প্রকৃতির কি খেয়াল। যেখানে উপভোগ করার জন্য কয়েকশ কোটি প্রাণী, সেই পৃথিবীর আকাশে একটি মাত্র চাঁদ আর যেখানে জ্যোৎস্নার আলো মাখার জন্য একটি ও প্রাণীর সাম্ভবনা নেই, সেই বৃহস্পতি গ্রহের চারিপাশে অন্তত সাতষট্টি আর শনি গ্রহের চারিপাশে অন্তত বাষট্টিটি চাঁদ ঘুরপাক খায়। সৌরজগতে, বুধ এবং শুক্র গ্রহ ছাড়া সব গ্রহদেরই
এক বা একাধিক দোসর আছে। আকারে আমাদের চাঁদ
পঞ্চম স্থান আধিকার করে। সবচেয়ে বড় চাঁদটি সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির সম্পত্তি। তার
নাম গ্যানিমিড। এই সব উপগ্রহগুলির জন্ম হয়েছিল গ্রহগুলির জন্মলগ্নে। গ্যানিমিড, ইউরোপা,
ক্যালিস্টো , টাইটান প্রভৃতি উপগ্রহগুলি তৈরি হয়েছিলো গ্রহগুলির সৃষ্টির পরে যে গ্যাস
ও ধূলিকণা অবশিষ্ট ছিল তার থেকে। মঙ্গল গ্রহের দুটি খুবই ছোট উপগ্রহ ডিমোস আর ফোবস
আসলে দুইটি বড় গ্রহাণু বা asteroid
যারা
মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণে বাঁধা পড়েছে। কিন্তু আমাদের চাঁদ কোথা থেকে এল। কীভাবে হোল পৃথিবীর
চাঁদের জন্ম?
জন্মলগ্নে পৃথিবী ছিল একাকিনী। দুরন্ত গতিতে সে
তার অক্ষের চারপাশে ঘুরত। এত ছিল তার গতি যে
চব্বিশ ঘণ্টার পরিবর্তে একটি দিনরাতের দৈর্ঘ্য ছিল সাকুল্যে দশ ঘণ্টা বা তারও কম। পৃথিবীর
এই শৈশবকালে তার বুকে আছড়ে পড়ত লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রহাণু। পৃথিবীর জন্মের
প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর পর একদিন তার বুকে আছড়ে পড়ল এক বিশাল গহানু, আকারে যা ছিল প্রায়
মঙ্গল গ্রহের সমান। ধরণী মায়ের বুক তখনো কঠিন হয়নি, তখনও সে নেহাতই কচি। এই প্রচণ্ড
সংঘাতে পৃথিবীর নরম বুক ফেটে পড়ল, ধরিত্রী দ্বিধা হল। যে বিশাল বস্তুটি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর প্রায়
ধ্বংসের উপক্রম করেছিল তার নাম ছিল থেইয়া। এই আঘাত থেকে পৃথিবী নিজেকে কোনমতে বাঁচাতে
পেরেছিল। কিন্তু সেই সংঘাতের পর একটি ছোটো টুকরো বেরিয়ে এসে পৃথিবীর চারপাশে পরিক্রম
করতে শুরু করে। এই ছিটকে আসা বস্তুটিই আজকের চাঁদ।
পৃথিবীর চাঁদ কতশত কবির অনুপ্রেরণা, কতশত প্রেমের
উৎস। কিন্তু জানেন কি, চাঁদ না থাকলে, এই পৃথিবীতে আদৌ জীবনের সাম্ভাবনা থাকত না? জানেন
কি, কি ভাবে পৃথিবীর আকাশে এই একটি চাঁদ জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে? থেইয়ার সাথে প্রবল
সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি অনেক কমে যায়। বেড়ে যায় দিন আর রাত্রির দীর্ঘতা। কিন্তু
আজকের যে চব্বিশ ঘণ্টার একটি দিনরাত, তা সম্ভব হয়েছে চাঁদের প্রবল অভিকর্ষের দরুন।
আজও পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি কমছে এবং প্রতি দশ লক্ষ বছরে দিন বা রাতের দৈর্ঘ্য প্রায় ষোল সেকেন্ড বেড়ে চলেছে। আকারে পৃথিবীর প্রায়
এক তৃতীয়াংশ আমাদের এই চাঁদ শুধুমাত্র মহাসাগরে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে বায়ুমণ্ডলের
প্রবাহকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, পৃথিবীর অক্ষকেও সে স্থায়ী করে রেখেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা,
শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের যে খেলা আমরা পৃথিবীর বুকে উপভোগ করি, যে ঋতুচক্রের ফলে
পৃথিবীর বুকে মানুষ সমেত বড়সড় প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে, তা আসলে পৃথিবী তার অক্ষের
উপর বর্তমানে প্রায় ২৩.৪৪ ডিগ্রী হেলে থাকার
জন্যই হয়েছে। পৃথিবীর অক্ষটি প্রায় একচল্লিশ হাজার বছরে ২২.১ ডিগ্রী থেকে ২৪.৫ ডিগ্রী তে নড়াচড়া করে পেন্ডুলামের
মত। পৃথিবীর আকাশে চাঁদ যদি না থাকত আর তার
ফলে পৃথিবী যদি খুব জোরে তার অক্ষের চারপাশে ঘুরনীয়মান হত, তাহলে বৃহস্পতি ও শনির মত
দৈত্যাকার গ্রহগুলির অভিকর্ষের টানে, পৃথিবী তার অক্ষপথে আরও অনেক বেশী হেলে থাকত এবং
তার ফলে অস্বাবাভিক জলবায়ুর সৃষ্টি হত যা পৃথিবীর বুকে প্রাণের বিবর্তনের প্রতিকূল
হতে পারত। আমাদের আদরের চাঁদ, তার অভিকর্ষ দিয়ে
বৃহস্পতি আর শনির সেই কুদৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করে রেখেছে। মঙ্গল গ্রহের
অতি ছোট দুটি উপগ্রহ বৃহস্পতি বা শনির এই প্রভাব থেকে মঙ্গলকে মুক্ত করতে পারেনি আর
তাই মঙ্গল গ্রহে ঋতু পরিবর্তন খুবই অনিয়মিত এবং প্রাণের প্রতিকূল।
তাই, নাই বা থাকল দশটি চাঁদ, লক্ষ কোটি নক্ষত্র
যেমন জ্যোৎস্না দিতে পারেনা, একাধিক চাঁদ হয়তো একটি চাঁদের মাহাত্ম্য খর্ব করে দিত।
হয়তো বা, একাধিক চাঁদের উপস্থিতিতে পৃথিবীর আবহাওয়া প্রাণের প্রতিকূল হতে পারত। সৃষ্টিকর্তা
নিখুঁতভাবে ঠিক তাই সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীর মত একটি গ্রহতে প্রাণের সঞ্চারে সাহায্য
করবে আর সেই প্রাণ বিবর্তিত হয়ে বুদ্ধিমান
মানুষের সৃষ্টি করবে যা একদিন চাঁদ ও তার জ্যোৎস্নায় আপ্লুত হয়ে রচনা করবে “আমি যামিনী,
তুমি শশী হে, ভাতিছ গগন মাঝে “ ।
No comments:
Post a Comment