সে সময় যতদূর মনে পড়ে বাঁকুড়া থেকে তারকেশ্বর আসার সরাসরি কোনো বাস ছিলো না। হয় বর্ধমান হয়ে ঘুরে, নয় আরামবাগ এসে বাস পাল্টে আসতে হোতো। খুব ভোরে বাবা আমাকে নিয়ে বেরোতেন তামলীবাঁধ স্ট্যাণ্ডে বাস ধরার জন্য। মিশন স্কুলের পাশ দিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে বাপ-ব্যাটায় চলেছি। বাবা বলতেন, বাবুল চেয়ে থাক। এখুনি ভালুক বেরোবে। ছোট্ট বাবুল ভালুক দেখার আশায় হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখতো কখন ভালুক বেরোবে। বাবা হঠাৎ বলে উঠতেন, ওই দ্যাখ ভালুক আসছে। সত্যিই তো! বিশপ বাংলোর পাশ দিয়ে ঘন কুয়াশা ভেদ করে কালো ভালুকের মতো কিছু একটা আসছে যেন! ছোট্ট বাবুল তার বাবার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরতো। এদিকে কালো মূর্তিটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ। তারপর কাছে এলে দেখা গ্যালো যে একজন মোটাসোটা লোক ভালো করে মাফলার, বাঁদুরে টুপি জড়িয়ে, কালো ঢাউস কোট গায়ে পরে ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে। তখন ভয় কেটে গিয়ে একটু স্বস্তি। বুকের হাপরটা একটু থামলো যেন।
ওই সময়কার আর একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। বাসবোঝাই হয়ে কলেজের অধ্যাপক অধ্যাপিকারা চলেছেন বনভোজনে। রাঁচির হুড্রু আর জোনা ঝর্ণার উদ্দেশে। সেবার আমাকেও বাবা নিয়ে গেছিলেন। কখনও বাবার কোলে, কখনও বা লীলাময়বাবু বা বেলাদির কোলে চেপে চলেছি। খুব ভোরে বাস ছেড়েছে। হাসি ঠাট্টা জোর চলছে। এ ওর পিছনে লাগছেন। বিবেকবাবু, মীরাদি, অম্বিকাবাবু, শম্ভুবাবু এঁরা সব গেছিলেন মনে পড়ে। শুভ্রবাবুও ছিলেন মনে হয়। বাপ্পাবাবু তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন কলেজে। সবাই ওঁর পিছনে খুব লাগছেন। কে যেন চেঁচিয়ে উঠলেন- ওরে বাপ্পা কাঁদছে। খিদে পেয়েছে ওর। আহা ছোটোছেলে তো হাজার হোক। তারপর সে কি হাসি সকলের। লীলাময়বাবুর বিশাল চেহারা। খুব খেতে পারতেন উনি। সে নিয়েও ঠাট্টা ইয়ার্কি জমজমাট। বাবা বলে উঠলেন- ও বেলাদি, গান করুন না। ব্যস শুরু হয়ে গেলো গান। সেইসঙ্গে তালে তালে হাততালি। এভাবে মজা করতে করতে আটটা নাগাদ জোনায় গিয়ে বাস পৌঁছোলো। পাঁউরুটি, কেক, ডিমসেদ্ধ, কলা, মিষ্টি দিয়ে জোরদার জলখাবার সারার পর চা পান চললো। তরুণ অধ্যাপকরা বড়োদের লুকিয়ে সিগারেট ধরালেন। তারপর জোনায় একেবারে নীচে নেমে স্নান শুরু হোলো। পাথর ভেদ করে বরফ-ঠাণ্ডা জল পড়ছে। সেই বয়ে চলা কনকনে জলে আমিও স্নান করেছিলাম মনে পড়ে। হুড্রু দেখা হয়েছিলো বিকেলবেলায়। তখন বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরীর কারণে হুড্রুর জলের স্রোত অনেক কমে গিয়েছিলো। সেসব আলোচনা হচ্ছিলো আবছা মনে পড়ে। শেষ বিকেলে ফেরার বাস ছাড়লো। সবাই ক্লান্ত। কেউ কেউ ঘুমোচ্ছেন। বেশ রাত করেই বাঁকুড়ায় ফিরলো বাস।
বছর পনেরো আগে রাঁচি হয়ে জোনা, হুড্রু, দশম ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিলাম পাঁচ বন্ধু মিলে। বারবার সেই ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে আসছিলো। বেশ মনে পড়ছিলো, বেলাদি লিড করছেন আর বাকিরা হাততালি দিয়ে গাইছেন- আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো।
এ জীবন পুণ্য করো।
( আবার আসিবো ফিরে )
No comments:
Post a Comment