Wednesday, July 27, 2016

হীরের গ্রহ : সুজন সেনগুপ্ত

পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন হচ্ছে হীরে এক ক্যারাট বা . গ্রাম বা ২০০ মিলিগ্রাম হীরের দাম কয়েক হাজার মার্কিন ডলার। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত হীরে “কূলিনান ১” বা “দি গ্রেট স্টার অফ আফ্রিকা” ওজনে প্রায় ৫৩০ ক্যারাট। “ওরলফ” এবং “দি রিজেন্ট” হীরকখণ্ড দুটি যথাক্রমে ৩০০ এবং ১৪০ ক্যারাটের। ইতিহাস বিখ্যাত কোহিনূর হীরে ওজনে ১০৫.৬ ক্যারাট। সুতরাং পৃথিবীর বুকে পাওয়া কোন হীরের ওজনই মাত্র ১০০ গ্রামের বেশী নয়। আর আমাদের এই ছোট্ট পাথুরে গ্রহ পৃথিবীর ওজন কত? ছয়ের পিঠে চব্বিশটি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যাটি হয় তত কিলোগ্রাম। আচ্ছা যদি এই ধরনের একটা পুরো গ্রহ হীরের হয় তাহলে তার দাম কত হবে? তাই আবার হয় নাকি? একটা পুরো গ্রহ বা অন্তত তার অধিকাংশ কি হীরে হতে পারে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি সেই রকম কিছু গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন যা এই মহাবিশ্বের অমূল্য রত্ন । এই অসীম বিশ্বে কত যে বিস্ময় আছে !!

      প্রকৃতিতে হীরে কীভাবে সৃষ্টি হয়? হীরে আসলে কার্বন নামক মৌলিক পদার্থটির একটি রূপভেদ। যে কোন জিনিষ আগুনে পোড়ালে যে কালো পদার্থটি অবশিষ্ট থাকে তাই এই কার্বন। এই কার্বন যদি প্রচণ্ড উত্তাপ ও চাপের মধ্যে থাকে, তাহলে কার্বনের পরমাণুগুলি বিশেষভাবে অবস্থান করে একটি বিশেষ  জাফরিতে (lattice) পরিণত হয়। এই পদার্থটির আলো বিচ্ছুরণের অশেষ গুণ থাকে এবং এটি এত শক্ত হয় যে এর ঘর্ষণে কাঁচ পর্যন্ত কাটা যায়। এই পদার্থটিকেই আমরা বলি হীরে। পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের প্রায় ১৫০-২০০ কিলোমিটার নীচে যে উত্তাপ আর চাপ থাকে, তার ফলে সেই স্তরে কার্বন হীরেতে পরিণত হয়। আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে এই হীরে পৃথিবীর সেই গভীর স্থান থেকে উপরে উঠে আসে।
    
        তাই বলে একটা পুরো গ্রহ বা তার একটা বড় অংশ কী করে হীরে হতে পারে? আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে গ্যাস এবং ধুলোর যে মহাজাগতিক মেঘমন্ডলী তার নিজস্ব অভিকর্ষের ফলে জমাট বেঁধে সূর্য এবং পৃথিবী সমেত সৌরগ্রহগুলির সৃষ্টি করেছিল সেই বিশাল মেঘে কার্বনের পরিমাণ কম ছিল, অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেক। যার ফলে সূর্য এবং সৌরজগতের গ্রহগুলিতে অক্সাইড বা অক্সিজেন সমন্বিত যৌগ যেমন জল, কার্বন ডায়োক্সাইড, সিলিকেট অক্সাইড অর্থাৎ  ধুলো এবং পাথরের পরিমাণ অনেক বেশী। সেই কারণে পৃথিবীর মত পাথুরে গ্রহগুলির ছদ (mantle) অক্সিজেন এবং সিলিকনের পরমাণু দিয়ে গঠিত। কিন্তু যদি অন্য কোন নক্ষত্রের জন্মদাতা আন্তরজাগতিক মেঘমন্ডলীটিতে  সম পরিমাণ অক্সিজেন এবং কার্বন থাকে তাহলে সেই মেঘমণ্ডলী থেকে সৃষ্ট নক্ষত্রটিতে কার্বনেরই  প্রাধান্য থেকে যায় এবং সেই নক্ষত্রটির চারিপাশে প্রদক্ষিণরত কোন পাথুরে গ্রহতে কার্বনের পরিমাণ অন্য পদার্থের থেকে অনেক বেশী হয়। এই ধরনের নক্ষত্রকে কার্বন নক্ষত্র বলে আর তার গ্রহগুলিকে কার্বন গ্রহ বলে। এই ধরনের বেশ কিছু কার্বন নক্ষত্র অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরে  ৫৫ ক্যাঙ্ক্রি (55 Cancri) ঠিক এই ধরনের একটি কার্বন নক্ষত্র। আর এই কার্বন নক্ষত্রটিকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীর থেকে আকারে সামান্য বড়, প্রায় দ্বিগুণ এবং ওজনে প্রায় সাত থেকে আট গুণ ভারী একটি গ্রহ। এই ধরনের গ্রহদের বলা হয় অতি-পৃথিবী বা সুপার আর্থ। গড় ঘনত্ব অনুযায়ী এই ধরনের গ্রহগুলিও পৃথিবীর মত শক্ত পাথরে গঠিত। কিন্তু ৫৫  ক্যাঙ্ক্রির চারপাশে প্রদক্ষিণরত এই গ্রহটিতে পৃথিবীর মত গ্রানাইটের পাথর না থেকে থাকা উচিত কার্বনের পাথর। আবার এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের এত নিকটে আছে যে এর পৃষ্ঠদেশের তাপমান প্রায় দুই হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় পৃষ্ঠদেশ থেকে শুরু করে প্রায় পুরো গ্রহটির ছদ একটি আস্ত হীরেতে পরিণত হওয়া উচিত। এই ধরনের গ্রহকে তাই হীরের গ্রহ বলে গণ্য করা হয়। আমাদের গ্যালাক্সি বা নীহারিকায় এই রত্ন গ্রহটি আবিষ্কৃত হয় ২০১১ সালে। ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও অনেক হীরের গ্রহ আবিষ্কার হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের এই নীহারিকাটির মূল্য কত হবে তা চিন্তাতীত। যদি এই ধরনের কোনও হীরের গ্রহ তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য বা হ্যাবিটেবল স্থানে থাকে যেখানে গ্রহটির পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা জলকে তরল অবস্থায় থাকতে সাহায্য করে, তাহলে গ্রহটির পৃষ্ঠদেশে হীরের সৃষ্টি না হয়ে, পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার নীচের অংশটি উচ্চ তাপ ও চাপের ফলে হীরেই পরিণত হবে। কিন্তু এই ধরনের গ্রহতে প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি থাকায় সেই হীরের মালিক থাকাও মোটেই আশ্চর্য নয়।
  
     মালিক থাকুক বা না থাকুক, এই হীরের গ্রহগুলিকে দেখে নিঃসন্দেহে মনে হবে “Up above the world so high, real diamond in the sky”।  

  

No comments:

Post a Comment