Tuesday, July 26, 2016

কলেজ ডায়েরি : যশোবন্ত্ বসু

(১)
খ্রিস্টান কলেজে ইলেভেন সায়েন্সের গ্যালারি ক্লাসে অঙ্ক পিরিয়ডে আমাদের খুব কবিতা পেত। একদম টঙের দিকের বেঞ্চ গুলোয় বসতুম অনিন্দ্য,অগ্নি,সৌমেন আর আমি। সহদেব বাবু, গুইরাম বাবু বা হরিশঙ্কর বাবুরা খুব যত্ন করেই হয়তো পড়াতেন। কিন্তু কো-অর্ডিনেট জিওমেট্রি বা ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের চাইতে আমাদের ইন্টারেস্ট ছিল কবিতা ও কার্টুনে। ডায়েরির পেছনের দিকে আমি হয়তো একটা ছবি আঁকলুম, তার নীচে অগ্নি এক লাইন কবিতা লিখল,অনিন্দ্য তার পরের লাইনটা,সৌমেন আবার ছবিটাকে আরও একটু অলংকরণ করে একটা অন্য ডাইমেনশন দিল। আর এই সমস্ত রগড়ই এত নিখুঁত ভাবলেশহীন মুখে আমরা করে যেতুম,স্যররা এসব অপকীর্তি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না।
এইভাবে ইয়ার্কি-ফক্কড়ি করতে করতে কবিতাচর্চা কিছুটা সিরিয়াস দিকে টার্ন নিল। কলেজ ম্যাগাজিনে আমাদের দু'চারটে কবিতা ছেপে বেরিয়েও গেল। মা ষষ্ঠীর কৃপায় কবির তো অভাব নেই। ফার্স্ট ইয়ারে আরও কজন কবিতাপাগল জুটল। সেইসময় আমরা বইমেলায় গিয়ে কবিতার বই কিনতুম ভাগাভাগি করে। এমনকি দু'একবার স্টল থেকে বই ঝেড়েও দিয়েছি। কী করব ? আমাদের পকেটস্বাস্থ্য যে ভয়াবহ ম্যালনিউট্রিশনে ভুগত !
কবিতা লেখা হত কম, পড়তেই বেশি ভালো লাগত। কনিষ্ক কর্মকার নামের একটি ছেলে এসে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল। সে- ছেলে কবিতা নিয়ে একটু বেশি মাত্রায় সিরিয়াস। ব্যাগে বিচিত্র নামের লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে ঘুরত আর কথায় কথায় বুঝিয়ে দিত, আমরা যেসব ছাইপাঁশ লিখছি তার কোনওটাই প্রকৃত কবিতা হচ্ছে না।

(২)
কনিষ্ক বলে বেড়াত, কবিতা হবে সবরকম ন্যাকামি ও আদিখ্যেতা বর্জিত। লিরিক্যাল কবিতা আউটডেটেড। জীবনানন্দ পড়লে তার ঘুম পায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সে একটু পাত্তা দিত। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে বলেছিল, শঙ্খ ঘোষ আবার কবি নাকি ? ও তো ছড়া লেখে ! বেদম ঝাঁকুনি খেয়েছিলাম কথাটা শুনে। সেই সময়ে আমাদের অনেকেরই ডায়েরিতে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন লেখা থাকত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও। কনিষ্ক বলত, অন্ত্যমিল কবিতার গুষ্টিনাশ করে ছেড়েছে। কনটেন্ট হবে ফ্রি-ফ্লোয়িং। অন্ত্যমিল কবিতাকে হিজড়ে বানিয়ে দেয়।ওয়াল্ট হুইটম্যানের ফ্রি ভার্সের কথা বলত। আমেরিকার বিট পোয়েট্রির কথাও বলত। সেসব তখন বুঝতাম না, পরে এম.এ. পড়তে গিয়ে কিছু কিছু বুঝতে হয়েছিল।
কলেজে পড়াকালীন আমরা যে-টুকু কবিতাপ্রেমিক হয়ে উঠেছিলুম তা মূলত কবিতার প্রতি অদম্য ভালোলাগার জন্যেই। কবিতা পড়তে ভালো লাগত,ব্যস। কনিষ্ক এসে পুরো ব্যাপারটাকে ঘেঁটে দিল। কনিষ্কের একটা কবিতার কটা লাইন আজও নিদারুণ মনে আছে...
ক্যান্টিন রঙের রোদ খাচ্ছে লাইব্রেরির শিশুদিন
খাচ্ছে, গিলছে, দাঁত খুঁটে বের করছে
প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার...
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অশোক এমনিতে খুব নিরীহ,শান্ত ছেলে। কনিষ্কের এই কথায় কথায় অন্ত্যমিল দেওয়া বা লিরিক্যাল কবিতার শ্রাদ্ধ করায় ভয়ানক খেপে গেল একদিন। ইউনিয়ন রুমে আমাদের বলল, শালা ডিকনস্ট্রাকশনের বাচ্চার কবিতার বারোটা বাজিয়েই ছাড়ব ! প্ল্যান ভাঁজা হয়ে গেছে ।

 (৩)
একদিন কনিষ্ক যখন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল করছে, ওর ব্যাগ থেকে অশোক একটা খাম বের করে আনল। ওপরে কলকাতার এক উচ্চারণকঠিন লিটিল ম্যাগাজিনের দপ্তরের ঠিকানা লেখা। ভেতরে কনিষ্কের কবিতা। দক্ষ সার্জনের মতন নিপুণ সার্জারি করে আমরা খামের মুখটি কেটে কনিষ্ক কর্মকারের চারটি কবিতা বের করে তার জায়গায় পূর্ব প্ল্যানমাফিক ভরে দিলাম অন্য চারটে কবিতা। কনিষ্কের হাতের লেখাটা আমিই নকল করেছিলুম। জেলা স্কুলে ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় জাঁদরেল হেড স্যর সন্তোষ দাঁ'র সই নকল করে কত ছেলেকেই যে টিফিনে ছুটি দিয়েছি !
দুটো কবিতা অশোক লিখে এনেছিল, দুটো আমি...
কবিতা-১
এবারে বর্ষা ডিমান্ডের চেয়ে কম
বৃষ্টি চেয়ে দু:খ চাটে ধ্বস্ত প্লবঙ্গম ।
কবিতা-২
পাতায় পাতায় পড়ে নিশার শিশির
তাতে কী বা আসে যায় তোমার পিসির ?
কবিতা-৩
সিন্দুক নেই,স্বর্ণ আনিনি,এনেছি জামার তলায় মদ্য
শূন্য স্টমাকে রাম খেয়ে নিলে সব গদ্যই রম্য পদ্য ।
কবিতা-৪
নমস্কার করে দিতে হবে না বলে অভিযোগ উঠেছে এক জন করে শিক্ষক ও ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত রায় বলেন যে তিনি তার এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চলেছে এই পাতাটি অপসারণ বা অন্য কোন কারণে যদি না থাকে তাহলে তো কথাই নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা যাক একটা কথা বলি না কেন জানি মনে হয় না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না যে আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি না...
অপারেশন শেষ করে সেই খাম এমন জুড়ে দিয়েছিলুম, সি বি আইয়ের বাবার পক্ষেও ধরা মুশকিল ছিল।
এই ঘটনার হপ্তা খানেক পরে পুজোর ছুটি পড়ে গিয়েছিল। ছুটি খোলার পর কনিষ্ক আমাদের এড়িয়ে চলতে লাগল। বাকি কলেজদিন গুলোয় আমাদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে আর একটি কথাও বলেনি।
শুধু সেই লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কনিষ্ক কর্মকারের চারটি কবিতা পেয়ে কবিকে কোনও চিঠি পাঠিয়েছিলেন কিনা এবং পাঠালে কী লিখেছিলেন এই কৌতূহল আমাদের আজও মেটেনি ।
( শেষ )


No comments:

Post a Comment