Tuesday, July 26, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-৩ : রূপক সামন্ত

মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে কলেজের স্মৃতিকথা লিখতে বসে এতো শিবের গীত গাইছি কেন আমি। আসলে বাবার খ্রিশ্চান কলেজে চাকরী করার সূত্রে কলেজীয় নানা ঘটনার প্রভাব আমাদের পরিবারে এবং আমার উপরে এসে পড়তে থাকে। সেইসব ঘটনার অভিঘাতে গড়ে উঠতে থাকে আমার শিশুমনের জগৎ। মন্দের ভালো এই আজকের আমি হয়ে ওঠার পিছনে তাই এই কলেজের প্রভাব বরাবরই ছিলো। আজও আছে। সেই যে শুভ্রবাবু তাঁর অবিস্মরণীয় গলায় বলতেন না- সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালার আগে থাকে সকালবেলায় সলতে পাকানো। সে ছিলো সেই সলতে পাকানোর সময়।
১৯৬৯ এর একেবারে শুরুতে এক বিষণ্ণ গোধূলীবেলায় আমাদের চাঁদুর গ্রামের বাড়িতে আমার মা এক দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হলেন। সে ছিলো এক রবিবারের ভোটদান দিবস। কয়েকদিন পরেই কলকাতার এক হাসপাতালে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন তিনি। পড়ে রইলাম সাতমাসের আমি। এই ঘটনা আমাদের পরিবারকে বিশেষ বাবার জীবনকে তছনছ করে দেয়। তখন আমাকে বুকের দুধ দিয়ে শান্ত করে শক্তহাতে হাল ধরেছিলেন আমার ঠাকুমা প্রভাবতীদেবী। দাদু গোপীনাথও যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন তাঁর সাথে। তাই নিতান্তই ভেসে যাই নি আমি।
বাবার সেই সময়কার ছাত্ররা বলতে পারবেন তাঁর সেই উদভ্রান্ত জীবনের দিনলিপি। তবে কলেজের অধ্যাপকরা বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। লীলাময়বাবু, বিবেকবাবু, হরিদাসবাবু, তারাপদবাবু, তপনবাবু ও আরও অনেকে যথাযথ বন্ধুর ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে জানি। তাঁরাই যোগাযোগ করে বাবার দ্বিতীয়বার বিয়ে দেন এই বাঁকুড়াতেই। পাত্রী নির্বাচন করেছিলেন অম্বিকাবাবু। আমার এই মামণি মনিকাকে ও বীরভূমে তাঁর পরিবারকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। মামণির বড় জামাইবাবু তখন কর্মসূত্রে বাঁকুড়ায় বদলি হয়ে এসেছেন। মামণি তাঁর কাছেই থাকতেন। এই ঘটনার প্রভাব সারাজীবন নানাভাবে আমার উপর পড়েছে।
১৯৭৫ এ বাবা বাঁকুড়ার স্কুলডাঙাতেই বাসা নিলেন। ডাঃ লালমোহন গাঙ্গুলী তাঁর বাড়ির লাগোয়া বাড়িটিতে এই ভাড়া থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মামণি আর বড়বোন লিলিনাকে নিয়ে সংসার পাতলেন তিনি। ১৯৭৬এ আমাকে চাঁদুর থেকে নিয়ে এসে কালীতলা গার্লসে চারক্লাসে ভর্তি করে দেওয়া হোলো। বাঁকুড়ার সঙ্গে নিবিড় যোগায়োগ শুরু হোলো আমার।
এই সময়ে একসন্ধ্যেয় আমাকে আর বোনকে নিয়ে বাবা গেলেন চার্চে। সেখানে কলেজের প্রিন্সিপাল সুদর্শন সিংহের বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন প্রিন্সিপাল, চার্চ, খ্রিশ্চান বিয়ে এসব কিছুই বুঝতাম না তো। নানা লোকের ভিড়ে লাজুক লাজুক মুখে হাঁ করে দেখছিলাম সাদা ওড়না ঢাকা পোশাকে পরীর মতো কনে। বর এলো কালো কোট প্যাণ্ট টাই পরে। আঙটিবদল, বাইবেলপাঠ, সোহাগচুম্বন ও নানাকিছু দেখছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের বাঙালি বিয়ের সঙ্গে মিলছিলো না কিছুতেই। তখন কি আর জানতাম এই সিংহ পরিবারের এক সিংহহৃদয় যুবক পরে আমার এতো আপন হবে।
সেই সময় থেকেই আমাদেরর বাড়িটা বাবার অধ্যাপক - লেখক বন্ধু আর ছাত্রছাত্রীদের এক অবশ্য গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। লীলাময়বাবু মাঝেমাঝেই আসতেন। তাঁর বিশাল বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেন - ও রে রূপক, তুই কতো বড়ো হয়ে গেছিস রে। বাবার ছাত্রী-পিসিমণিরা আমাকে পেলে গাল টিপে দিতো। ছাত্র-কাকুরা কোলে করে বেড়াতে নিয়ে যেতো, চকোলেট দিতো। এমনই এক ছাত্র ছিলো দুর্গাকাকু, বাঙলা সাম্মানিকের দুর্গা দত্ত। গৌরীশঙ্কর গাঙ্গুলীও প্রায়ই আসতো। এদেরও আগে থেকে ছিলো রামদুলালকাকু। সে বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছিলো আমাদের। বাকিদের নাম আর মনে নেই।
এই সময়ের আর একটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। তপনবাবু একসন্ধ্যেয় নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর নতুনচটির নতুন বাড়িতে। নানারকমের খাওয়াদাওয়ার মধ্যে আমার একটি বিশেষ মিষ্টির কথা এখনও মনে আছে। সেই প্রথম খেয়েছিলাম পটলসন্দেশ। আজও সেই স্বাদ লেগে আছে জিভে।
( আবার আসিবো ফিরে )

No comments:

Post a Comment