Thursday, July 21, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা -১ : রূপক সামন্ত

খ্রিশ্চান কলেজের দিনগুলো আমার প্রথম যৌবনের উপবন। এতো অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই কলেজের আঙিনা জুড়ে তা লিখলে কালিপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। আর হবে নাই বা কেন, এই কলেজের প্রতিটা কাঁকর আমায় চিনতো যে। আমিও তো তাদের চিনতাম। সম্পর্কটাতো আজকের নয়। সেই ১৯৬৮ সালের কথা। ওই বছরেরই ৭ জুলাই বাঁকুড়া হাসপাতালে আমার জন্ম। দিনটা ছিলো রবিবার। তার ঠিক দুদিন আগে, ৫ জুলাই, ওই হাসপাতালেই আমার বড়মামার মেজোমেয়ে মধুছন্দা ওরফে বুবুন জন্ম নিয়েছে। বড়মামা ডাঃ অনিল কুমার পাত্র তখন ওই হাসপাতালের প্যাথোলজি বিভাগের ডাক্তার। ভাড়া থাকতেন মিশন বালিকা বিদ্যালয়ের ঠিক লাগোয়া একতলা ছোটো বাড়িটায়। আমার মামাবাড়ি বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন-২ ব্লকের খাকুড়দায়।
আমার বাবা ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত খ্রিশ্চান কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ১৯৬৭ সালের ১ অাগষ্ট অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বনামখ্যাত অধ্যাপক ও লেখক প্রমথনাথ বিশী মশায়ের অধীনে 'রবীন্দ্র কাব্যে নৈসর্গিক উপাদান ' বিষয়ে গবেষণা করতে করতে কলেজে যোগ দিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৬৫ সালে তিনি আমার মা মণিমালাকে বিয়ে করেন। কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিয়ে বাবা প্রথমে কিছুূদিন মাচানতলার শ্রী হোটেলে থাকতেন। পরে স্কুলডাঙায়, ওই ওয়ার্ডের দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর দেবী পালিত মশায়ের বাড়ির লাগোয়া প্রফেসরস মেসে চলে আসেন। ওই মেসটা ছিলো কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শম্ভুবাবুর মেস।
আমি তখন নিতান্তই বছর পাঁচেকের বালক। বাবা আমাকে আমাদের তারকেশ্বর ব্লকের চাঁদুর গ্রাম থেকে ওই মেসে নিয়ে আসতেন। সজ্ঞানে বাঁকুড়ার সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়। মেসের বাইরের দিকের বড় ঘরটায় বাবা থাকতেন প্রচুর বইপত্র নিয়ে। তার ঠিক পাশেই একটা ছোটো ঘরে থাকতেন উকিল অরুণকাকু। তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। আর একটা মাঝারি আকারের ঘরে থাকতেন শম্ভুবাবু, আমার শম্ভুজেঠু। জেঠু অসম্ভব সুন্দর দেখতে ছিলেন তখন। টকটকে গায়ের রঙ। চোখে একটা হাই পাওয়ারের মোটা কালো ফ্রেমের চশনা। ধপধপে সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে খুব শ্রদ্ধেয় ও আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব। বাবাও তখন অসম্বব সুন্দর দেখতে ছিলেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় কোঁকড়া চুল। কাঁচা-হলুদ গায়ের রঙ। পরতেন খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মিহি ধুতি। হাতে একটি চামড়ার কলেজ ব্যাগ নিয়ে কলেজে যেতেন তিনি। এই কলেজে যাওয়ার সময় আমাকে তিনি পাশেই এক ছাত্রীর বাড়িতে রেখে যেতেন। কখনও বা স্কুলডাঙার ডাঃ লালমোহন গাঙ্গুলীর বাড়িতে রেখে যেতেন। কোনোদিন বা আমাকে আমার বড়মামার বাসাতেও রেখে যেতেন। তা না হলে মেসেই ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে আমার সারাদিন কাটতো। কলেজ থেকে ফেরার সময় বাবা আমাকে নিয়ে আসতেন। তারপর সন্ধ্যেবেলায় ছড়ার বই আর গল্পের বই পড়া চলতো। একটু রাত হলে বাবা আমাকে শম্ভুজেঠুর কাছে রেখে বেরোতেন চট্টল বেকারির পাঁউরুটি আর গরম রসগোল্লা আনতে। আজই দেখলাম তনিমা তার লেখায় চট্টল বেকারির কথা লিখেছে। তখন চট্টল বেকারির দোকানটা ছিলো একটা পুরোনো ঘর। সামনেটায় একটা ভাঙাচোরা পুরোনো শোকেস। তাতে রুটি বিস্কুট সাজানো থাকতো। দোকান যতই ভাঙাচোরা হোক না কেন, বেকারির রুটি স্বাদে ছিলো অমৃত। ঢুলুঢুলু চোখে গরম রসগোল্লার রসে ডুবিয়ে চট্টল বেকারির পাঁউরুটির স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে যেন। তখন চট্টল বানরুটি নামে একটা মিষ্টি রুটিও বানাতো। সেটা তো এমনিই খাওয়া যেতো। পরে চট্টল বেকারির মালিকের ছেলে গৌতম মিশন স্কুলে আমার সহপাঠী হয়। অনেক পরে গৌতম দোকানটাকে ঝাঁ-চকচকে আধুনিক বানায়। নানা ধরণের খাবারে এখন হাল ফ্যাশানের শোকেসগুলো ভর্তি থাকে। আমার চোখে কিন্তু আজও সেই পুরোনো চট্টলের ছবিই ভাসে। নাকে লাগে সেই আমলের রুটির মনমাতানো গন্ধ। মন ফিরে যায় সেই সেদিনে।
(আবার আসিব ফিরে)

2 comments:

  1. চোখের সামনে হারানো বাঁকুড়া

    ReplyDelete
  2. চোখের সামনে হারানো বাঁকুড়া

    ReplyDelete