......গতকাল সন্ধের দিকে গিরিডিতে বৃষ্টি হয়েছে" এই শেষ কথাটাতে দেখলাম শঙ্কু,যিনি তখন থেকে দুটো পিংপং বলের মতো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড় করে চলেছেন,মুখ খুললেন"কিমিউনোলুম্বাস মেঘ,হাওযার বেগ ছিল ঘন্টায় ছেচল্লিশ দশমিক দুই কিমি,আমার আবহ মান যন্ত্রে ধরা পড়েছে,.........ঐ জল কাদাই জুতোয় লেগে থাকবে!" আমার ডান দিকে যে একজনের হাঁ টা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল তা বেশ বুঝতে পারছিলাম না তাকিয়ে ই I
(৫)
এরপর আর বেশী কথা হয়নি কারন বাড়ী র কাজের লোক ট্রে ভর্তি খাবার আর টি পট নিয়ে ঢুকে পড়ল,সঙ্গে এটাও জানিয়ে গেল যে বাবুর চানের জল রেডী I উনি শুধু বললেন "এখন আর এসব সাবেকী জিনিসের চল কোথায় হে? এই ডালমুট, নাহুমের কুকিজ,নকুড়ের তালশাঁস? এখন তো শুধু জলদি আর হলদি,তাই না লালমোহন বাবু?" (পরে ফেলুদা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,জটাযু কে যে জলদি মানে ফাস্ট ফুড I) ফিরে আসার সময়,প্রফেসার শঙ্কুর আনা ঐ পিংপং বল দুটো কিছুতেই নিলেন না ভদ্রলোক I শঙ্কুর কথায় জানলাম ওগুলো আসলে ওঁর হালের আবিষ্কার -বুদ্ধিটিবি I ঐ বল একটা বাড়ীর কোথাও রেখে দিলে সব গ্যাজেটের মেমোরী নাকি কয়েক টিবি অর্থাত টেরা বাইট্ পর্যন্ত বেড়ে যায় I উনি বললেন "ও সব বাইট ফাইটে আমার কি হবে?আমার এই বৃদ্ধ বয়সে ঘিলুই ভরসা,ঐ ফেলুর মতই!আর ভরসা তোমরা সবাই,তোমরা আছো তাই আছি!"এরপর আর কথা চলেনা I শুধু ঐ বুদ্ধিটিবি মুঠোয় ধরতেই বিদ্যুতের মতো মনে পড়ে গেল,ওই বেড়াল টাকে আগে কোথায় দেখেছি,ও তো নিউটন! প্রফেসার শঙ্কুর পুষ্যি I
(৬)
রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটছিI ফেলুদাকে বেশ খুশী খুশী মনে হল I লালমোহন বাবু শঙ্কুর দেওয়া বল টা রোদে বার করে দেখছেন I আমাকে খালি জিজ্ঞাসা করলেন, "এই ট্যারা বাইট বস্তু টি কি একটু বুঝিয়ে দেবে ভাই তপেশরঞ্জন?" . সমাপ্ত . .(অনুসরন করা আমার কর্ম না, তাই অনুকরন করলাম I তোমার জন্মদিনে,মহারাজা ,তোমারে সেলাম !! --------লেখক)