Sunday, July 31, 2016

ভালোবাসি বলে : মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

আমি তোমাকে মনে মনে 
ভেঙেছি,গড়েছি বারবার।
কতবার নিজেই ফাঁসি দিয়েছি তোমায় 
কখনো এই আমিই দিয়েছি বেকসুর খালাস।
তুমি জানতেই পারোনি।
কত পাহাড়ের নীচে নিয়ে গিয়ে 
তোমাকে দাঁড় করিয়েছি,
বলেছি"তোমাকে পেরোতেই হবে"।
প্রিয় নদীতে জোর করে নামিয়ে বলেছি
"সাঁতরে যেতে তুমি পারবেই"।
এরকম কতবার,কত অসম্ভবের মুখে,
কত বিপদের সামনে তোমাকে ফেলেছি।
তুমি প্রতিবাদ করোনি কখনো,
শুধু বলেছ,-"ভালোবাসি"।
আমিও তো ভালোবাসি,বলো!!??

বিধুমাসির রান্না : মানবেন্দ্র ব্যানার্জী

বিষ্টুপুরের কেষ্টদাসের জেঠতুতো এক মাসি
রান্নাবান্নায় নাম কিনেছেন নামটি বিধুশশী
দোক্তা দিয়ে সুক্তোরাধেন কচু দিয়ে কচুরি
একটা খেলে দশটা খাবেন ধুতরা ফুলের ফুলুরি
মুড়ি ঘণ্ট বানান তিনি থালায় মুড়ি মেখে
বাঁ হাতে এক ঘণ্টা নিয়ে বাজান থেকে থেকে
সোনাদানা মণিমুক্তায় নবরত্ন রান্না
শেষ জীবনে এটাই নাকি খেতেন রাজেশ খান্না!
গানের গুরু ধর্না দিয়ে শিখে ছিলেন রান্না
সুরের লহর ঢেলে শেষে ভজহরি মান্না !

বিবাগী ২ :মানবেন্দ্র ব্যানার্জী

রাঙামাটির দেশে বাউলবেশী এসে
উদাস হাওয়ায় ভেসে
করেছে বিবাগী
বাউল ঝুমুর গানে টান লাগিয়ে মনে
মন ভেসে যায় বনে
হয়েছি বৈরাগী !
কাঁসাই নদীর কূলে বিদ্যাবুদ্ধি ভুলে
একতারায় সুর তুলে
বাঁধি ছোট্ট নীড়
মন পাখি উড়ে বন মহুয়া জুড়ে
ঘরের বাঁধন ছিঁড়ে
তুলি উদাস মীড়……

বিবাগী ১ : মানবেন্দ্র ব্যানার্জী

বৈরাগী এক পাখি
খাঁচায় বেঁধে রাখি
পাখির দুটি চোখ
ওড়ার দিকেই রোখ !
মায়া ডোরে বাঁধি
বিজন ঘরে কাঁদি
তবুও পাখির ভাবে
যাবেই উড়ে যাবে !
বিবাগী এই মন
একা অকা - রণ
হাজার লোকের মাঝে
থাকে চক্ষু বুজে !

কবিতা গুচ্ছ : মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

(১)
স্বপ্নের পাপড়ি খুলে খুলে
মোহনার দিকে এগোতে থাকি,
অসহ্য শ্রমে ঢেউ ভাঙি রোজ।
তারপর একদিন ডানা ভেঙে গেলে
নিজেকে সত্যিই নদী বলে ভাবি।


(২)

মাঝে মাঝে বেদনাও উপভোগ্য হয়।
যন্ত্রণা ছুঁয়ে থাকে অপূর্ব সুখ।
দিগন্তবিস্তৃত শূন্যতা-
সম্ভাবনায় উন্মুখ।।
(৩)
আমি তো কিনেছি শোক,
আর যা কিছু বিরল-
ভালোবাসা,বেঁচে থাকা,
এক সমুদ্র জল।
(৪)
তোমার চোখে চোখ রাখলেই
আমি দেখতে পাই ঝড়ের জীবাশ্ম।
যেমন তোমার ঠোঁটে ঠোঁট পাতলেই
কানে আসে বৃষ্টির পূর্বাভাস।


সকালের চা : সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

প্যাঁকপ্যাঁকানি,ছোঁকছোঁকানী,শিরশিরীষের বাটে,
ফিসফিসে মেয়ে,হিসহিসে হয়,ধড়ফড়িয়ে হাঁটে,
লেডিসছাতা,রেডিস মাথা,লড়খড়ানি প্যায়ের----
শব্দঘোষে,মস্তরোষে,অল্পদোষেই গ্যায়ের? 
সব ভূলে যা,পিছলে যা যা,ঝাড়ঝেড়ে আয় কাশি- 
ফোঁসফোঁসানী সেইমেয়ে হাস ফিকফিকানী হাসি! 

চো র কাঁ টা - পূজা পর্যায় :সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

বাঁকুড়া ক্রীশ্চান কলেজ I আজ যে কথাটা হঠাৎই মনের মধ্যে ভেসে উঠল,সেটা ভেবে এই বয়সেও শরম বোধ হয় I তখন সবে ইলেভেন ক্লাশে পড়ি,সালটা ৮৫ বা ৮৬,নিচের গ্যালারিতে(জিমনাসিয়ামের দিকে কোনার ক্লাশরুম)ইলেভেন সায়েন্সের ক্লাশ I প্রথম ছয় পিরিয়ড এখানে ক্লাশ হবার পর চলে যেতে হত কলেজ বি গ্রাউন্ডএর পাশের ,বিল্ডিং এর অন্য কোনের নিচ তলার ঘরে I শেষ তিনটে পিরিয়ড ছিল বায়োলজি,বাংলা ও ইংরাজীর I প্রথম কলেজ জীবন তখন, প্রথম ছেলে মেয়ে একসাথে পড়া,চোখে রঙীন প্রজাপতি দেখছি!ক্লাশে তিরিশ জন মতো সহপাঠিনীর মধ্যে চারপাঁচ জন তখন কথাটথা বলে,ডাকাবুকো ছেলেরা জনা পনেরোর সঙ্গে ভাব করে নাক তুলে চলে I বাকি মেয়েরা সোজা কথায় তখনও ভাও খাচ্ছে l তাছাড়া ইউনিফর্মের একঘেয়ে সাদা নীল থেকে মুক্তি,স্কুলব্যাগের থেকে মুক্তি,ক্লাশ পালিয়ে সিগ্রেট টানার আজাদি,বইখাতার বদলে বাবার দেওয়া সরু একখানা ডায়েরিতেই কাজ মিটে যাচ্ছে! 

তো একদিন বিকেলে ওই ডায়েরি খানা বাগিয়ে,একটু দেরী করেই ইংরাজী ক্লাশে ঢুকছি I ক্লাশ নিচ্ছেন একজন বয়স্ক স্যার I মাথায় হিরোগিরি চেপে গেল I ডায়েরি সামনে ধরে বলে ফেললাম-----মে আই কাম ইন স্যার?(সে কালে আদ্যপান্ত বাংলা পড়া আমাদের পক্ষে ব্যাপারটা কিছুটা বাড়াবাড়ি তো বটেই!)তবে স্যার উপলক্ষ মাত্র,লক্ষ্য তো ওই ডান দিকের রো তে বসা তিরিশজোড়া আড় চোখ I অধ্যাপকটি যা করলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না I পড়া থামালেন,ঘুরে দাঁড়ালেন,সুন্দর হাসলেন এবং বললেন----প্লিজ কাম জেন্টলম্যান,প্লিইইজ I .এতটা আশা করিনি,বড়জোর ভেবেছিলাম উনি দেরি করার জন্য মৃদু ধমক দেবেন l অথবা ঘাড় হেলিয়ে বসে যেতে বলবেন I কিন্তু তা না করে একেবারে ব্রিটিশ কেতায় লম্বা প্লিইইজ!তাও আমার মত একটি চুনো পুঁটির জন্য I আমি যে পুঁচকে ছোকরা আর উনি যে প্রবাদপ্রতিম প্রোফেসার এম বি সুরাল!!ওনার ছোট হয়ে আসা চোখ যেন কিছু বলতে চাইছিল I আমি অপ্রস্তুত,উপরোন্তু ডান দিকের ঐ তিরিশ জোড়া চোখ ড্যাবড্যাবিয়ে সদ্য হিরোটিকে দেখছে--আমার রঙ ফরসা হলে,গালের লালিমা ওদের চোখেও ধরা পড়তোI ঘাবড়ে গিয়ে কোনমতে ক্লাশের পেছনে বসলাম I .জীবনের প্রায় দশ আনা পথ পেরিয়ে এসে কলেজে যা যা পড়েছি তা ভুলে গেছি কবেই I অধিকাংশ স্যারের নামও মনে পড়েনা I তবুও সেই দিনের কথা মনে পড়লেই লজ্জা তো হয়ই,এতদিন বাদেও মনে হয় স্যার বোধহয় স্বভাব জাত সহবৎ নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছেন!আমার অভিপ্রায় তাঁর চোখে ধরা পড়ে যাচ্ছে যে! .

স.মা.

কবিতা : যশোবন্ত্ বসু

দুপুরের রোদ,কলেজের ট্যাঙ্ক, মনকেমনের হিয়া চুলের গন্ধে মুখ ডুবিয়েছে গাঢ় নস্টালজিয়া খুব কাছে বোস আগের মতোই, বেলা পড়ে যাক ক্রমে দস্যিদামাল জল ঢেলে দিই আঁটোসাঁটো সংযমে ভুলে থাক যত ঘরসংসার পাশে থাকবার ছলে দ্যাখ দুই শ্বাস ঘন হয়ে এলে ছায়া কেঁপে যায় জলে আবার তেমনি হাতের মুঠোয় রঙ রাখি সারাক্ষণ জলের কিনারে যেসব দিনের নাম ছিল শিহরন...

শব্দকল্পদ্রুম : যশোবন্ত্ বসু

শব্দকল্পদ্রুম থেকে শব্দ ঝরে পড়ছে । পড়ছে তো পড়ছেই । সেসব কুড়িয়েই এইসব । ছাঁচ আর খোল পালটে যাচ্ছে কোনও শব্দের, কোনও শব্দের ব্যবহার। "মেয়েটি খুব কিপ্টে" না বলে "মেয়েটি খুব হিসেবি" বলছি । কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিয়ো না এই নীতিবোধে "ছেলেটি খুব বোকা" না বলে বলছি, "ছেলেটি খুব সরল" । কিন্তু ছেলেটি বোকা হলেও নিশ্চয় ততটা বোকা নয় যে, তার বউয়ের যমজ বাচ্চা জন্মানোর খবর শুনে "দ্বিতীয় বাচ্চাটার বাবা তাহলে কে " ভেবে ভেবে মাথার চুল ছিঁড়বে নিদ্রাহীন সারা রাত । শব্দকে কখনও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছি, কখনও বর্শার মতন। কুকথায় ফুঁড়ে দিচ্ছি বুকপিঠ । কিছু কিছু শব্দ বলবার জন্যে জিভ নিশপিশ করে খুব। ছোটবেলায় নতুন কোনও খেলনা পেলেই যেমন সবাইকে দেখাতে ইচ্ছে করত। আশির দশকে সিনেমা হলে ছবি শুরুর আগে দেখানো সেই এইচ এম টি ঘড়ির বিজ্ঞাপনটা মনে করুন, নতুন ঘড়ি দেখাতে হাত উঠে যাচ্ছে কারণে অকারণে। ব্যাপারখানা তেমনই । "চাপ নিবি না" বা "ঘেঁটে ঘ "এই কথাগুলো পাব্লিক ডোমেনে একবার না একবার বলতেই হবে, নইলে আপডেটেড থাকা যাবে না। আবার কিছু শব্দ বাংলার বদলে ইংরেজিতে বলাটাই নাকি স্মার্টনেস । ছ্যাঁচড়া বলতে আমাদের অস্বস্তি হয়, মিক্সড ভেজ অনেক স্মার্ট শব্দ। কেটারিং ব্যবসা ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে আমিষ বা নিরামিষ ছ্যাঁচড়া আমাদের মেনু কার্ড থেকে অদৃশ্য।নবরত্নকোর্মা নামের একটা গ্রাম্ভারি শব্দ চালু হয়েছে বটে,কিন্তু তার স্বাদ সেই ছ্যাঁচড়ার ধারেকাছে আসেনা । আমার কিন্তু ছ্যাঁচড়া বলতেই বেশি ভালো লাগে। ওদের হয়তো লিখতে ভালো লাগে না।
" চাকরি করি " বলার মুখ কমে যাচ্ছে দ্রুত, "জব করি " বলার মুখ বেশি চলছে। মেয়েরা আজকাল "আমার স্বামী " বা " আমার বর " না বলে বলছে " আমার Husband "।
কোনও কোনও লিপস্টিক-রাঙা ঠোঁট থেকে আবার Husbend উচ্চারণও ঝিকিয়ে বেরোচ্ছে ।
বরেরা আর কত বেন্ড হবে ?

হলুদ ফুল : যশোবন্ত্ বসু




সারা শহরের মধ্যে এই জায়গাটুকুই নির্জন । আয়, এখানেই কথা হোক । ঝগড়াঝাঁটির পরে পেরিয়ে গিয়েছে বারো ঘণ্টা। চব্বিশও পেরোবে। ক্যালেন্ডার মনে রাখলে সারা বছর জুড়ে আমাদের কত যে বিবাদ বার্ষিকী ! প্রায় প্রত্যেক মাসেই একটা না একটা। তবে এই মুহূর্তে এই জলছবিরঙ সবুজের নির্জনতায় এই বিশাল গুঁড়ির শিরীষ গাছের কোলে আর কোনও ঝগড়া পাতব না। অথই চুপ করে বসি । কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনও নয় । যেসব পরাগ রেণু খুব চেপেচুপে লুকিয়ে রাখি অনর্থক প্রতিকূলতায়, চল,ছড়িয়ে দিই। কষ্ট ও আশ্লেষ ফুটুক। খুব কি ভিসুভিয়াস হয়ে আছিস এখনও ? কলেজ ট্যাঙ্কের দিব্যি,এবার শান্ত হ । হাত পাতছি... কিছু বল ফুল যা-কিছু বলার অপমান কর তীব্র ভীষণ ছিঁড়ে ফ্যাল সব জামার বোতাম রাগে ফেটে পড় ঠেলে ফেলে দে সত্যিই আমি একটি কথাও বলব না কোনও সাফাইও দেব না ব্যথাদের নীল বুকে পিঠে নিয়ে তছনছ হয়ে ভেঙে যেতে যেতে কাঙালের মতো দুহাত বাড়িয়ে তোকেই তো ফের আঁকড়ে ধরব.. বড্ড অত্যাগসহন রে তুই !

Thursday, July 28, 2016

সংকল্প : সমীর কুমার পাত্র

একটি দুটি প্রদীপ জ্বলে দূরে কোথায় সুদূর দূরে জঙ্গলে
প্রদীপ তো নয় জ্ঞানের শিখা 
পুড়ছে সেথায় অজ্ঞতা
পুড়ছে সেথা মুর্খতা ।
জ্বলে উঠুক হাজার প্রদীপ হাজার গ্রামে হাজার দেশে
উঠুক জ্বলে প্রতিবাদী
উঠুক জেগে সুপ্ত হৃদয়
উঠুক জেগে চিত্ত ।
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
উঠছে জ্বলে উঠবে জ্বলে ঘুমিয়ে যে সব বিত্তবান নিয়ে কোমল চিত্ত ।
একটি দুটি প্রদীপ জ্বলে দূরে কোথায় সুদূর দূরে জঙ্গলে
জ্বালতে হবে জ্বলুক উঠে হাজার গ্রামে হাজার প্রদীপ ॥

সংকল্প : সমীর কুমার পাত্র

একটি দুটি প্রদীপ জ্বলে দূরে কোথায় সুদূর দূরে জঙ্গলে
প্রদীপ তো নয় জ্ঞানের শিখা 
পুড়ছে সেথায় অজ্ঞতা
পুড়ছে সেথা মুর্খতা ।
জ্বলে উঠুক হাজার প্রদীপ হাজার গ্রামে হাজার দেশে
উঠুক জ্বলে প্রতিবাদী
উঠুক জেগে সুপ্ত হৃদয়
উঠুক জেগে চিত্ত ।
ভয় নাই ওরে ভয় নাই
উঠছে জ্বলে উঠবে জ্বলে ঘুমিয়ে যে সব বিত্তবান নিয়ে কোমল চিত্ত ।
একটি দুটি প্রদীপ জ্বলে দূরে কোথায় সুদূর দূরে জঙ্গলে
জ্বালতে হবে জ্বলুক উঠে হাজার গ্রামে হাজার প্রদীপ ॥

ব্যায় ভার : সমীর কুমার পাত্র

কইতে পারি
তরে কইতে পারি
মদ আর খাবনাক আমি ।
মহূয়া
মদ আর ছোবনাক আমি
তরে কথা দিতে পারি ।
মহূয়া
তরে যেদিন ঘরে আনি
ঘর ছিল না মোর ।
স্বপ্ন ছিল, সাহস ছিল, আশা ছিল যেটা
সেটা মিথ্যা আশা !
মহূয়া
মদ আর ছোবনাক আমি
তরে কইতে পারি ।
পরা্ন্যা যেদিন চ্যই্লে গেল
অত কিছু ভাবি নাই ।
ঢোল্কি যখন আ্যল ঘরে
মহূয়া, বল্ কথাটঅ্ কি ?
কত আনন্দ!
দিন গুলান্ ক্যাইট্ছিল ভালই
বল্ মহূয়া । ঢোল্কি বড় হঁইয়ে গেল
পলাসডি'র লালুলার ব্যাটা ধনা
ওই যে ছ্যালাটা বেদম ভালঅ ট
বলটা খেইলত ।
কতলোক খাঁইয়েছিল
পলাসডি, ধানাড়া, নেক্ড়াডুমরী
ঝাইড়ে লোক !
--------
বয়েস হঁইয়েছে -
মহূয়া তু়ই বললি পেটে ব্যাথা
কাশীপুরের অবনী ডাক্তর
বইল্-ল ক্যান্সার ।
তুই কত কষ্ট পালি
কাঁদলি, মহূয়া
শেষ সময়ে ধনা-ঢোল্কি আইসেছিল
ছিল আমাদের ঘরে ।
শেষ, সব শেষ !
মহূয়া
আমি আর মদ খাবনাক ।
রাউরকেল্লা, ০৪/০২/২০১৬

মাই ডিয়ার রাই কিশোরী : লিপিকা চট্টরাজ


কথা - রূপক সামন্ত, সুর ও গান - লিপিকা চট্টরাজ

Wednesday, July 27, 2016

হীরের গ্রহ : সুজন সেনগুপ্ত

পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন হচ্ছে হীরে এক ক্যারাট বা . গ্রাম বা ২০০ মিলিগ্রাম হীরের দাম কয়েক হাজার মার্কিন ডলার। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত হীরে “কূলিনান ১” বা “দি গ্রেট স্টার অফ আফ্রিকা” ওজনে প্রায় ৫৩০ ক্যারাট। “ওরলফ” এবং “দি রিজেন্ট” হীরকখণ্ড দুটি যথাক্রমে ৩০০ এবং ১৪০ ক্যারাটের। ইতিহাস বিখ্যাত কোহিনূর হীরে ওজনে ১০৫.৬ ক্যারাট। সুতরাং পৃথিবীর বুকে পাওয়া কোন হীরের ওজনই মাত্র ১০০ গ্রামের বেশী নয়। আর আমাদের এই ছোট্ট পাথুরে গ্রহ পৃথিবীর ওজন কত? ছয়ের পিঠে চব্বিশটি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যাটি হয় তত কিলোগ্রাম। আচ্ছা যদি এই ধরনের একটা পুরো গ্রহ হীরের হয় তাহলে তার দাম কত হবে? তাই আবার হয় নাকি? একটা পুরো গ্রহ বা অন্তত তার অধিকাংশ কি হীরে হতে পারে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি সেই রকম কিছু গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন যা এই মহাবিশ্বের অমূল্য রত্ন । এই অসীম বিশ্বে কত যে বিস্ময় আছে !!

      প্রকৃতিতে হীরে কীভাবে সৃষ্টি হয়? হীরে আসলে কার্বন নামক মৌলিক পদার্থটির একটি রূপভেদ। যে কোন জিনিষ আগুনে পোড়ালে যে কালো পদার্থটি অবশিষ্ট থাকে তাই এই কার্বন। এই কার্বন যদি প্রচণ্ড উত্তাপ ও চাপের মধ্যে থাকে, তাহলে কার্বনের পরমাণুগুলি বিশেষভাবে অবস্থান করে একটি বিশেষ  জাফরিতে (lattice) পরিণত হয়। এই পদার্থটির আলো বিচ্ছুরণের অশেষ গুণ থাকে এবং এটি এত শক্ত হয় যে এর ঘর্ষণে কাঁচ পর্যন্ত কাটা যায়। এই পদার্থটিকেই আমরা বলি হীরে। পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের প্রায় ১৫০-২০০ কিলোমিটার নীচে যে উত্তাপ আর চাপ থাকে, তার ফলে সেই স্তরে কার্বন হীরেতে পরিণত হয়। আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে এই হীরে পৃথিবীর সেই গভীর স্থান থেকে উপরে উঠে আসে।
    
        তাই বলে একটা পুরো গ্রহ বা তার একটা বড় অংশ কী করে হীরে হতে পারে? আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে গ্যাস এবং ধুলোর যে মহাজাগতিক মেঘমন্ডলী তার নিজস্ব অভিকর্ষের ফলে জমাট বেঁধে সূর্য এবং পৃথিবী সমেত সৌরগ্রহগুলির সৃষ্টি করেছিল সেই বিশাল মেঘে কার্বনের পরিমাণ কম ছিল, অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেক। যার ফলে সূর্য এবং সৌরজগতের গ্রহগুলিতে অক্সাইড বা অক্সিজেন সমন্বিত যৌগ যেমন জল, কার্বন ডায়োক্সাইড, সিলিকেট অক্সাইড অর্থাৎ  ধুলো এবং পাথরের পরিমাণ অনেক বেশী। সেই কারণে পৃথিবীর মত পাথুরে গ্রহগুলির ছদ (mantle) অক্সিজেন এবং সিলিকনের পরমাণু দিয়ে গঠিত। কিন্তু যদি অন্য কোন নক্ষত্রের জন্মদাতা আন্তরজাগতিক মেঘমন্ডলীটিতে  সম পরিমাণ অক্সিজেন এবং কার্বন থাকে তাহলে সেই মেঘমণ্ডলী থেকে সৃষ্ট নক্ষত্রটিতে কার্বনেরই  প্রাধান্য থেকে যায় এবং সেই নক্ষত্রটির চারিপাশে প্রদক্ষিণরত কোন পাথুরে গ্রহতে কার্বনের পরিমাণ অন্য পদার্থের থেকে অনেক বেশী হয়। এই ধরনের নক্ষত্রকে কার্বন নক্ষত্র বলে আর তার গ্রহগুলিকে কার্বন গ্রহ বলে। এই ধরনের বেশ কিছু কার্বন নক্ষত্র অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরে  ৫৫ ক্যাঙ্ক্রি (55 Cancri) ঠিক এই ধরনের একটি কার্বন নক্ষত্র। আর এই কার্বন নক্ষত্রটিকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীর থেকে আকারে সামান্য বড়, প্রায় দ্বিগুণ এবং ওজনে প্রায় সাত থেকে আট গুণ ভারী একটি গ্রহ। এই ধরনের গ্রহদের বলা হয় অতি-পৃথিবী বা সুপার আর্থ। গড় ঘনত্ব অনুযায়ী এই ধরনের গ্রহগুলিও পৃথিবীর মত শক্ত পাথরে গঠিত। কিন্তু ৫৫  ক্যাঙ্ক্রির চারপাশে প্রদক্ষিণরত এই গ্রহটিতে পৃথিবীর মত গ্রানাইটের পাথর না থেকে থাকা উচিত কার্বনের পাথর। আবার এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের এত নিকটে আছে যে এর পৃষ্ঠদেশের তাপমান প্রায় দুই হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় পৃষ্ঠদেশ থেকে শুরু করে প্রায় পুরো গ্রহটির ছদ একটি আস্ত হীরেতে পরিণত হওয়া উচিত। এই ধরনের গ্রহকে তাই হীরের গ্রহ বলে গণ্য করা হয়। আমাদের গ্যালাক্সি বা নীহারিকায় এই রত্ন গ্রহটি আবিষ্কৃত হয় ২০১১ সালে। ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও অনেক হীরের গ্রহ আবিষ্কার হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের এই নীহারিকাটির মূল্য কত হবে তা চিন্তাতীত। যদি এই ধরনের কোনও হীরের গ্রহ তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য বা হ্যাবিটেবল স্থানে থাকে যেখানে গ্রহটির পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা জলকে তরল অবস্থায় থাকতে সাহায্য করে, তাহলে গ্রহটির পৃষ্ঠদেশে হীরের সৃষ্টি না হয়ে, পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার নীচের অংশটি উচ্চ তাপ ও চাপের ফলে হীরেই পরিণত হবে। কিন্তু এই ধরনের গ্রহতে প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি থাকায় সেই হীরের মালিক থাকাও মোটেই আশ্চর্য নয়।
  
     মালিক থাকুক বা না থাকুক, এই হীরের গ্রহগুলিকে দেখে নিঃসন্দেহে মনে হবে “Up above the world so high, real diamond in the sky”।  

  

Tuesday, July 26, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-৩ : রূপক সামন্ত

মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে কলেজের স্মৃতিকথা লিখতে বসে এতো শিবের গীত গাইছি কেন আমি। আসলে বাবার খ্রিশ্চান কলেজে চাকরী করার সূত্রে কলেজীয় নানা ঘটনার প্রভাব আমাদের পরিবারে এবং আমার উপরে এসে পড়তে থাকে। সেইসব ঘটনার অভিঘাতে গড়ে উঠতে থাকে আমার শিশুমনের জগৎ। মন্দের ভালো এই আজকের আমি হয়ে ওঠার পিছনে তাই এই কলেজের প্রভাব বরাবরই ছিলো। আজও আছে। সেই যে শুভ্রবাবু তাঁর অবিস্মরণীয় গলায় বলতেন না- সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালার আগে থাকে সকালবেলায় সলতে পাকানো। সে ছিলো সেই সলতে পাকানোর সময়।
১৯৬৯ এর একেবারে শুরুতে এক বিষণ্ণ গোধূলীবেলায় আমাদের চাঁদুর গ্রামের বাড়িতে আমার মা এক দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হলেন। সে ছিলো এক রবিবারের ভোটদান দিবস। কয়েকদিন পরেই কলকাতার এক হাসপাতালে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন তিনি। পড়ে রইলাম সাতমাসের আমি। এই ঘটনা আমাদের পরিবারকে বিশেষ বাবার জীবনকে তছনছ করে দেয়। তখন আমাকে বুকের দুধ দিয়ে শান্ত করে শক্তহাতে হাল ধরেছিলেন আমার ঠাকুমা প্রভাবতীদেবী। দাদু গোপীনাথও যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন তাঁর সাথে। তাই নিতান্তই ভেসে যাই নি আমি।
বাবার সেই সময়কার ছাত্ররা বলতে পারবেন তাঁর সেই উদভ্রান্ত জীবনের দিনলিপি। তবে কলেজের অধ্যাপকরা বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। লীলাময়বাবু, বিবেকবাবু, হরিদাসবাবু, তারাপদবাবু, তপনবাবু ও আরও অনেকে যথাযথ বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে জানি। তাঁরাই যোগাযোগ করে বাবার দ্বিতীয়বার বিয়ে দেন এই বাঁকুড়াতেই। পাত্রী নির্বাচন করেছিলেন অম্বিকাবাবু। আমার এই মামণি মনিকাকে ও বীরভূমে তাঁর পরিবারকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। মামণির বড় জামাইবাবু তখন কর্মসূত্রে বাঁকুড়ায় বদলি হয়ে এসেছেন। মামণি তাঁর কাছেই থাকতেন। এই ঘটনার প্রভাব সারাজীবন নানাভাবে আমার উপর পড়েছে।
১৯৭৫ এ বাবা বাঁকুড়ার স্কুলডাঙাতেই বাসা নিলেন। ডাঃ লালমোহন গাঙ্গুলী তাঁর বাড়ির লাগোয়া বাড়িটিতে এই ভাড়া থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মামণি আর বড়বোন লিলিনাকে নিয়ে সংসার পাতলেন তিনি। ১৯৭৬এ আমাকে চাঁদুর থেকে নিয়ে এসে কালীতলা গার্লসে চারক্লাসে ভর্তি করে দেওয়া হোলো। বাঁকুড়ার সঙ্গে নিবিড় যোগায়োগ শুরু হোলো আমার।
এই সময়ে একসন্ধ্যেয় আমাকে আর বোনকে নিয়ে বাবা গেলেন চার্চে। সেখানে কলেজের প্রিন্সিপাল সুদর্শন সিংহের বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন প্রিন্সিপাল, চার্চ, খ্রিশ্চান বিয়ে এসব কিছুই বুঝতাম না তো। নানা লোকের ভিড়ে লাজুক লাজুক মুখে হাঁ করে দেখছিলাম সাদা ওড়না ঢাকা পোশাকে পরীর মতো কনে। বর এলো কালো কোট প্যাণ্ট টাই পরে। আঙটিবদল, বাইবেলপাঠ, সোহাগচুম্বন ও নানাকিছু দেখছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের বাঙালি বিয়ের সঙ্গে মিলছিলো না কিছুতেই। তখন কি আর জানতাম এই সিংহ পরিবারের এক সিংহহৃদয় যুবক পরে আমার এতো আপন হবে।
সেই সময় থেকেই আমাদেরর বাড়িটা বাবার অধ্যাপক - লেখক বন্ধু আর ছাত্রছাত্রীদের এক অবশ্য গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। লীলাময়বাবু মাঝেমাঝেই আসতেন। তাঁর বিশাল বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন - ও রে রূপক, তুই কতো বড়ো হয়ে গেছিস রে। বাবার ছাত্রী-পিসিমণিরা আমাকে পেলে গাল টিপে দিতো। ছাত্র-কাকুরা কোলে করে বেড়াতে নিয়ে যেতো, চকোলেট দিতো। এমনই এক ছাত্র ছিলো দুর্গাকাকু, বাঙলা সাম্মানিকের দুর্গা দত্ত। গৌরীশঙ্কর গাঙ্গুলীও প্রায়ই আসতো। এদেরও আগে থেকে ছিলো রামদুলালকাকু। সে বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছিলো আমাদের। বাকিদের নাম আর মনে নেই।
এই সময়ের আর একটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। তপনবাবু একসন্ধ্যেয় নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর নতুনচটির নতুন বাড়িতে। নানারকমের খাওয়াদাওয়ার মধ্যে আমার একটি বিশেষ মিষ্টির কথা এখনও মনে আছে। সেই প্রথম খেয়েছিলাম পটলসন্দেশ। আজও সেই স্বাদ লেগে আছে জিভে।
( আবার আসিবো ফিরে )

কলেজ স্মৃতিকথা-২ : রূপক সামন্ত

সে সময় যতদূর মনে পড়ে বাঁকুড়া থেকে তারকেশ্বর আসার সরাসরি কোনো বাস ছিলো না। হয় বর্ধমান হয়ে ঘুরে, নয় আরামবাগ এসে বাস পাল্টে আসতে হোতো। খুব ভোরে বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন তামলীবাঁধ স্ট্যাণ্ডে বাস ধরার জন্য। মিশন স্কুলের পাশ দিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে বাপ-ব্যাটায় চলেছি। বাবা বলতেন, বাবুল চেয়ে থাক। এখুনি ভালুক বেরোবে। ছোট্ট বাবুল ভালুক দেখার আশায় হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখতো কখন ভালুক বেরোবে। বাবা হঠাৎ বলে উঠতেন, ওই দ্যাখ ভালুক আসছে। সত্যিই তো! বিশপ বাংলোর পাশ দিয়ে ঘন কুয়াশা ভেদ করে কালো ভালুকের মতো কিছু একটা আসছে যেন! ছোট্ট বাবুল তার বাবার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরতো। এদিকে কালো মূর্তিটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ। তারপর কাছে এলে দেখা গ্যালো যে একজন মোটাসোটা লোক ভালো করে মাফলার, বাঁদুরে টুপি জড়িয়ে, কালো ঢাউস কোট গায়ে পরে ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে। তখন ভয় কেটে গিয়ে একটু স্বস্তি। বুকের হাপরটা একটু থামলো যেন।
ওই সময়কার আর একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। বাসবোঝাই হয়ে কলেজের অধ্যাপক অধ্যাপিকারা চলেছেন বনভোজনে। রাঁচির হুড্রু আর জোনা ঝর্ণার উদ্দেশে। সেবার আমাকেও বাবা নিয়ে গেছিলেন। কখনও বাবার কোলে, কখনও বা লীলাময়বাবু বা বেলাদির কোলে চেপে চলেছি। খুব ভোরে বাস ছেড়েছে। হাসি ঠাট্টা জোর চলছে। এ ওর পিছনে লাগছেন। বিবেকবাবু, মীরাদি, অম্বিকাবাবু, শম্ভুবাবু এঁরা সব গেছিলেন মনে পড়ে। শুভ্রবাবুও ছিলেন মনে হয়। বাপ্পাবাবু তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন কলেজে। সবাই ওঁর পিছনে খুব লাগছেন। কে যেন চেঁচিয়ে উঠলেন- ওরে বাপ্পা কাঁদছে। খিদে পেয়েছে ওর। আহা ছোটোছেলে তো হাজার হোক। তারপর সে কি হাসি সকলের। লীলাময়বাবুর বিশাল চেহারা। খুব খেতে পারতেন উনি। সে নিয়েও ঠাট্টা ইয়ার্কি জমজমাট। বাবা বলে উঠলেন- ও বেলাদি, গান করুন না। ব্যস শুরু হয়ে গেলো গান। সেইসঙ্গে তালে তালে হাততালি। এভাবে মজা করতে করতে আটটা নাগাদ জোনায় গিয়ে বাস পৌঁছোলো। পাঁউরুটি, কেক, ডিমসেদ্ধ, কলা, মিষ্টি দিয়ে জোরদার জলখাবার সারার পর চা পান চললো। তরুণ অধ্যাপকরা বড়োদের লুকিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর জোনায় একেবারে নীচে নেমে স্নান শুরু হোলো। পাথর ভেদ করে বরফ-ঠাণ্ডা জল পড়ছে। সেই বয়ে চলা কনকনে জলে আমিও স্নান করেছিলাম মনে পড়ে। হুড্রু দেখা হয়েছিলো বিকেলবেলায়। তখন বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরীর কারণে হুড্রুর জলের স্রোত অনেক কমে গিয়েছিলো। সেসব আলোচনা হচ্ছিলো আবছা মনে পড়ে। শেষ বিকেলে ফেরার বাস ছাড়লো। সবাই ক্লান্ত। কেউ কেউ ঘুমোচ্ছেন। বেশ রাত করেই বাঁকুড়ায় ফিরলো বাস।
বছর পনেরো আগে রাঁচি হয়ে জোনা, হুড্রু, দশম ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিলাম পাঁচ বন্ধু মিলে। বারবার সেই ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে আসছিলো। বেশ মনে পড়ছিলো, বেলাদি লিড করছেন আর বাকিরা হাততালি দিয়ে গাইছেন- আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো।
( আবার আসিবো ফিরে )

কলেজ ডায়েরি : যশোবন্ত্ বসু

(১)
খ্রিস্টান কলেজে ইলেভেন সায়েন্সের গ্যালারি ক্লাসে অঙ্ক পিরিয়ডে আমাদের খুব কবিতা পেত। একদম টঙের দিকের বেঞ্চ গুলোয় বসতুম অনিন্দ্য,অগ্নি,সৌমেন আর আমি। সহদেব বাবু, গুইরাম বাবু বা হরিশঙ্কর বাবুরা খুব যত্ন করেই হয়তো পড়াতেন। কিন্তু কো-অর্ডিনেট জিওমেট্রি বা ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের চাইতে আমাদের ইন্টারেস্ট ছিল কবিতা ও কার্টুনে। ডায়েরির পেছনের দিকে আমি হয়তো একটা ছবি আঁকলুম, তার নীচে অগ্নি এক লাইন কবিতা লিখল,অনিন্দ্য তার পরের লাইনটা,সৌমেন আবার ছবিটাকে আরও একটু অলংকরণ করে একটা অন্য ডাইমেনশন দিল। আর এই সমস্ত রগড়ই এত নিখুঁত ভাবলেশহীন মুখে আমরা করে যেতুম,স্যররা এসব অপকীর্তি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না।
এইভাবে ইয়ার্কি-ফক্কড়ি করতে করতে কবিতাচর্চা কিছুটা সিরিয়াস দিকে টার্ন নিল। কলেজ ম্যাগাজিনে আমাদের দু'চারটে কবিতা ছেপে বেরিয়েও গেল। মা ষষ্ঠীর কৃপায় কবির তো অভাব নেই। ফার্স্ট ইয়ারে আরও কজন কবিতাপাগল জুটল। সেইসময় আমরা বইমেলায় গিয়ে কবিতার বই কিনতুম ভাগাভাগি করে। এমনকি দু'একবার স্টল থেকে বই ঝেড়েও দিয়েছি। কী করব ? আমাদের পকেটস্বাস্থ্য যে ভয়াবহ ম্যালনিউট্রিশনে ভুগত !
কবিতা লেখা হত কম, পড়তেই বেশি ভালো লাগত। কনিষ্ক কর্মকার নামের একটি ছেলে এসে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল। সে- ছেলে কবিতা নিয়ে একটু বেশি মাত্রায় সিরিয়াস। ব্যাগে বিচিত্র নামের লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে ঘুরত আর কথায় কথায় বুঝিয়ে দিত, আমরা যেসব ছাইপাঁশ লিখছি তার কোনওটাই প্রকৃত কবিতা হচ্ছে না।

(২)
কনিষ্ক বলে বেড়াত, কবিতা হবে সবরকম ন্যাকামি ও আদিখ্যেতা বর্জিত। লিরিক্যাল কবিতা আউটডেটেড। জীবনানন্দ পড়লে তার ঘুম পায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সে একটু পাত্তা দিত। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে বলেছিল, শঙ্খ ঘোষ আবার কবি নাকি ? ও তো ছড়া লেখে ! বেদম ঝাঁকুনি খেয়েছিলাম কথাটা শুনে। সেই সময়ে আমাদের অনেকেরই ডায়েরিতে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন লেখা থাকত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও। কনিষ্ক বলত, অন্ত্যমিল কবিতার গুষ্টিনাশ করে ছেড়েছে। কনটেন্ট হবে ফ্রি-ফ্লোয়িং। অন্ত্যমিল কবিতাকে হিজড়ে বানিয়ে দেয়।ওয়াল্ট হুইটম্যানের ফ্রি ভার্সের কথা বলত। আমেরিকার বিট পোয়েট্রির কথাও বলত। সেসব তখন বুঝতাম না, পরে এম.এ. পড়তে গিয়ে কিছু কিছু বুঝতে হয়েছিল।
কলেজে পড়াকালীন আমরা যে-টুকু কবিতাপ্রেমিক হয়ে উঠেছিলুম তা মূলত কবিতার প্রতি অদম্য ভালোলাগার জন্যেই। কবিতা পড়তে ভালো লাগত,ব্যস। কনিষ্ক এসে পুরো ব্যাপারটাকে ঘেঁটে দিল। কনিষ্কের একটা কবিতার কটা লাইন আজও নিদারুণ মনে আছে...
ক্যান্টিন রঙের রোদ খাচ্ছে লাইব্রেরির শিশুদিন
খাচ্ছে, গিলছে, দাঁত খুঁটে বের করছে
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার...
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অশোক এমনিতে খুব নিরীহ,শান্ত ছেলে। কনিষ্কের এই কথায় কথায় অন্ত্যমিল দেওয়া বা লিরিক্যাল কবিতার শ্রাদ্ধ করায় ভয়ানক খেপে গেল একদিন। ইউনিয়ন রুমে আমাদের বলল, শালা ডিকনস্ট্রাকশনের বাচ্চার কবিতার বারোটা বাজিয়েই ছাড়ব ! প্ল্যান ভাঁজা হয়ে গেছে ।

 (৩)
একদিন কনিষ্ক যখন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল করছে, ওর ব্যাগ থেকে অশোক একটা খাম বের করে আনল। ওপরে কলকাতার এক উচ্চারণকঠিন লিটিল ম্যাগাজিনের দপ্তরের ঠিকানা লেখা। ভেতরে কনিষ্কের কবিতা। দক্ষ সার্জনের মতন নিপুণ সার্জারি করে আমরা খামের মুখটি কেটে কনিষ্ক কর্মকারের চারটি কবিতা বের করে তার জায়গায় পূর্ব প্ল্যানমাফিক ভরে দিলাম অন্য চারটে কবিতা। কনিষ্কের হাতের লেখাটা আমিই নকল করেছিলুম। জেলা স্কুলে ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় জাঁদরেল হেড স্যর সন্তোষ দাঁ'র সই নকল করে কত ছেলেকেই যে টিফিনে ছুটি দিয়েছি !
দুটো কবিতা অশোক লিখে এনেছিল, দুটো আমি...
কবিতা-১
এবারে বর্ষা ডিমান্ডের চেয়ে কম
বৃষ্টি চেয়ে দু:খ চাটে ধ্বস্ত প্লবঙ্গম ।
কবিতা-২
পাতায় পাতায় পড়ে নিশার শিশির
তাতে কী বা আসে যায় তোমার পিসির ?
কবিতা-৩
সিন্দুক নেই,স্বর্ণ আনিনি,এনেছি জামার তলায় মদ্য
শূন্য স্টমাকে রাম খেয়ে নিলে সব গদ্যই রম্য পদ্য ।
কবিতা-৪
নমস্কার করে দিতে হবে না বলে অভিযোগ উঠেছে এক জন করে শিক্ষক ও ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত রায় বলেন যে তিনি তার এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চলেছে এই পাতাটি অপসারণ বা অন্য কোন কারণে যদি না থাকে তাহলে তো কথাই নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা যাক একটা কথা বলি না কেন জানি মনে হয় না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না...
অপারেশন শেষ করে সেই খাম এমন জুড়ে দিয়েছিলুম, সি বি আইয়ের বাবার পক্ষেও ধরা মুশকিল ছিল।
এই ঘটনার হপ্তা খানেক পরে পুজোর ছুটি পড়ে গিয়েছিল। ছুটি খোলার পর কনিষ্ক আমাদের এড়িয়ে চলতে লাগল। বাকি কলেজদিন গুলোয় আমাদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে আর একটি কথাও বলেনি।
শুধু সেই লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কনিষ্ক কর্মকারের চারটি কবিতা পেয়ে কবিকে কোনও চিঠি পাঠিয়েছিলেন কিনা এবং পাঠালে কী লিখেছিলেন এই কৌতূহল আমাদের আজও মেটেনি ।
( শেষ )


তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ - ‎মগজাস্ত্র‬ :সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

 (১)
কদিন ধরেই খুব গরম পড়েছে কলকতায় I এমনিতে ইলেকশনের জন্য কলেজ বন্ধ,ভোরের দিকে একটু ঘুমোবার তাল করছি,হঠাৎ পেটের কাছে খোঁচা খেয়ে উঠে পড়লাম I "তোপসে ,উঠে পড়,কুইক্,তোর হাতে কিন্তু মোট সাড়ে এগারো মিনিট আছে!" ফেলুদার এই টোন্ টার পরে কি করতে হয় জানা আছে আমার,তাই বলতে হল না I দশ মিনিটের মাথায় জুতো গলাতে গলাতে লক্ষ্য করলাম,ফেলুদা এই সাতসকালেই সেভ্ করে নিয়েছে, পুবের লাল হয়ে যাওয়া আকাশটা দেখতে দেখতে চারমিনার ধরিয়েছে I ফেলুদার প্রিয় পুরোনো টাইমপিস্ জানান দিচ্ছে পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট I এখানে বলে রাখা ভাল,মোবাইল একটা থাকলেও তার সাহায্য কখনও সকালে ঘুম ভাঙাবার জন্য নিতে দেখিনি ফেলুদাকে I ফেলুদা রোজ সোয়া পাঁচটায় উঠে লেকে চক্কর দিতে যায় I ওকে ঘুম থেকে তোলে ওর ঐ পুরোনো টাইম পিস্ I গতবছর একটা সাইবার ক্রাইম ধরে খুব নাম হয়েছিল ফেলুদার,ওই সময় যে ল্যাপটপটাতে কাজ হয়েছিল সেটাও আর ব্যবহার করেনা!আমাকে দিয়ে দিয়েছে I
(২)
ফেলুদা বলে সব কিছু খুব ভালভাবে অবসার্ভ করবি আর সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনাও দিয়ে দিবি পাঠককে,তাই বলছি,রাস্তায় বেরিয়ে চোখে পড়ল অনেক গুলো নতুন ফ্লেক্স আলোর খুঁটিতে,বাড়ীর কার্নিশে লাগানো; প্রার্থী কে জেতানোর আরজি তাতে I সদ্য লাগানো হয়েছে কারন কাল পর্যন্ত এ জিনিস নজরে পড়েনি I ফেলুদাকে সেকথা বলতেই গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল"আমাদের বাড়ী থেকে রজনী চ্যাটুজ্জের মোড় পর্যন্ত মোট উনিশটা,দু দলের মিলিয়ে,ফেরার সময় মিলিয়ে নিস".."কিন্তু লালমোহন বাবু আর্লী এলেন না আমরাই লেট্?"
(৩)
যাঁকে দেখে এই উক্তি সেই ভদ্রলোক অর্থাৎ জটাযু় বড় রাস্তাটার মোড়ে তখন নিবিষ্ট মনে তাঁর হালে কেনা স্মার্ট ফোনে ঘাড় গুঁজে এতটাই মাঝখানে চলে এসেছেন যে দুধেরপ্যাকেট ও খবরের কাগজ বিক্রেতা দু দুজন সাইকেল আরোহী কলিশন্ করতে করতে বেঁচে গেল I জটাযু়র গাড়ী রাস্তার পাশে দাঁড় করানো I খেয়াল হতে, এগিয়ে এলেন,বাও করে বল্লেন"মর্নিং গাইস! আমি ভাবছিলুম লেট্ করে ফেলিচি নাকি মশায়?"লালমোহন বাবু এই ক বছরে অনেকখানি বদলে ফেলেছেন নিজেকে,গাড়ীর রং এক রেখে মেক্ ও মডেল বদলে ফেলেছেন I গড়পারের সেই সাবেকী বাড়ী ছেড়ে এখন ফ্লাটে উঠেছেন I ইদানিং আবার রহস্য রোমান্চ বিষয়ক ইন্টারনেট পত্রিকা প্রকাশ করছেন নিজের হাতে I শুধু উত্তর কলকাতার টিপিকাল ভাষাটাই যা পরিবর্তন হয়নি! ফেলুদার হাতের ইশারায় যে পথে ঢুকলাম আমরা তিনজনে,সেই পথের পাশে নতুন একটা নাম-ফলক I সেইটে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন জটাযু়"ধ-ধরনী টা কি কারেক্ট হল?ফেলুবাবু" দেখি নাম ফলকে জ্বলজ্বল করছে রাস্তার নাম-সত্যজিৎ ধরনী I"চলে আসুন,আমার আপনার ক্ষেত্রে কারেক্ট, রাস্তার ক্ষেত্রে বোধকরি নয়"

(৪) 
বাড়ীর নাম্বার টা দেখলাম ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডই আছে I সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছি,দেখলুম একটা হৃষ্টপুষ্ট সাদা বেড়াল নীচে নামছে I পেছনে ধুতি পরা বছর পঞ্চাশের এক পরিচারক গোছের লোক I পুষ্যি ও তার পরিচারক,দুজন কেই বড্ড চেনা চেনা লাগল,কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না I ফেলুদাকে কিছু বলার আগেই ফেলুদাই বলল"আমাদের আগেই আরও একজন এসেছেন দেখছি..." "দরজা খুলেই রেখেছি, এসো তোমরা,ভিতরে এসে গুছিয়ে বোসো"দরজার পাল্লা ঠেলতে ঠেলতে ই জলদ্ গম্ভীর স্বর শুনতে পেলাম I গলার মালিক কোনার দিকে ইজি চেয়ারের উপর আধশোয়া,চেহারা অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছে,শুয়ে থাকলেও বোঝা যায় হাইট গড় পড়তা বাঙালীর তুলনায় বেশীই I তিন জনই গিয়ে প্রনাম করলাম,খুশীই হলেন মনে হল I লালমোহন বাবু সারা ঘরে ছড়ানো বইএর পাহাড় দেখে,অন্যমনস্ক হয়ে,টি টেবিলের সাথে ঠোক্কর খেলেন I ঘরে বসা পঞ্চম ব্যক্তিটির দিকে চোখ গেল I ছোটখাটো, পাকা দাড়ি ভদ্রলোক কে চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়,ইনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসার ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু!জটাযু কে সে কথা বলাতে তিনি প্রায় হামলে পড়তে যাচ্ছিলেন,কিন্তু তার আগেই গৃহকর্তার প্রশ্ন ভেসে এলো"এখন তো খুব নামডাক আপনার ,মিস্টার জটাযু? ইন্টারনেটেও বিকোয় আপনার বই I ই-বুক I মানে আমার এ বি সি ডি(এশিয়াস বেস্ট ক্রাইম ডিটেকটিভ) এখন এ বি সি ডি ই!" লালমোহন বাবু একটা হেঁ হেঁ মতো শব্দ করলেন I এবার মুখ ঘুরে গেল ফেলুদার দিকে"আর তোমার ফেলু মিত্তির?লাগে ঐ ইন্টারনেট?"ফেলুদার বোধহয় জবাব তৈরীই ছিল,বলল"ন্যাশনাল লাইব্রেরী,এশিয়াটিক সোসাইটি,আর সর্বোপরি সিধু জ্যাঠা" -"বেশ বেশ, তা এ ঘরে ঢুকে কি পরিবর্তন দেখলে? " -"সবই আগের মতই,কেবল তিনটে নতুন বই, হ্যারি পটার সিরিজ,....আপনার বাবা মানে সুকুমার রায়ের পোট্রেট টার কাচ বদলানো হয়েছে, ...........আর বাইরে দেখলাম.......গতকাল সন্ধের দিকে গিরিডিতে বৃষ্টি হয়েছে" এই শেষ কথাটাতে দেখলাম শঙ্কু,যিনি তখন থেকে দুটো পিংপং বলের মতো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড় করে চলেছেন,মুখ খুললেন"কিমিউনোলুম্বাস মেঘ,হাওযার বেগ ছিল ঘন্টায় ছেচল্লিশ দশমিক দুই কিমি,আমার আবহ মান যন্ত্রে ধরা পড়েছে,.........ঐ জল কাদাই জুতোয় লেগে থাকবে!" আমার ডান দিকে যে একজনের হাঁ টা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল তা বেশ বুঝতে পারছিলাম না তাকিয়ে ই I
(৫) 
এরপর আর বেশী কথা হয়নি কারন বাড়ী র কাজের লোক ট্রে ভর্তি খাবার আর টি পট নিয়ে ঢুকে পড়ল,সঙ্গে এটাও জানিয়ে গেল যে বাবুর চানের জল রেডী I উনি শুধু বললেন "এখন আর এসব সাবেকী জিনিসের চল কোথায় হে? এই ডালমুট, নাহুমের কুকিজ,নকুড়ের তালশাঁস? এখন তো শুধু জলদি আর হলদি,তাই না লালমোহন বাবু?" (পরে ফেলুদা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,জটাযু কে যে জলদি মানে ফাস্ট ফুড I) ফিরে আসার সময়,প্রফেসার শঙ্কুর আনা ঐ পিংপং বল দুটো কিছুতেই নিলেন না ভদ্রলোক I শঙ্কুর কথায় জানলাম ওগুলো আসলে ওঁর হালের আবিষ্কার -বুদ্ধিটিবি I ঐ বল একটা বাড়ীর কোথাও রেখে দিলে সব গ্যাজেটের মেমোরী নাকি কয়েক টিবি অর্থাত টেরা বাইট্ পর্যন্ত বেড়ে যায় I উনি বললেন "ও সব বাইট ফাইটে আমার কি হবে?আমার এই বৃদ্ধ বয়সে ঘিলুই ভরসা,ঐ ফেলুর মতই!আর ভরসা তোমরা সবাই,তোমরা আছো তাই আছি!"এরপর আর কথা চলেনা I শুধু ঐ বুদ্ধিটিবি মুঠোয় ধরতেই বিদ্যুতের মতো মনে পড়ে গেল,ওই বেড়াল টাকে আগে কোথায় দেখেছি,ও তো নিউটন! প্রফেসার শঙ্কুর পুষ্যি I
(৬) 
রাস্তায় বেরিয়ে হাঁটছিI ফেলুদাকে বেশ খুশী খুশী মনে হল I লালমোহন বাবু শঙ্কুর দেওয়া বল টা রোদে বার করে দেখছেন I আমাকে খালি জিজ্ঞাসা করলেন, "এই ট্যারা বাইট বস্তু টি কি একটু বুঝিয়ে দেবে ভাই তপেশরঞ্জন?" . সমাপ্ত . .(অনুসরন করা আমার কর্ম না, তাই অনুকরন করলাম I তোমার জন্মদিনে,মহারাজা ,তোমারে সেলাম !! --------লেখক)

একটা আকাশ তাতে একটাই চাঁদ ওঠে : সুজন সেনগুপ্ত

প্রকৃতির কি খেয়াল যেখানে উপভোগ করার জন্য কয়েকশ কোটি প্রাণী, সেই পৃথিবীর আকাশে একটি মাত্র চাঁদ আর যেখানে জ্যোৎস্নার আলো মাখার জন্য একটি প্রাণীর সাম্ভবনা নেই, সেই বৃহস্পতি গ্রহের চারিপাশে অন্তত সাতষট্টি  আর  শনি গ্রহের চারিপাশে অন্তত বাষট্টিটি চাঁদ ঘুরপাক খায়। সৌরজগতে, বুধ এবং শুক্র গ্রহ ছাড়া সব গ্রহদেরই এক বা একাধিক দোসর আছে। আকারে আমাদের  চাঁদ পঞ্চম স্থান আধিকার করে। সবচেয়ে বড় চাঁদটি সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির সম্পত্তি। তার নাম গ্যানিমিড। এই সব উপগ্রহগুলির জন্ম হয়েছিল গ্রহগুলির জন্মলগ্নে। গ্যানিমিড, ইউরোপা, ক্যালিস্টো , টাইটান প্রভৃতি উপগ্রহগুলি তৈরি হয়েছিলো গ্রহগুলির সৃষ্টির পরে যে গ্যাস ও ধূলিকণা অবশিষ্ট ছিল তার থেকে। মঙ্গল গ্রহের দুটি খুবই ছোট উপগ্রহ ডিমোস আর ফোবস আসলে দুইটি বড় গ্রহাণু বা asteroid যারা মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু আমাদের চাঁদ কোথা থেকে এল। কীভাবে হোল পৃথিবীর চাঁদের জন্ম?

   জন্মলগ্নে পৃথিবী ছিল একাকিনী। দুরন্ত গতিতে সে তার অক্ষের চারপাশে ঘুরত। এত  ছিল তার গতি যে চব্বিশ ঘণ্টার পরিবর্তে একটি দিনরাতের দৈর্ঘ্য ছিল সাকুল্যে দশ ঘণ্টা বা তারও কম। পৃথিবীর এই শৈশবকালে তার বুকে আছড়ে পড়ত লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহাণু। পৃথিবীর জন্মের প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর পর একদিন তার বুকে আছড়ে পড়ল এক বিশাল গহানু, আকারে যা ছিল প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান। ধরণী মায়ের বুক তখনো কঠিন হয়নি, তখনও সে নেহাতই কচি। এই প্রচণ্ড সংঘাতে পৃথিবীর নরম বুক ফেটে পড়ল, ধরিত্রী দ্বিধা হল। যে  বিশাল বস্তুটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর প্রায় ধ্বংসের উপক্রম করেছিল তার নাম ছিল থেইয়া। এই আঘাত থেকে পৃথিবী নিজেকে কোনমতে বাঁচাতে পেরেছিল। কিন্তু সেই সংঘাতের পর একটি ছোটো টুকরো বেরিয়ে এসে পৃথিবীর চারপাশে পরিক্রম করতে শুরু করে। এই ছিটকে আসা বস্তুটিই আজকের চাঁদ।

       পৃথিবীর চাঁদ কতশত কবির অনুপ্রেরণা, কতশত প্রেমের উৎস। কিন্তু জানেন কি, চাঁদ না থাকলে, এই পৃথিবীতে আদৌ জীবনের সাম্ভাবনা থাকত না? জানেন কি, কি ভাবে পৃথিবীর আকাশে এই একটি চাঁদ জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে? থেইয়ার সাথে প্রবল সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি অনেক কমে যায়। বেড়ে যায় দিন আর রাত্রির দীর্ঘতা। কিন্তু আজকের যে চব্বিশ ঘণ্টার একটি দিনরাত, তা সম্ভব হয়েছে চাঁদের প্রবল অভিকর্ষের দরুন। আজও পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমছে এবং প্রতি দশ লক্ষ বছরে দিন বা রাতের দৈর্ঘ্য  প্রায় ষোল সেকেন্ড বেড়ে চলেছে। আকারে পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমাদের এই চাঁদ শুধুমাত্র মহাসাগরে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে বায়ুমণ্ডলের প্রবাহকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, পৃথিবীর অক্ষকেও সে স্থায়ী করে রেখেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের যে খেলা আমরা পৃথিবীর বুকে উপভোগ করি, যে ঋতুচক্রের ফলে পৃথিবীর বুকে মানুষ সমেত বড়সড় প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে, তা আসলে পৃথিবী তার অক্ষের উপর বর্তমানে প্রায় ২৩.৪৪ ডিগ্রী হেলে থাকার জন্যই হয়েছে। পৃথিবীর অক্ষটি প্রায় একচল্লিশ হাজার বছরে ২২.১ ডিগ্রী থেকে ২৪.৫ ডিগ্রী তে নড়াচড়া করে পেন্ডুলামের মত।  পৃথিবীর আকাশে চাঁদ যদি না থাকত আর তার ফলে পৃথিবী যদি খুব জোরে তার অক্ষের চারপাশে ঘুরনীয়মান হত, তাহলে বৃহস্পতি ও শনির মত দৈত্যাকার গ্রহগুলির অভিকর্ষের টানে, পৃথিবী তার অক্ষপথে আরও অনেক বেশী হেলে থাকত এবং তার ফলে অস্বাবাভিক জলবায়ুর সৃষ্টি হত যা পৃথিবীর বুকে প্রাণের বিবর্তনের প্রতিকূল হতে পারত। আমাদের আদরের চাঁদ, তার অভিকর্ষ দিয়ে  বৃহস্পতি আর শনির সেই কুদৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করে রেখেছে। মঙ্গল গ্রহের অতি ছোট দুটি উপগ্রহ বৃহস্পতি বা শনির এই প্রভাব থেকে মঙ্গলকে মুক্ত করতে পারেনি আর তাই মঙ্গল গ্রহে ঋতু পরিবর্তন খুবই অনিয়মিত এবং প্রাণের প্রতিকূল।


       তাই, নাই বা থাকল দশটি চাঁদ, লক্ষ কোটি নক্ষত্র যেমন জ্যোৎস্না দিতে পারেনা, একাধিক চাঁদ হয়তো একটি চাঁদের মাহাত্ম্য খর্ব করে দিত। হয়তো বা, একাধিক চাঁদের উপস্থিতিতে পৃথিবীর আবহাওয়া প্রাণের প্রতিকূল হতে পারত। সৃষ্টিকর্তা নিখুঁতভাবে ঠিক তাই সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীর মত একটি গ্রহতে প্রাণের সঞ্চারে সাহায্য করবে  আর সেই প্রাণ বিবর্তিত হয়ে বুদ্ধিমান মানুষের সৃষ্টি করবে যা একদিন চাঁদ ও তার জ্যোৎস্নায় আপ্লুত হয়ে রচনা করবে “আমি যামিনী, তুমি শশী হে, ভাতিছ গগন মাঝে “ । 

Monday, July 25, 2016

স্মৃতি কথা : যশোবন্ত্ বসু

কফিরঙ সুন্দর মুখের প্রতি আমার একটা সহজাত টান আছে
কলেজে এস এফ আইয়ের ইউনিট মেম্বার ছিলাম। একবার ইউনিয়ন থেকে প্রিন্সিপ্যালের কাছে ডেপুটেশন দিতে যাওয়া হল কলেজ -গ্রাউন্ডের দক্ষিণ দিকে প্রিন্সিপ্যালের বাংলোয়। কী ইস্যুতে ডেপুটেশন সেটা আর মনে নেই।
ইউনিয়নের কর্মসূচি বলে অনেক ছেলেমেয়ে জড়ো হয়েছিল। বাংলোর পরিবেশটি বেশ রোম্যান্টিক। চারপাশে গাছগাছালি আর বারান্দা দিয়ে ঘেরা বাংলো, তাতে আবার কাঠের রেলিং। এমনিতে তো ওদিকটায় যেতুম না। সেদিন আমরা একগাদা জুটেছিলাম। ইউনিয়নের নেতারা কয়েকজন ভেতরেপ্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, বাকিরা বাংলোর বারান্দায় ভরপুর গজল্লা করছি
হঠাৎ নজরে পড়ল একটি শ্যামলবরন কন্যার গোলপানা মুখে। সেই গম্ভীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চুমকিকে জিগ্যেস করলুম, হ্যাঁ রে, মেয়েটা কে রে, চিনিস ? চুমকি এক বছরের সিনিয়র, ভীষণ বন্ধু ছিল, আজও আছে। চুমকি বলল, চিনব না কেন ? ওতো পারমিতা, আমাদের হস্টেলেই থাকে, জুওলজি অনার্স, তোদের ইয়ার। কেন, তোর কী দরকার ?
সত্যিই তো, আমার কী দরকার ? মুখটা দেখে ভালো লাগলো, আবেগের বশে বলে ফেলেছি, ব্যস ! আর তো কোনও গূঢ় প্ল্যানিং নেই। চুমকিকে বললুম, না,মানে মুখটা বেশ ইন্টারেস্টিং, আর কিছু নয়
ইকনোমিক্স-পড়া চুমকি চোখ সরু করে বলল, ইন্টারেস্টিং ? হুমম, বুঝেছি
কয়েকদিন পরে যখন চুমকির সঙ্গে দেখা, চুমকি দৃশ্যতই উত্তেজিত আর বলিস না রে ভাই, কাল পারমিতা বাথরুমে স্নান করছে। আমি বাইরে থেকে খুব ক্যাজুয়ালি বললাম, পারো, তাড়াতাড়ি বের হ। কলেজে তোর ডিমান্ড বাড়ছে এবারে ! শুনেই মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে ভিজে চুল,হাতে মগ নিয়ে দরজা অর্ধেক ফাঁক করে ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কী বলছ গো চুমকি দি ? কিছুই বুঝতে পারছি না। 
বললাম, ওরে তোর সম্পর্কে একজন একটু খোঁজখবর নিচ্ছিল আর কি। শুনে সে-মেয়ে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে কী বলল জানিস ? বললে, প্লিজ চুমকি দি, তুমি অন্তত আমাকে এসব বোলো না। আমি কলেজে সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতে এসেছি, বাড়িতে জানলে ভীষণ রেগে যাবে !
তারপর থেকে সারাদিন, ডাইনিং হলে, বিকেলে সে-মেয়ের মুড অফ আমাকে দেখলেই যেন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকছে। যসু , তুই ওকে খবরদার আর কিছু বলিস না। যা হাবভাব দেখছি, মেয়েটা হয়তো এবার কলেজে পড়াটাই ছেড়ে দেবে !
না, আমিও আর কোনদিনও কিছু বলিনি সেদিনের প্রিন্সিপ্যালের বাংলোর মায়াবী রোম্যান্টিক পরিবেশে আলটপকা চোখে লেগে-যাওয়া সেই গোলপানা মুখ তারপর থেকে ক্যাম্পাসে আমাকে যতবার দেখেছে, কেমন একটা কঠিন আড়ষ্ট মুখ করে থেকেছে
সে-মুখের জন্যে কোনও রাতের ঘুম স্যাক্রিফাইস করেছি বলেও মনে পড়ে না শুধু এই কলেজ গ্রুপের চক্কোরে ছাব্বিশ বছরের ওল্ড মেমারি জাস্ট রিভিজিট করে গেল