Tuesday, August 23, 2016

তোমার পুজো,আমার পুজো - পুজোর ছবি :১ : মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

অনেক বছর ধরে অন্যের রিকশা ভাড়ায় চালাতো অনুপ।তার বউ আর সে মিলে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে,বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায় এই রথে কিনেছে নতুন একটা ব্যাটারী রিকশা।এই বছরের পুজো তাই অনুপ আর মালতীর কাছে 'ইস্পেশাল'।মালতীর খুব ইচ্ছে পুজোয় রিকশাটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে।যাতে যারা এই রিকশায় করে ঠাকুর দেখতে যাবে,তাদের যেন রিকশাটাও খুব পছন্দ হয়।আর অনুপের ইচ্ছে অন্তত একদিন হলেও তার রিকশায় চাপিয়ে মালতীকে ঠাকুর দেখিয়ে আনবে।

জুয়া : শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়

আমাদের চীফ্ ম্যানেজার ছিলেন কৃষ্ণ দাস ব্যানার্জ্জী: গল্পটা ওনার কাছে শোনা ।
"তখন আমি নতুন পোস্টিং এসেছি চুরুলিয়া ব্রাঞ্চে , সবার সাথে ভালো করে পরিচয় হয় নি।জয়েন করে শুনলাম গ্রুপ ডি তিন বিখ্যাত চরিত্রের অপযশের কথা । সবাই ভালোবেসে ডাকে অরুণ, করুণ কালা বলে।
একদিন রূম থেকে বেরিয়ে করিডর �দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ ক্যন্টিনের সামনে আসতেই একটা ষণ্ডাগণ্ডা চেহারার লোক হুঠ করে সামনে এসে পা ধরে শুয়ে পড়লো ।
শুধু একটা কথা বারবার বলছে ,' স্যার আমাকে বাঁচান'
আমি তো অবাক , দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ' তুমি কে?'
বললে ,'আমি অরুণ স্যার , গ্রুপ ডি , গত 15 দিন ধরে অফিস আসতে পারছি না: বাইরে অনেক ধার হয়ে গেছে । চিন্তা করি না স্যার , খেলে শোধ করে দেবো। কিন্তু এবারটা আমাকে বাঁচান স্যার । আমাকে ট্রানস্ফার করে দিতে হবে নাহলে প্রাণে বাঁচবো না স্যার '
আমি বললাম ' কি খেলো তুমি ?'
উত্তর এলো ' তিনপাত্তি, রামি ,ফ্ল্যাশ সব পারি স্যার ,15-20অবধি জিতেছি কিন্তু এবারে বড় ঝাড় খেয়েছি ।'
খানিকটা চুপচাপ আবার কঁকিয়ে ওঠে , ' কথা দিন স্যার ট্রানস্ফার করে দেবেন ।'
বললাম 'দেখি কি করা যায় ?'
সে যাত্রা আমি বাঁচিয়ে দিলেও নানান নেশায় জীবনের শেষ কটা দিন ওকে খুব দুর্দশার মধ্যে কাটাতে হয়েছিলো শুনেছিলাম ।"

জীবন যে রকম : সমীর কুমার পাত্র

অভিযোগের পাহাড় চূড়ায় বাস
বারোটামাস একই সন্ত্রাস ।
তিরস্কারের সাগর জলে স্নান
একই ভাবে দিনের অবসান ।
হাজির হই দিনের প্রথম সূর্যালোকে
কানগুলো তাও অবিশ্বাসি শোনে, এলে সবার শেষে !
তবুও জীবন আনে শ্বাস নেওয়ার ছন্দ
ছাত্রগুলো শুধায় যখন, "স্যার জিনের কোন্ টা মন্দ" !
পাহাড় প্রমাণ জীবন উপাখ্যান
কোথাও বা তার শুরু কোথাও ভাঁটার টান !

বিদেশি মুল্লুকে দেশি অবতার : দীপ্তজ্যোতি মৈত্র

পেথথম বার মার্কীন মুল্লুক যখন গেলাম, সেটা ছিল কুড়ি ঘন্টার রাস্তা...থুড়ি আকাশ!
মাঝ পথে লন্ডন এ তিন ঘন্টা র লে-ওভার(পা ছড়ানো র বিরতি),
সঙ্গে সহযাত্রী আমাদের মুম্বাই আপিস এর দুই সহকর্মী.... রাজীব আর প্রবাল!
রাজীব ভাটনগর বেশ দুঁদে কর্পোরেট খিলাড়ী, আমাদের বোমবাই কর্পোরেট আপিস এর অলিন্দে সর্বত্র তার অবাধ গতিবিধি.
আর প্রবাল মল হল আধা আকাদেমিক আর আধা কর্পোরেট এর হজবরল.ওর পূর্বজ নাকি নেপাল এর রাজ পরিবার এর সঙ্গে সেই...... কে যেন হয় গঙ্গারাম এর ....টাইপ এর রিলেশান। তাই আর কিছু থাকুক না থাকুক, বেশ একটা পেল্লাই সাইজ এর ইগো আছে।
আমরা চলেছি বিন্নেস্ ভিসা্ নিয়ে .....এই একটু মিটিং টিটিং কত্তে আর কি.... এইচ ওয়ান বা এল ওয়ান নয়.... একটা রুম এ চার জন থেকে মুড়ি আর ছাতু খেয়ে ডলার সেভ করে একটা ল্যাপটপ আর দু বোতোল জনি ওয়াকার নিয়ে ঘর এ ফেরার পাব্লিক নয়।
কম্পানী বিন্নেস ক্লাস টিকিট দেয় নি,
তাই রাজা মশাই এর মেজাজ গরম!
আমাদের টিকিট হল গিয়ে মহারাজা এয়ারলাইন মানে দেশি এয়ার ইন্ডিয়া র ফ্লাইট!
আমাদের সীট্ মিললো প্লেন এর ডানা র কাছে. কাবিন ক্রু দের কিউবিকল্ এর পাসে.... বেশ মোটাসোটা গোলগাল টাক মাথা এক কাকু কাকু দেখতে ক্যাবিন ক্রু.... তার সঙ্গে তিন জন মাসিমা পিসিমা এয়ার হস্টেস....একদম খেnto পিসির দিদি সাশুড়ির বোন!
বোরিং.... বোরিং....
এই রে... কেলো করেছে.... রাত্তির দুটো বাজে !
ঠিক আছে, বাকি গল্প কাল বলব!
পার্ট টু:
রাত্তির আড়াইটে র ফ্লাইট... ঘুম এর ত দফা অলরেডি রফা. যাই হোক সেই মাসি পিসি টাইপ বিমান বালিকা রা কিছু খাদ্দ্য-মদ্দ্য পরিবেশন করতেই একটু স্বস্তি. 
বিমান ভরতি আমেদাবাদ-সুরাত-ভদোদরা র জিগনেস্-ভাই আর রুপাল-বেন..... কেম ছো? সু ছে সেরে ততোক্ষন এ প্লাস্টিক এর প্যাকেট খুলে থেপলা আর ফাফরা র বান্ডিল বার করে ফেলেছে... আচার এর প্যাকেট হাতে হাতে রো বত্তিরিশ থেকে রো সাতচল্লিশ পরযন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে.
এটা এয়ার ইন্ডিয়া র ৭৪৭ জাম্বো জেট এর পেট এর খোল না বোমবাই এর কলবাদেভি এলাকা র এক এঁদো গলি বোঝা মুশকিল হচ্ছে.
আমাদের নেপালী রাজামশাই এর ফের মেজাজ গরম � মাত্তোর দু পাত্তোর মদ দিয়ছিলো.... থেপলা-ফাফরা র সুঘ্রাণ এ রাজামশাই এর সেই দু পাত্তোরি মৌতাত চটকে চিত্তির.�
ইতিমোধ্যে ঘড়ি তে সকাল পাঁচটা.... পেছন দিকের কোনো রো থেকে হেতাল্ বেন দীপল্ আর রুপল্ বেন দের সাথে নিয়ে "কিসন্ ভগবান" এর সংকিরতন চালু করলেন.... তাইতে গলা মেলাতে মেলাতে আমাদের দুই রো পেছনে মোটা-ভাই তার ক্যাবিন লাগেজ থেকে এক জোড়া খঞ্জনি বের করে বাজাতে সুরু করলেন� সে এক ভয়ানক শব্দোকল্পোদ্রুম!
আমাদের রো তেই আইল এর ওপাশ এর সিট এ দেখলাম এক ফিরাংগ দম্পতি কানে ইয়ার ফোন আর চোখে আই মাস্ক লাগিয়ে সেই দুর্নিবার ভক্তি প্লাবন থেকে উদ্ধার পাবার ব্যার্থ
চেসটা তে ব্যাস্ত! বেচারা! জীবনে আর কোনো দিন এয়ার ইন্ডিয়া র ফ্লাইট এ চড়বে না এটা সুনিসচ্চিত!
কাকু মার্কা সেই ক্যাবিন ক্রু কে জিজ্ঞেস করলাম... এদের থামানো যায় না? এক করুন হাঁসি হেঁসে বল্লেন না দাদা.... আমাদের ফরটি পারসেন্ট প্যাসেঞ্জার হলো গিয়ে গুজু-ভাই'স.... আর তবেই বুঝুন আমাদের অবস্থা! কুড়ি ঘন্টা এই সব সইতে সইতে কি হাল হয়! এই তো সবে শুরু... আরো কতো কিছু হবে এখনো! �
আমি ক্রু দাদা কে বল্লাম.... জাস্ট বিটুইন ইউ আন্ড মি..... আমি পাগল হয়ে গেলে কিন্তু কামড়ে দিতে পারি... তুমি চুপিচুপি আমাকে আর দুটো হোয়াইট ওয়াইন দাও.... আমি চুপটি করে ঘুমিয়ে নেই.... �

কবিতার কবিরা : চিন্ময় সিন্‌হা

কবিতায় জলে ভাসা
কবিতায় আকাশে ওড়া
কবিতায় অরণ্য বিহার
কবিতায় পাহাড় চড়া।
কবিতায় বাস্তব
কবিতায় সুখ চাওয়া
কবিতায় জীবনযুদ্ধ
কবিতায় ফিরে পাওয়া।
কবিতায় প্রেম -অপ্রেম
কবিতায় ভালোবাসা
কবিতায় শরীর বিনিময়
কবিতায় ভোরের আশা।
কবিতার প্রজাপতি
কবিতার শঙ্খচিল
কবিতার খেয়াঘাট
কবিতার সাগর সুনীল।
কবিতার ফুটপাত
কবিতার পোড়ারুটি
কবিতার ছেড়া জামা
কবিতার স্কুল ছুটি।
কবিদের প্রতিবাদ
কবিদের পা হাঁটা
কবিদের জনরোষ
কবিদের পা চাটা।
কবির আলাপ
কবির আলাদিন
কবির কল্পনা
কবিতা মৃত্যুহীন।

ভাদ্দর দিনে ভাবনা :সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

(প্রথম পর্ব )
কদিন প্যাচ প্যাচে বৃষ্টি আর গুচ্ছের গা গুলোন নোংরা জলের স্পেল চলার পর যখন সুজ্যি মামা মিচিক মিচিক করে হেসে জানান দিচ্ছে -আম্মো আছি , ব্যাগ বাগিয়ে অফিসে ঢুকতেই দেখলাম ,মুকুজ্জে দার মেঘ থম থমে বোম্বাই আমের মতো ঝুলে পড়া মুখ খানা !
----আরে কি হলো মুকুজ্জে দা ,যেই না কদিন নাগাড়ে বৃষ্টির পর ,ভাদ্রের রোদ কোহলি র মতো খেলতে নেমেছে ,আর আপনি ওমনি !.....ভালো করে লক্ষ্য করে বলি ----দাদা ,দাঁত নয়তো ?
-----নারে ভাই ,ক্রনিক ব্যাপার ,বৌ !
** ** **
দাঁত খিঁচিয়ে মুকুজ্জে দা যা বলেন তার সার মর্ম বৌদি র হাবভাব ই তার মুখের গভীর নিম্নচাপ আর ঘন্টায় একশো আশি কিমি বেগে ঘুর্নাবাত্য র প্রবল সম্ভাবনার কারন l বৌ আর দুটি কন্যারত্ন l পেছনের জানলা টা খুলতেই এক চিলতে রোদ নাকের ডগায় l আর ওমনি মনে পড়ল যে মুকুজ্জে দার এটা তো সিজিনল রোগ !প্রতি বছরই সে অতি বৃষ্টি হোক আর অনাবৃষ্টি ,যেই বর্ষা টি ছাড়ল মানে পনেরই আগস্ট টি পেরোলো আর পুজোর কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো ,অমনি দাদার আমার মুখ ব্যজার হতে শুরু করলো !
** ** **
আরও দুদিন ডিপ্রেশন চলল এরকম l তৃতীয় দিন টিফিন টাইমে আর থাকতে না পেরে আমি বিমল আর সিধু চেপে ধরলাম তোম্বা মুখে রুটি আলুভাজা খাওয়া মুকুজ্জে দা কে ,-----কেস টা কি ,এখনও কিছু বোঝা যাচ্ছে ?
-----না রে ভাই ,খুব গোপনে তিন জনে ; দাদা এমন টোনে কথাগুলো বললেন যেন আইসিসএর নতুন শাখা টি তার ঘরেই খুলেছে !গতিক খুব খারাপ রে ভাই ,গুচ্ছের খবরের কাগজ ,পত্রিকা আর ওই তোদের স্মার্ট ফোন নিয়ে ঘরে দরজা দিয়ে দিচ্ছে !শুধু বুচি মাঝে মাঝে ওর অংক খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে !বুচি হলো এইটে পড়া মুকুজ্জে দার ছোট মেয়ে ,বড়টি ফার্স্ট ইয়ার !
আমরা মুখ চাওয়া চায়ি করি ,কি স্বান্তনা দেবো !
---- ছিঁড়ে ছিঁড়ে ,এত দাদা প্লুরাল ,মানে কেস শুধু জন্ডিস নয় একদম এডিস এজিপ্টি!
-----এদিকে আমার তো ইয়ের চুল ছিঁড়ে যাবার অবস্থা !
জিগ্গেস করতে আর সাহস হয়না কিসের চুল সেটা !নাহক মাথার ই হবে l
** ** **

 (দ্বিতীয় পর্ব )
ইস্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেসল্ট বেরুবার আগের অবস্থা এরকম চললো কদিন ধরে l জনি ,বৌদি ঐসময় খুব গোপনে ,সংগোপনে ,পুজোর বাজার মানে শপিং এর লম্বা ফর্দ বানিয়ে চলেছেন কদিন ধরে ,দুই দুহিতা কে নিয়ে l সেই কাগজে সাবর্ণ চৌধুরী দের বাড়ি কাঠামো পুজোর খবর যেদিন ছাপা হয় ,সেদিনই গোপন বইঠকের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যায় !গত বারেও অত বড় সত্যিটা গোপন ছিলনা ,ওর হৃদয় ছল ছলিয়ে আমাদের সবাইকার এমনকি অফিসের যে লিফট ম্যান সেউপরসাদ তার ও কান হয়ে কলিজা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিলো l সে ব্যাটা ও বিকেলে অফিস ভাঙ্গার সময় লিফটে মুকুজ্জে দা উঠলেই অন্যদের শুনিয়ে শুনিয়ে পুছতো খইনি ডলতে ডলতে -----এত বড়া !সত্যি ?
** ** **
এই ভাবে দাদার পালপিটেসন বাড়তে থাকে ,বাড়তেই থাকে l সুন্দরী গোলগাল বৌদির এমনিতে দাদা খুবই নেওটা !কিন্তু পুজোর ঢাকে কাঠিটা পড়ল কি দাদা শাহরুখ খান আর বৌদি মার্কিন কাস্টমস ,কোন বিশ্বেস নেই !একেবারে ফাইনাল পর্যায়ে,বৌদি অ্যান্ড কোঙ্ দয়া করে লিস্টি টি দেখিয়ে কিতাথথ করে একটা এস্টিমেট দাদার কাছে ক্লেম করে বসে l দাদা তখন হাড়িকাঠে গলা ঢুকিয়ে ফেলা অবলা জীবের মতই দার্শনিকতা র নেশায় আচ্ছন্ন থাকে ,দাদার ভাষায় ------মানি বিল রে ভাই ,আমি কোথাকার ছা পোষা প্রণব মুখুজ্জে ,একবার রিফিউজ দুবার রিফিউজ ,তাপ্পর সই তেই হয় ,মানে সই দিতেই হয় আর কি .....
সই বা সায় দিলেই দুই মেয়ে কে বগল দাবা করে বৌদি চলেছে যুধ্ধে!ক্রমশ ক্রমশ যত ফাইনালের দিকে,এগিয়ে যায় পুজো ততই বেরুবার মানে বাজার যুধ্ধের ফ্রিকয়েন্সি বাড়ে !শুনেছি দুএকটা ছুটির দিন দাদা কেও নড়া ধরে টেনে নিয়ে যায় বৌদি ,মুখে বলবে ----আমারও তো একটা পেস্টিজ বলে আছে নাকি ,লাহিড়ি দি ,পাশের পড়ার কুসুম ,সব্বাই কেমন হাজব্যান্ড নিয়ে সাজুগুজু করে শপিং কোচ্ছে,ওগো হ্যাঁগো কোচ্ছে আর আমি কিনা পাশ খালি করে ....l আসল উদ্দেশ্য ,দাদাই বলেছে ------বুঝলিনা ,যদি এক কোপে গলা টা ধড় থেকে না ছাড়ে তবে আরেক কোপ .. ,আর তাছাড়া কুলি টুলি করে বাড়তি পয়সা কে দিতে চায় বল ?
** ** **
শুক্কুরবারেও অবস্থা র বিশেষ উন্নতি দেখলাম না !মুকুজ্জের মুখ লাল পিলা হয়েই চলেছে ,জিগ্গেস করতে দেখলাম পুরো মেন্টাল !বললো -----আমি শালার পেছন ফুটো আন্ডারপ্যান্ট পরে তিন মাস চালাচ্ছি আর মাগীরা কিনা লম্বা চওড়া লিস্টি ,আজ গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করেই ছাড়বো দেখেনিস ,তানা শাহী নেহি চলেগা বাবা !বলতে বলতে হাঁটা দিলো l
সিধু অস্ফুটে বললো দুগ্গা দুগ্গা !
** ** **
 (শেষ তথা আন্ডার প্যান্ট পর্ব )
সোমবারের শ্যাওড়াফুলী লোকাল ঠেঙ্গিয়ে অফিসে ঢুকতে লেট হয়ে গেলো l তার ওপর ভাদ্রের চিড়বিড়ানী গরম l ঢুকে দেখি মুকুজ্জে দার টেবিলে র সামনে ছোট খাটো ভিড় ,আর ফাঁকে ফোকরে নজরে আসছে দাদার উজ্জল মুখ খানি l কি কেস রে সিধু ?এত ব্যাপক চেঞ্জ !বলতে বলতে যথা সময়ে নাক গলাই আমি l মুকুজ্জে দার এত মেঘমুক্ত ঝলমলে মুখ গত এক হপ্তায় নজরে আসেনি l 
----কি করে হলো ?
----এবার তাহলে নো লিস্টি !
দাদা বেশ মৌজ করে একটা চোখ আধবোজা রেখে রামদেব স্টাইলে বললো ,-----লিস্টি তো আছেই , সেই পেছন ফাটা আন্ডারপ্যান্ট দেখিয়েই কামাল !হুঁ হুঁ বাওয়া !
আমরা হতবাক !ফিচেল সিধু বললো -----সেকী দাদা ,ওই প্যান্ট পরে আপনি বৌদির সামনে ,সে না হয় হোক ,কিন্তু ঘরে আপনার দু দুটি সোমথথ মেয়ে ,তাদের সামনে ....
------আরে না রে বাচ্চু !ঘরে বর্ষায় কাপড় মেলবার জন্য যে তার টাঙ্গানো আছে ,তাতে বেশ খোলসা করে টাঙ্গিয়ে দিলাম ,আর তাতেই সিদ্ধি লাভ ! বলে বেশ মাতব্বরি চালে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আমাদেরই ------সব পুজোর আগে কোন্ পুজো হয় ,বলতো ?
বললাম------ গণেশ !গণেশ !কিন্তু লিষ্ট কি এবার সংক্ষিপ্ত? ,মাসির শাশুড়ি ,শালীর ননদ ,তস্য ভাজ ,নেই নাকি ?পিঙ্গা পিঙ্গা লাহাঙ্গা ,চতুষ্কোণ টপ ,জামাই চারশোবিশ জিন্স ...বাপের জন্মে না শোনা নাম গুলো আমি এক নিশ্বাসে আওড়ে ফেলি l দাদা দেবদিদেব মার্কা হাসি দিয়ে টেবিলের তলায় ব্যাগ হাতড়ে বার করে দু পাতার লিষ্ট !সেই ! সেই ! হুমড়ি খেয়ে পড়ি আমরা --লিষ্ট দেড় পাতা ,বুচি র খাতার পাতায় ,একদম উপরে লেখা জ্বল জ্বল করছে বুচিরই হাতে র "বাবার নোতুন আন্ডারপ্যান্ট "
-----মানে ?
-----রাহু ধৈর্যঙ্!দাদা বুক খানা ঢাউস করে শেষ বাক্যটি ছাড়েন ----- তোদের বৌদি কথা দিয়েছে আমার ওই বস্ত্র টি না কিনে পুজো শপিং শুরু করবেনা ,যেমন সব পুজোর আগে সিধ্ধি দাতায় নমহ্ !
ঝপাঝাপ করে আমাদের কিউরিওসিটি র পারদ গুলো নামতে থাকে এবার l তবুও গলা ঝেড়ে জিগ্গেস করি ----ব্যাস এতেই আপনি খুশ ?
এবার দাদার অন্য মূর্তি ,বলে ------আচে !আরো আচে !চোখ গুরুদেবের মতই ,টিউব লাইটের স্টার্টার এর মতো মিট মিট করে ------কাল বুচি তো ওর দিদির সাথে শুলো ,বলেই আবার চোখ পাকায় ------যাও যাও , তোমরা সবাই এখনও ছাঁদনা তলায় যাওনি, এসব কথা তোমাদের শুনে কাজ কি ?
এর পর মুকুজ্জে চর্চা আর জমে না
** ** **
মুকুজ্জে বৌদি যে কোন্ কোন্ অস্ত্রে কুপোকাত করেছেন দাদা টিকে ,ভাবতে ভাবতে নিজের টেবিলে ফিরে আসি l পেছনে পেছনে বিমল ,বাঁকড়ো না বীরভূম দেশের আদত বাসিন্দা ,বলে ওঠে -----ইয়াদের কি হবেক গো !
ভাববার কথাই !
স . মা

কলেজের রিডিংরুম : রূপক সামন্ত

সেটা ১৯৮৬ সালের কথা। আমি তখন সাম্মানিক পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনা কলেজ ট্যাঙ্কে বিসর্জন দিয়ে মেতে আছি ক্যান্টিনে, গাছতলায়, ছাত্র-সংসদ ঘরে, টিটি খেলার ঘরে, কলেজ মোড়ের আর রাণিগঞ্জের মোড়ের জমাটি আড্ডায়, ব্রাউন ছাত্রাবাসের নানা কুকীর্তিতে আর রাত গভীরের চণ্ডিদাস বীণাপাণি সিনেমায়। সংসদের চিপ স্টোর আর চিপ ক্যান্টিন সামলাই। সংসদের যাবতীয় কলম-চালনা কাজের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ন্যস্ত। এসব নিয়ে আমি সদা ব্যস্ত এবং উদ্ব্যস্ত। ভালোই চলছিলো দিনগুলো। একদিন কি কারণে যেন লাইব্রেরীতে ঢুকেছি পিছনের দরজাটা দিয়ে। আমাদের বিভাগের নিজস্ব লাইব্রেরীতে সাম্মানিকের বই সব পেয়ে যাওয়ার কারণে প্রধান লাইব্রেরীতে কমই যেতাম। যাইহোক ভিতরে ঢুকে নজর পড়লো বেশ কিছু বই এখানে ওখানে ডাঁই করে রাখা আছে। তার উপর কয়েক পরত ধূলো জমেছে। বেশ কিছু বইতে জল লেগে খুব সঙ্গীন দশা। বোঝা গ্যালো যে বইগুলো অনেকদিন ধরে ওইভাবেই পড়ে আছে। বই পড়ি বা না পড়ি বাবার কল্যাণে ছেটোবেলা থেকেই বইএর প্রতি একটা দুর্বলতা ও মমত্ব আমার বরাবরই ছিলো, আজও আছে। বইগুলো দেখে খুব কষ্ট হোলো। নানা বিষয়ের অমূল্য সব বই। পদার্থবিদ্যার বইও আছে দেখলাম। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, কি করবো বলো। রাখার জায়গা নেই। সত্যিকথা। সব আলমারি, তাক বইয়ে ঠাসা। তবু বললাম, এভাবে নষ্ট হবে তাবলে। উনি বললেন, আমার কিছু করার নেই। তোমরা সংসদ থেকে দ্যাখো কিছু করতে পারো কি না। অন্তত একটা রিডিং রুমও যদি করতে পারো তো ভালো হয়। সংসদ ঘরে এসে বললাম কথাটা। তখন পবন সেলামপুরিয়া সভাপতি, জহরদা সাধারণ সম্পাদক আর শান্তিময় চন্দ ( লালুদা ) কোষাধ্যক্ষ। লালুদাও আজ আর নেই। বহুকাল আগেই আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছে। যাই হোক সংসদে আলোচনা হতে লাগলো কি করা যেতে পারে। আলোচনায় বেরোলো যে লাইব্রেরীর পিছনে যে একতলা বাড়িটায় তখন অর্থনীতিবিদ্যার পঠনপাঠন হোতো সেই বাড়িতে একটা বড়ো হলঘর অব্যবহৃত পড়ে আছে। ঠিক হোলো ওখানেই হবে রিডিং রুম। ওটাই রিডিং রুমের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা। তখন ডি বি পাল স্যার আর হরিসাধনবাবু মিলে জোড়াতালি দিয়ে কলেজ চালাচ্ছেন। হরিসাধনবাবু অস্থায়ী অধ্যক্ষ হয়ে আছেন। সংসদ থেকে স্যারেদের বলা হোলো বিষয়টা। বেশ কিছু আলাপ আলোচনার পর স্যারেরা রাজি হলেন। ঘরটা খুলে পরিষ্কার করা হোলো। কিছু হাইবেঞ্চ আর লো বেঞ্চের ব্যবস্থা হোলো। বিদ্যুতের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা হোলো। আমি, চন্দন, বিকাশ, সুমনজিৎ, স্পর্শ, সোমনাথ সুরাল, সঞ্জীব নামহাতা, শক্তিশঙ্কর সিংহমহাপাত্র, সুভাশিষ পাল ও আরও কেউ কেউ মহানন্দে বই বইতে শুরু করলুম। লাইব্রেরী থেকে বইগুলো এনে ঝেড়ে মুছে আলমারীতে সাজানো হোলো। খুব আনন্দ আমাদের। বিরাট যুদ্ধই জয় করেছি যেন একটা। স্যারেরা দেখে খুব প্রশংসা করলেন পিঠ চাপড়ে। বান্ধবীরা বললে, বাব্বা তোরা তো দেশসেবায় নেমেছিস দেখছি। ছিনে বুকটা সাতহাত ফুলে উঠলো যেন। মোট তিনদিন ধরে বেশ কিছুক্ষণ করে খেটে সাজিয়েছিলুম সেই রিডিংরুম। শেষদিনে স্যারেরা কলেজের তরফ থেকে চা বিস্কুট খাইয়েছিলেন মনে আছে। সে কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারবো না আজ। মাঝে মাঝে সেই রিডিংরুমে যেতাম। এটা ওটা পড়তাম। গল্প করতাম। আর মনে মনে গর্ব করতাম যে এই রিডিংরুমটা আমরা সাজিয়েছি। আজও আছে কী সেই রিডিংরুমটা??

সোমনাথ সুরাল : রূপক সামন্ত

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মিশন স্কুলের বেড়া টপকে সাম্মানিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হলাম খ্রিস্টান কলেজে। প্রচুর বাধানিষেধের জীবনটা হঠাৎ করে পুরোপুরি লাগামছাড়া হয়ে গেলো। রজত সঞ্জীব দীপ্ত অরূপ নন্দিতা অরণি সুভাশিষ বিকাশ শ্যামা সুমনজিৎ এসব পুরোনো বন্ধুরা তো ছিলই, নতুন করে বন্ধুত্ব হল ইন্দ্র প্রভাত চন্দন স্পর্শ অমিত শক্তি জ্ঞানবিকাশ সোমনাথ সুরাল ও আরও অনেকের সঙ্গে। কলেজ মাঠে, কলেজমোড়ের ঠেকে এবং আরও নানা জায়গায় আড্ডা জমে উঠলো। সেইসঙ্গে পড়াশোনা উঠলো লাটে। এদের মধ্যে সোমনাথ সুরালের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। সোমনাথ সুরালের চেহারাটা ছিল বেশ তাগড়াই। মুখে হাসি লেগেই থাকতো। আর প্রচুর লম্বা চওড়া কথা বলতো। যাকে চাটি মারা বলে আর কি। ব্যাস আর যায় কোথা। ওর প্রায় প্রতিটা কথা ধরে ওকে রাগানো শুরু হয়ে গেলো। ওকে ফেঁপো বলে ডাকতে শুরু করলাম আমরা। বিকাশ আবার মিচকে হেসে সুর করে সুরোল বলে ডাকতে আরম্ভ করলো। সেই দেখে আমরাও ওকে ফেঁপো সুরোল বলে খ্যাপাতে শুরু করলাম। কি রেগে যেতো ছেলেটা। তেড়ে মারতে আসতো। দুএকবার পিঠে ঘা ও পড়েছে বৈকি। আমাদের তাতে দুগুণ মজা। আরও বেশী করে রাগাতাম। তবে সুরাল খুব সরল মনের ছেলে ছিলো। মাঝেমাঝেই আমাদেরকে দাদুর দোকানে চা আর লঙ খাওয়াতো। সেইসঙ্গে পান আর সিগারেট। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরাল সক্রিয়ভাবে অংশ নিতো। আমরা একই রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলাম। সেসব কাজেও সবসময় সুরালের সক্রিয় প্রাণবন্ত উপস্থিতি থাকতো। ঠিক ভুল যাই হোক না কেন সুরাল কিছু একটা বলবেই। আর ওর বলা মানেই শুরু হয়ে যেতো পিছু লাগা। তার থেকে ঝগড়া। তারপর আবার মান অভিমান ভুলে যেই কে সেই হতে সুরালের বেশী সময় লাগতো না। ক্যারাম আর টিটি খেলতে খুব ভালোবাসতো সুরাল। একবার নাটকেও অংশ নিয়েছিলো। দারোগার পার্ট। যতদূর মনে পড়ছে রবীন্দ্রভবনে চিরন্তনের ব্যানারে নাটকটা হয়েছিলো। তো সুরাল ধরাচূড়া পরে স্টেজে এন্ট্রি নিলো। আমি প্রম্পটার। সুরালকে পার্ট ধরিয়ে দিচ্ছি। সুরাল কিন্তু কিছু বলছে না। কি হল ব্যাপারটা! তাকিয়ে দেখি ও পকেট থেকে একটা কিং সাইজের সবুজ রঙের MORE সিগারেটের প্যাকেট বেশ কায়দা করে বের করছে। তারপর সেটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটের এককোণে দারুণ কায়দা করে লাগালো। আমি তো থ। সহঅভিনেতা ডায়ালগ ভুলে হাঁ করে সুরালের কীর্তি দেখছে। সুরালের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আর এক পকেট থেকে বের করলো একটা দেশলাই। বেশ কায়দা করে ধরালো সিগারেটটা। এদিকে তখন দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গ্যাছে। কেউ একজন তো চেঁচিয়ে বলে উঠলো- এই সুরাল, ডায়ালগ বল না বে। সুরাল নির্বিকার। কলেজের স্যারদের সামনে আর মেয়েদের সামনে কেতা দেখানোর সুযোগ কি আর ছাড়ে সে! পায়চারী করতে করতে সিগারেটে টান দিয়ে গোটাদুয়েক রিঙ ছেড়ে সুরাল ডায়ালগ দিলো-- হ্যাঁ বলুন এবার। কি আপনার সমস্যা। সহঅভিনেতা পার্ট ফার্ট ভুলে থতোমতো খেয়ে সে এক কেংকেলাস অবস্থা। পরে আমরা তো সুরালকে এই মারি তো সেই মারি করছি। সুরালের ঝাঁঝালো জবাব- বেশ করেছি। আমার সিগারেট আমি খেয়েছি তো তাতে কার বাবার কি? ১৯৮৯ সাল থেকে বাঁকুড়া ছাড়ার পর সুরালের সঙ্গে আর দেখা হয়েছিলো কি না মনে পড়ছে না। যোগযোগও আর ছিলো না। পরশু কস্তূরী মন্তব্য লিখতে জানলাম বছর পাঁচেক আগেই সুরাল সব পাট চুকিয়ে চিরতরে চলে গ্যাছে। রয়ে গ্যাছে ওর ছবি আর কিছু স্মৃতি।

বিশ্বমিত্র জহরদা : রূপক সামন্ত

কাল থেকে খুব জহরদার কথা মনে পড়ছে। অজস্র স্মৃতি নিয়ে আমি বয়ে চলেছি। সে তো এসবের ধার ধারতো না। তাই ই ফুড়ুৎ। সঙ্গের ছবিটা ১৯৮৬ সালের। কলেজ প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর গাড়িবান্দায় ক্লান্ত হয়ে বসে আছি দুজনে। ছবিটা তুলেছিলো জহরদার দাদা পার্থ সিং। বাঁকুড়ার যীশু / রুদ্র বোস সদ্য যুবা তুমি তখন অপাপবিদ্ধ চোখ আর রেশমি কোমল দাড়িতে তোমাকে যীশুর মতো লাগতো তোমার হাসিতে উছলে পড়তো আলো খদ্দরের পাঞ্জাবি পায়জামায় হেঁটে গেলে হৃদয় ছুঁয়ে যেতো মাতাল বসন্ত বাতাস এক তরুণ বিস্ময়-চোখে দেখতো তোমাকে সুযোগ পেলেই দিন নেই সুলুক নেই অষ্টপ্রহর ছায়াসঙ্গী তোমার জেনে নিতো জীবন কাকে বলে কেমন করে ভালোবাসতে হয় মানুষকে কারণে অকারণে ছুঁয়ে দেখতো তোমাকে- মানুষ তো! না কি মর্ত্যের ঈশ্বর! কলেজ মোড়ের আড্ডায় গেলাসের গরম চা এ ছাতিমতলার আলোচনায় ব্রাউন নাইট স্কুলে রক্তদানে স্লোগানে মিছিলে টিটি রুমে, ক্যান্টিনে কিংবা ইউনিয়নরুমের বিতর্কে সেই নাছোড়বান্দা তরুণ তোমার বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা সব পাখি ঘুমিয়ে পড়লে কান্তিদার বিচিত্র আড্ডায় ক্লান্তি ভুলে তোমার সঙ্গী সেও রাত বারো বেজে যায়, তবু হোস্টেলে ফেরার নেই কোনো তাগিদ কেনই বা ফিরবে বলো ছেড়ে জীবনের অমৃত আস্বাদ! রাত গভীর হলে রেললাইন টপকে চড়াই পথে বিড়ির টিপটিপ আলোয় ঘরে ফেরা, নিতান্ত ফিরতে হয় বলে গান ছড়িয়ে পড়ে জোছনা-প্রান্তরে- মোর মন যে গায় ঘরে ফেরার সুর তারপর ভাগাভাগির রুটিতে মরে যাওয়া খিদে মিটিয়ে নির্ভেজাল ঘুম নামতো চোখে সেসব দিন আজ কোন স্বপনের পার সবাই ব্যস্ত দেখি নিজ নিজ কুম্ভীপাকে সেই তরুণও পৌঢ় আজ, পলিতকেশ ফাগুনের শিমূলে পলাশে অশোকে তবু আনমনে খুঁজে ফেরে তোমাকে- বাঁকুড়ার যীশু কে জীবনের শেষ পাঠ বাকি রয়ে গ্যাছে শেখাবে সময় হলে- কথা ছিল তাই পেরিয়ে অগুন্তি অমাবস্যা গতরখাকি আরও কত যে বাকি হয় নি কি সময় এখনও!!

১৪/৪/১৬ ১ লা বৈশাখ

চুরা লিয়া হ্যায় : রূপক সামন্ত

খ্রিস্টান কলেজের ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল রুমে আপনারা তো সবাই ঢুকেছেন মনে হয়। এই রুমের মধ্যেই একটা ছোট ঘরে ফিজিক্সের স্যাররা বসতেন। এই রুমের সঙ্গেই আর একটা রুম আছে যেটা অনেকেই জানেন না হয়ত। দরজা দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটা অ্যান্টিরুম। পরদা ফেলা থাকতো। বাইরে থেকে বোজা য়ায় না সহজে। সেই রুমে সব জানালা বন্ধ থাকতো আর সবসময় কালো পর্দা ফেলা থাকতো। ুটটা ডার্করুম, Light এর প্র্যাকটিক্যাল হত এখানে। সেটা ১৯৮৮ সাল। আমি তখন থার্ড ইয়ার। ফিজিক্সের প্র্যাকটিক্যাল চলছে। আমি বাইরে বেরিয়ে চা সিগারেট খেয়ে আড্ডা মেরে আবার ঢুকছি। বাইরে থেকে ঢুকছি বলে আরও অন্ধকার লাগছে। আমি মেজাজে গান গাইতে গাইতে ঢুকছি- চুরা লিয়া হ্যায় ম্যাঁয় নে যো দিল কো / নজর নেহি চুরানা সনম। বাইরে কোনো ললনাকে দেখে মনে পুলক জেগেছিলো হয়ত। বেশ খুশ মেজাজ। হঠাৎ একটা গম্ভীর ধমক- এই কে রে। গান গাইতে হলে মাঠে যা। এই মরেছে। অমিতবাবু। কখন এসে ঢুকেছেন কে জানে। কাউকে প্র্যাকটিক্যাল দেখাচ্ছেন হয়ত। আমি আর থাকি সেখানে। সুড়সুড় করে বেরিয়ে দে হাওয়া।
আজও মনে পড়লে খুব একচোট হাসি।

১৩/৪/১৬

মাননীয় শ্রী বিজয় গোয়েল( ক্রীড়া মন্ত্রী,ভারত সরকার ) সমীপেষু : যশোবন্ত্ বসু

মাননীয় শ্রী বিজয় গোয়েল( ক্রীড়া মন্ত্রী,ভারত সরকার ) সমীপেষু, খবরে প্রকাশ,রিও-তে অলিম্পিক গেম্‌সের স্টেডিয়ামে দলবল নিয়ে আপনি যখন প্রবেশ করছিলেন,গেটের নিরাপত্তারক্ষীরা আপনাদের আটকে দেন। সঠিক পরিচয়পত্র না নিয়েই আপনারা নাকি বেআইনি ভাবে মাঠে ঢুকে পড়তে যাচ্ছিলেন । ভারতের যে-কোনও স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়া আর অলিম্পিক গেম্‌সের স্টেডিয়ামে ঢোকার মধ্যে নিয়মনীতির যে-ফারাক আছে,মন্ত্রিত্বের দম্ভ ও অহমিকায় সম্ভবত আপনার সেটা মাথায় ছিল না।
গোঁসা হয়েছিল খুব,তাই না ? পরে কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতা ও সৌজন্যে সেই খিঁচটুকু মিটে যায় এবং আপনিও সপার্ষদ মাঠে ঢুকে আন্তর্জাতিক মানের খেলাগুলি দেখতে পান। কিন্তু কী দেখে ফিরলেন আপনি ? পৃথিবীর সবচেয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ভারতীয় ক্রীড়াবিদ্‌দের হতাশাজনক পারফর্ম্যান্স ? আপনিতো দীপা কর্মকারকে দেখেছেন ? দীপা কিন্তু আপামর ভারতবাসীকে প্রকৃত অর্থেই ভীষণ গর্বিত করেছেন।অভিনন্দন জানিয়েছেন তো মেয়েটিকে ? আপনি কি জেনেছেন যে, এই মেয়ে ইতিমধ্যেই নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ৬৭টি স্বর্ণপদকসহ ৭৭টি মেডেল জিতে নিয়েছেন,নিজের কৃতিত্বে ? হ্যাঁ,নিজের কৃতিত্বে। কারণ দীপা তাঁর প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রায় কিছুই আপনার মন্ত্রক তথা আপনার সরকারের কাছ থেকে পান নি।দীপার কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী তাঁর একক প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত আন্তরিকতায় দীপাকে আন্তর্জাতিক স্তরের জিমন্যাস্ট তৈরি করে তুলেছেন। মতি নন্দীর সেই বিখ্যাত 'কোনি ' উপন্যাসের আশ্চর্য চরিত্র ক্ষিত্‌দার কথা তো আপনি জানেন না,জানার কথাও নয়। কিন্তু এই খবরটি কি আপনি জানতেন যে,চোটের কারণে দীপাকে একবছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যথার ওষুধ খেতে হয়েছে ,চোটের মোকাবিলা বা ইঞ্জুরি ম্যানেজমেন্টের জন্য দীপার কোনও নিজস্ব ফিজিয়োথেরাপিস্ট ছিল না বলে ? পরে অবশ্য তাঁর এক ফিজিয়োথেরাপিস্ট জোটে। কিন্তু সেই ফিজিয়োথেরাপিস্টকে দীপার সঙ্গেই ব্রাজিলে না পাঠিয়ে অনেক পরে পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। যে-সরকার আপনাকে দলবলসমেত অক্লেশে অলিম্পিক্স দেখতে পাঠাতে পারে,সেই সরকার দীপার নিজস্ব ফিজিয়োথেরাপিস্টকে তাঁর কাছে পাঠাতে কেন এত দেরি করে ,তার কোনও উত্তর আছে আপনার কাছে ? দীপা যখন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেছিলেন তখন তাঁর পায়ে জুতো ছিল না।গায়ে অন্যের কাছ থেকে ধার-করা ঢিলা কস্টিউম। ভল্ট অনুশীলন করেছেন স্প্রিং বোর্ড নয়,পুরনো স্কুটারের সিট দিয়ে ! অবহেলা ও অবজ্ঞার এই গল্পগুলো জানেন আপনি ? শুধু ধনী দেশগুলোই নয়, দক্ষিণ আমেরিকা বা পূর্ব ইউরোপের গরিব দেশগুলিও তাদের ক্রীড়াবিদ্‌ প্রতিযোগীদের যেসব সুযোগসুবিধা দেয়,আপনার ভারত তার অর্ধেকও যদি দিত ! একজন সফল প্রতিযোগী যখন পদক নিতে ভিক্‌ট্রি স্ট্যান্ডে ওঠেন তখন তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও নৈপুণ্যের পাশাপাশি পুষ্টি,চিকিৎসা ও নানা বিশেষজ্ঞের এক অদৃশ্য দলও তাঁর সঙ্গে পদক নিতে ওঠে। পৃথিবীর প্রথম চারজন জিমন্যাস্টের মধ্যে একজন হওয়া দীপার সেসব ছিল কিনা খবর নিয়ে দেখেছেন ? দীপার শুধু প্রচণ্ড জেদ ছিল,নিষ্ঠা ছিল,খেলাটার প্রতি অদম্য প্যাশন ছিল আর বিশ্বেশ্বর নন্দীর মতো একজন কোচ ছিলেন এবং থাকবেনও। দীপার লড়াই এখনও থামেনি।হাঙ্গেরির বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ,কমন্‌ওয়েলথ্‌ গেম্‌স এবং এশিয়াডের জন্য আমাদের এই গর্বের মেয়েটিকে আমরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা উজাড় করে দেব। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়,আপনি বা আপনার সরকার কী দেবেন ? ঠিক কীভাবে পাশে দাঁড়ালে ' অচ্ছে দিন ' শব্দবন্ধের একটা বলার মতো মানে দাঁড়ায় ? ( যশোবন্ত্ বসু । ১৭-০৮-২০১৬ )

১৫ আগষ্ট (পঞ্চম পর্ব) : রূপক সামন্ত

আজ একজন সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকে এই মানুষটির অবদান কম ছিলো না। তাঁর নাম আজ ভারতবাসী প্রায় ভুলেই গ্যাছে। তাঁর নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে ছোটো ছেলে তিনি। অল্পবয়সেই মাতৃহারা। তাঁর জন্ম হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছে খন্নিয়াম গ্রামে, ১২৬৭ সনের ১-লা ফাল্গুন ( ১৮৬১ খ্রি.)। ভবানীচরণ নামে অবশ্য তাঁকে কেউই চেনে না। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামে অবশ্য তাঁকে কেউ কেউ মনে রেখেছেন আজও।
ছোটেবেলা থেকেই পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। বিশেষ ইংরেজি ভাষায় তাঁর অসামান্য দখল ছিলো। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভাটপাড়ার টোলে সংস্কৃত সাহিত্য ও ব্যাকরণে অসামান্য বুৎপত্তি লাভ করেন। অসাধারণ শারীরিক শক্তির অধিকারী এই মানুষটির কুস্তি, জিমনাস্টিক, লাঠিখেলা, ক্রিকেটখেলায় খুব উৎসাহ ছিলো।
তখনকার দিনে আর্মানী, ফিরিঙ্গি, গোরা ইংরেজরা এদেশীয় নারী পুরুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতো। একবার চুঁচুৃঁড়ায় এরা স্ত্রীলোকদের উপর খুব খারাপ ব্যবহার করে। ভবানীচরণ পাড়ার ছেলেদের নিয়ে তাদের উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদের কোট- প্যাণ্ট ছিঁড়ে, মাথার টুপি কেড়ে নিয়ে, বেধড়ক পেটানো হয়। এরপর থেকে এমন কাজ করার সাহস তাদের আর হয় নি।
বিচিত্র মানুষ ছিলেন এই ভবানীচরণ ওরফে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। দেশের প্রতি তাঁর ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা। একই সঙ্গে একই তীব্রতায় ধর্ম ও দেশের কাজের আবেদন তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছিলো। কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে এসে তিনি বেশ কিছুদিন ব্রাহ্মধর্মের প্রচার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরে প্রোটেষ্টান্ট ও ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, জব্বলপুরে হিন্দুধর্মের আদলে মঠ স্থাপন, বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর ধর্মীয় কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য মাত্র সাতাশ টাকা সম্বল করে বিলাতযাত্রা- এমন নানা বিচিত্র ধর্মীয় কাজ করেছেন এই অশান্ত ঝোড়ো প্রকৃতির মানুষটি।
ব্রহ্মবান্ধব প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতেন যে ইংরেজদের অত্যাচারের জবাবে পাল্টা মার দিতে হবে। তাঁর বিপ্লব ছিলো আনন্দমঠের সন্ন্যাসী সত্যানন্দের ন্যায় তরবারির বিপ্লব। মাত্র ষোলো- সতের বছর বয়সে কংগ্রেস সভাপতি
আনন্দমোহন বসুর মুখের উপর বলেছিলেন- not through pen but through sword। ওসব ' কলমবাজিতে হইবে না-তলোয়ারবাজিতেই ভারত উদ্ধার হইবে।' মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ তখন বাগ্মীতায় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে ' মুকুটবিহীন সম্রাট'। তাঁরা তখন সংবিধান- সম্মত বৈধ আন্দোলনের পথে কংগ্রেসকে পরিচালনা করছেন। ব্রহ্মবান্ধব সুরেন্দ্রনাথের মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন না। তিনি চাইতেন সমগ্র ভারতবাসীর সমবেত চেষ্টায় দেশ শৃঙ্খলামুক্ত হবে এবং তারজন্য বোমাবারুদ গুলিগোলা লাঠি-তরবারি সব কিছু প্রয়োগ করতে হবে। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে বিয়ে সংসার না করে দেশের কাজে জীবন নিয়োগ করবেন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মাত্র সতের বছর বয়সে কলেজের পড়া ছেড়ে তিনজন সঙ্গীর সাথে দশটাকা মাত্র সম্বল করে গোয়ালিয়র রাজ্যের সেনাপতির কাছে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য রওয়ানা দিলেন। অনেক কষ্ট সহ্য করে গোয়ালিয়র পৌঁছলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোলো না। বাড়ির লোকে খবর পেয়ে তাঁদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনলেন। পুনরায় বিদ্যাসাগর মশায়ের কলেজে পড়াশোনা শুরু করলেন।
হলে কি হবে, তাঁর মনে সবসময় সেনাদল গঠন করে ইংরেজ তাড়ানোর ইচ্ছা কাজ করছে। আবার মাত্র ত্রিশ টাকা সম্বল করে একাই গোয়ালিয়রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তিনি। আগ্রা হয়ে বোলপুর গিয়ে সেখান থেকে উটের গাড়িতে চললেন গোয়ালিয়র। এবার গোয়ালিয়রের সেনাপতির সাথে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হোলো। সেনাদল গঠন করার সাধ কিন্তু পূর্ণ হোলো না। ফিরে এলেন কলকাতায়।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিনা বেতনে ছাত্রদের পড়ানোর জন্য 'সারস্বত আয়তন' প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। উদ্দেশ্য- প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের আদর্শে নবভারতে ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এইসময়েই রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু হোলো। সেই সময় ব্রহ্মবান্ধব তাঁর সম্পাদিত Twentieth Century পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য কাব্যের কবিতাগুলির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন - "তিনি তাঁর কয়েকটি অনুগত শিষ্য ও ছাত্র নিয়ে আশ্রমের কাজে প্রবেশ করলেন।-- তখন উপাধ্যায় আমাকে যে গুরুদেব উপাধি দিয়েছিলেন, আজ পর্যন্ত আশ্রমবাসীদের কাছে আমাকে সেই উপাধি বহন করতে হচ্চে"। বস্তুতপক্ষে ব্রহ্মবান্ধবের ন্যায় কর্মযোগীর সহায়তায় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয় ও আশ্রম গঠনের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথকে 'বিশ্বকবি' আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন-' বিদেশিরা যদি কোনদিন বাংলা ভাষা শেখে তা হলে তারা তা শিখবে শুধু রবীন্দ্রনাথের জন্যই'।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৫-ই জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফেরার পথে হাওড়া স্টেশনে নেমেই তার আগের দিন, ৪-ঠা জুলাই, যে বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়েছে সেই সংবাদ পান। বিবেকানন্দের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য বিলাত যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মাত্র সাতাশ টাকা সম্বল করে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৫-ই অক্টোবর তিনি বিলাত যাত্রা করলেন। সেখানে অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্তের ব্যাখ্যা করলেন তিনি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের 'বড় বড় অধ্যাপকেরা আমার ব্যখ্যান শুনিলেন ও হিন্দু অধ্যাপক নিযুক্ত করিয়া বেদান্ত-বিজ্ঞান শিক্ষা করিবেন বলিয়া স্বীকার করিলেন' - লিখেছেন ব্রহ্মবান্ধব নিজেই। বিবেকানন্দের প্রতিনিধিস্বরূপ বেদান্ত প্রচার করে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে দেশে ফিরে এলেন তিনি।
বিবেকানন্দের সঙ্গে একবার হেদুয়ায় দেখা হয়েছিলো তাঁর। তাঁর ভাষাতেই শোনা যাক সে বৃত্তান্ত-" আমি বলিলাম - ভাই চুপ করিয়া বসিয়া আছ কেন। এখন - এস একবার কলিকাতা সহরে একটা বেদান্ত-বিজ্ঞানের রোল তোলা যাউক। আমি সব আয়োজন করিয়া দিব তুমি একবার আসরে আসিয়া নামো। - বিবেকানন্দ কাতরস্বরে বলিল- ভবানী ভাই - আমি আর বাঁচিব না ( বিবেকানন্দের তিরোভাবের ঠিক ছয় মাস আগের কথোপকথন) - যাহাতে আমার মঠটি শেষ করিয়া কাজের একটা সুবন্দোবস্ত করিয়া যাইতে পারি - তাহারি জন্য ব্যস্ত আছি- আমার অবসর নাই। সেইদিন তাঁহার সকরুণ একাগ্রতা দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে লোকটার হৃদয় বেদনাময়- ব্যথায় প্রপীড়িত। -- দেশের জন্য বেদনা- দেশের জন্য ব্যথা"।
ব্রহ্মবান্ধব ফিরলেন বিলেত থেকে। এদিকে লর্ড কার্জনের একের পর এক সিদ্ধান্তে ভারতবর্ষ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। এমন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন তাঁর ভাষণে ভারতীয়দের প্রতি কটূক্তি করলেন। ভারতীয়দের মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করলেন তিনি। আগুনে ঘি পড়লো। দেশের সর্বত্র বিলেতী দ্রব্য আগুনে পোড়ানো হতে লাগলো। ব্রহ্মবান্ধব বিলেতী স্টিলের কলম বর্জন করে বাংলার খাগের কলম হাতে তুলে নিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠনের জন্য ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬-ই ডিসেম্বর (১ লা পৌষ,১৩১১ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব দৈনিক 'সন্ধ্যা' নামক এক সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। এই পত্রিকা ভারতীয় সংবাদপত্রের ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিলো।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৩-রা ডিসেম্বর ভারত-সচিব রিজলী বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবে চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা আসামের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়। এই প্রস্তাব প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গে এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ভারত-সচিব এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ৭-ই জুলাই সিমলা থেকে কার্জন ঘোষণা করেন যে আসাম, ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা, দার্জিলিং ও সমস্ত রাজশাহী বিভাগ একত্র করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হবে। এই নতুন প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। একজন ছোটলাট এই নতুন প্রদেশের শাসনকর্তা হবেন। ২০-জুলাই ঘোষণা করা হোলো যে ১৬ অক্টোবর এই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলো। কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর 'সঞ্জীবনী' পত্রিকার ১৩-ই জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক বয়কটের ডাক দিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মতিলাল ঘোষ প্রমুখ নিজ নিজ পত্রিকায় জ্বালাময়ী লেখা লিখতে লাগলেন। সভা সমিতিতে, নানা পত্রিকায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হোলো।
১০-ই অক্টোবর কার্লাইল সার্কুলার জারি করে সরকার সভা সমিতি, পিকেটিং, বক্তৃতা ইত্যাদিতে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করলেন। এর বিরুদ্ধে যুবসমাজ নভেম্বর মাসে 'অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি' গঠন করলেন। সতীশ মুখোপাধ্যায়ের 'ডন সোসাইটি' আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করলো। শুরু হোলো বিলেতী দ্রব্য বর্জন কর্মসূচী। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের নেতৃত্বে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলো। জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচী গৃহীত হোলো। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১-ই মার্চ স্থাপিত হোলো 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ'। আগষ্ট মাসে 'বেঙ্গল ন্যাশন্যাল কলেজ অ্যাণ্ড স্কুল' স্থাপিত হোলো। অরবিন্দ হলেন এর প্রথম অধ্যক্ষ। আর সতীশ মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক।
এর আগে থেকেই ব্রহ্মবান্ধব সন্ধ্যা পত্রিকায় অগ্নিয়ুগের সূচনা করেছেন। ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়েছেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রহ্মবান্ধব সম্পাকীয় কলমে সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুললেন। তাঁর নির্ভীকতা আর স্পষ্টবাদিতা সম্পর্কে বিপিনচন্দ্র পাল লিখলেন- The first successful venture of popular journalism in vernacular of our province। 'বন্দেমাতরম' সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষ লিখলেন- The trumpet-call to liberty sounded in the fulness of faith।
সহজ সরল তেজোময় ভাষায় লেখা সন্ধ্যা পত্রিকা দোকানী, পশারী, মুটে, মজুর, আপামর জনসাধারণের হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো। সকলের মুখেই সন্ধ্যা পত্রিকার আলোচনা। হিন্দু জনমানসে ইংরেজদের যে মায়াজাল বিস্তার লাভ করেছিলো ব্রহ্মবান্ধবের সন্ধ্যা পত্রিকা তার মূলে কুঠারাঘাত করলো। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অচিরেই ভারতের প্রথম জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হোলো।
শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, সুরেশ সমাজপতি প্রমুখ ব্যক্তিগণ ছাড়াও বহু মানুষ স্বদেশভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে সন্ধ্যা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন। সন্ধ্যা পত্রিকা জ্বালাময়ী ভাষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অগ্নিবর্ষণ করে যেতে লাগলো। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১১-ই জানুয়ারি লেখা হোলো-
'যেমন পারবে সরাসরি মার ফেরৎ দেবে। যদি কপালের একটি ঘুষি জোটে সঙ্গে সঙ্গে লাথি মেরে সে ঋণ পরিশোধ করতে যেন ভুল না হয়'।
বেনেটোলার মোড়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে ইংরেজ পুলিশ একবার একদল যুবককে তাড়া করে। সেই যুবকদল ঘুরে দাঁড়িয়ে এক সার্জেন্টের হাত কেটে নেয়। সন্ধ্যা'য় খবর বেরোলো এই শিরোনামে- 'ফিরিঙ্গির থাবা সাবাড়'। এরকম আরও কয়েকটি শিরোনাম তখনকার মানুষের মুখে মুখে ফিরতো- 'সিডিশনের হুড়ুম দুড়ুম, ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম', ' বোম ফটাফট, লাঠি খটাখট', ' ঢিলের বদলে পাটকেল' প্রভৃতি। সন্ধ্যা পত্রিকার অনুসরণে বাংলা ভাষায় যুগান্তর, নবশক্তি, ধর্ম এবং ইংরেজি ভাষায় বন্দেমাতরম, কর্মযোগিন প্রভৃতি কাগজ আত্মপ্রকাশ করে। পুলিশের ভয়ে সেইসময় সাধারণ গ্রন্থাগার তো দূরের কথা ব্যক্তিগত সংগ্রহেও কেউ সন্ধ্যা পত্রিকা রাখতে সাহস করেন নি। ব্রহ্মবান্ধব গবেষক 'শনিবারের চিঠি' খ্যাত সজনীকান্ত দাস ব্রিটিশ মিউজিয়ম, ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী, জাতীয় গ্রন্থাগার, এমনকি আরক্ষা বাহিনীর দপ্তরেও এই পত্রিকার কোনো আদত সংস্করণের সন্ধান পান নি।
প্রথমদিকে ব্রহ্মবান্ধব Sophia এবং Twentieth Century নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে সন্ধ্যা পত্রিকার কার্যালয় থেকে অর্ধ সাপ্তাহিক 'করালী' এবং সাপ্তাহিক ' স্বরাজ ' পত্রিকা (১০-ই মার্চ,১৯০৭) প্রকাশিত হয়েছিলো। এই পত্রিকার কেবলমাত্র বারোটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো।
সন্ধ্যা পত্রিকায় মাঝেমাঝে বাঙালি প্রযুক্তিবিদ ও শিল্পোদ্যোগীদের নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক প্রবন্ধ লিখতেন তিনি। ফিচার ধর্মী গদ্য রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর লেখা 'বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি' বইতে সদালাপী ও রসিক ব্রহ্মবান্ধবের পরিচয় মেলে। সজনীকান্ত বিস্তর অনুসন্ধান করে তাঁর সাহিত্য কীর্তির যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন তা নিম্নরূপ-
জীবিতাবস্থায়--
১. বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি, ৩-রা সেপ্টেম্বর,১৯০৬
২. স্বরাজ পত্রিকায় তাঁর রচিত বহু প্রবন্ধ
৩. সাহিত্য-সংহিতা নামক সাময়িকপত্রে লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব' ও 'অবতার-তত্ত্ব'।
মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর গুণমুগ্ধরা যে যে বইতে তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে স্থায়িত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন সেগুলি হোলো--
১. ব্রহ্মামৃত ১-ম ভাগ, ১-লা ডিসেম্বর, ১৯০৯
২. সমাজ- তত্ত্ব ১৫-ই মে, ১৯১০
৩. আমার ভারত উদ্ধার ১৯২৪
৪. পাল-পার্বণ ১৩-ই জানুয়ারি, ১৯২৫
১৩১৩ বঙ্গাব্দে ব্রহ্মবান্ধব 'শিবাজী উৎসবে'র আয়োজন করেন। তিলক, খাপার্দে, মুঞ্জে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কলকাতায় এলেন। বিপুল জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা সৃষ্টি হোলো। তিনিই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি-উৎসব উপলক্ষ্যে 'মাতৃপূজা'র আয়োজন করেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দেই সন্ধ্যা পত্রিকায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা প্রবন্ধ প্রকাশ করার অপরাধে ব্রহ্মবান্ধবের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতারি সমন জারি হয়। সন্ধ্যা'র দপ্তরে খানাতল্লাশি হয়। ব্রহ্মবান্ধব নিজেই পুলিশকে ডেকে গ্রেপ্তার হলেন। ইংরেজের জেলে গেরুয়ার অমর্যাদা হবে ভেবে সাদা পোষাকে জেলে গেলেন। মামলা শুরু হতেই সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বিচারক কিংসফোর্ডকে লিখিতভাবে জানালেন-
আমি এই বিচারে কোনভাবেই অংশগ্রহণ
করতে রাজি নই। আমি মনে করি না
বিধি-নির্দিষ্ট স্বরাজ ব্রত পালনের যে
সাধনায় আমি নিয়োজিত আছি তার জন্য
বিদেশিদের কাছে কোনভাবেই আমি
জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিশেষতঃ সেইসব
বিদেশিদের কাছে যারা আমাদের ওপর কর্তৃত্ব
করছে এবং যাদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ
পরস্পর পরিপন্থী।।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর তেজোদৃপ্ত ভঙ্গিতে তিনি অনুগামীদের বললেন-
যদি ফিরিঙ্গি আমাকে যন্ত্রণার যূপকাষ্ঠে
আবদ্ধ করে, আমি দেহটাকে ঠনঠনের
চটির মতো তাহার মুখের ওপর ফেলিয়া
দিব।।
না, ইংরেজ আদালত তাঁকে শাস্তি দিতে পারে নি। বিচার চলাকালীন দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর চিরসঙ্গী অণ্ত্রবৃদ্ধি রোগ বেড়ে যায়। আদালত তাঁর বসবার দরকার আছে কি না জানতে চাওয়ায় উত্তর দেন-
ফিরিঙ্গির কাছে ভিক্ষা, কখনই না।
তিনি বলেছিলেন-
ফিরিঙ্গি আমাকে কারাগারে রাখে এমন
সাধ্য ফিরিঙ্গির নাই।
রোগ বেড়ে যাওয়ায় বন্দি অবস্থায় কারাগারে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। অবশেষে ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ১০-ই কার্তিক (১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) সকাল আটটায় তাঁর জীবনাবসান হয়। সন্ধ্যা পত্রিকা লিখলো-
ইহাই সশরীরে স্বর্গারোহণ-ইহাই তেজস্বীর
ইচ্ছা-মৃত্যু-ইহাই কর্মবীরের অবসান।
সকল ধর্মের প্রায় হাজার দশেক লোক তাঁদের প্রিয় নেতার মরদেহ নিয়ে বন্দেমাতরম গাইতে গাইতে এলেন নিমতলা মহাশ্মশানে। জাতীয় সঙ্গীতে মুখরিত সেই জনতা চিতার অগ্নি সাক্ষী রেখে স্বদেশমন্ত্রে নতুন করে শপথ নিলেন।
এই মহান জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা-সংগ্রামী সন্ন্যাসীকে আমরা কবেই ভুলে গেছি। এমনই কত লক্ষ মানুষের কথা যে ভুলেছি আমরা তার ইয়ত্তা নেই। ভুলে যাওয়া আমাদের জাতীয় রোগ। নইলে কী আর বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাতে হয়-
মেরা ভারত মহান।।।
তথ্যসূত্র:-
১. ভারতকোষ, ৫-ম খণ্ড
২. হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ ১-ম ও
২-য় খণ্ড: সুধীরকুমার মিত্র
৩. ফিরিঙ্গি ভয়-হারী ব্রহ্মবান্ধব; সজনীকান্ত
দাস

Friday, August 19, 2016

১৫ আগষ্ট (চতুর্থ পর্ব) : রূপক সামন্ত

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা বন্দেমাতরম মন্ত্র বা স্তোত্রটির গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা আন্দোলন আর বন্দেমাতরম - এদুটিকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এই স্তোত্রটিকে ঘোষণা করা হয়।
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র মালদহে ডেপুটি কালেকটর পদে কর্মরত ছিলেন। ওই বছর আশ্বিনমাসে দুর্গাপূজার ছুটিতে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে এসে নিজের বাড়ির দুর্গাপূজায় যোগদান করেন। ওই সময় তিনি 'আমার দুর্গোৎসব' লেখেন এবং বন্দেমাতরম গানটি রচনা করেন। সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সঙ্গীতশিক্ষক যদুনাথ ভট্টাচার্যকে দিয়ে গানটির সুরারোপ করান। এই যদুনাথ ভট্টাচার্য হলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবাদপুরুষ ধ্রুপদিয়া ও পাখোয়াজী যদু ভট্ট মহাশয়। তিনি কাফি রাগে ত্রিতালে এই গানের সুর করেন এবং ঘরোয়া আসরে প্রথম গেয়ে শোনান। পরে বঙ্কিমচন্দ্র মল্লার রাগে এই গানটিতে সুর সংযোজন করেন ও আনন্দমঠ উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১-৩ মার্চ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
বাঁকুড়া সদর শহরে অবস্থান করেন। এসময়
৩- রা মার্চ সকালে বাঁকুড়ার ছাত্র-ছাত্রী সমাজ কবিকে অভ্যর্থনা জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সভার প্রথমেই ছাত্র-ছাত্রীরা গ্রামাফোন রেকর্ডের বহুল প্রচারিত একটি মার্চ্চিং সুরে বন্দেমাতরম গানটি পরিবেশন করে। কবিগুরু তাঁর ভাষণে প্রথমেই বলেন- 'এই যে 'বন্দেমাতরম' সঙ্গীতটি গাওয়া হ'ল এর প্রত্যেকটি লাইন প্রত্যেকটি শব্দ অশুদ্ধভাবে উচ্চারিত হ'ল। আজ তোমরা এই জাতীয় সঙ্গীতের মূল বাহন সংস্কৃত ভাষার অবমাননা করেছ।--- বিশেষত স্তুতিমন্ত্রে এ রকম বাণীবিকারকে অপরাধ ব'লেই গণ্য করা উচিৎ'। আজও এই গানটি যখনই গাওয়া হয় তাতে উচ্চারণের অজস্র ভুল থাকে। 'খর করবালে' - হয়ে যায় 'কলকল বাহে'। সুরের কথা আর বেশি না বলাই ভালো। ইদানিং আবার সর্বত্র লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানটি বাজানোর রীতি চালু হয়েছে। সত্যি কি বিচিত্র এই দেশ!! নইলে কি আর ভারতবর্ষ হয়ে যায় India!!!
রবীন্দ্রনাথের 'জনগণমন' গানটি বর্তমানে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কংগ্রেসের এক অধিবেশনে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই গানটি গেয়ে শোনান। গানটি উচ্চ-প্রশংসিত হয়। পরে এই গানই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সব বিদ্যালয়ে প্রার্থনাসভায় গানটি গাওয়া হয়। এই গানটিও ছাত্র-ছাত্রীরা এবং অনেকেই ভুল উচ্চারণে গায়। গানটি গাওয়া হলে যে উঠে দাঁড়াতে হয়, সাবধান অবস্থায় দাঁড়াতে হয় তা অনেকেই জানেন না। আবার অনেক শিক্ষিত মানুষ জানলেও তা পালন করেন না। এসব দিকে ধ্যান না দেওয়া, না মানাটাই রীতি হয়ে গ্যাছে।
গানটি নিয়ে কবিগুরুকে কম অপমান সহ্য করতে হয় নি। অনেকেই সিদ্ধান্ত করেন যে-ভারত ভাগ্য বিধাতা - বলতে তিনি ব্রিটেনের মহারাণীর প্রতিনিধি বড়লাটকে বুঝিয়েছেন। এইভাবে তিনি বড়লাটের পায়ে তৈলমর্দন করেছেন। আজও অনেকে এই কথাই বলে। কবিগুরু নিজে বলেছেন যে ভারত ভাগ্য বিধাতা বলতে তিনি পরমপিতা ব্রহ্মের কথাই বলেছেন। কেই বা শোনে সে কথা। আজও অনেকে বলেন - ওই গানটা ইংরেজদের পা চাটার জন্যই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই তো আমাদের স্বাধীনতা!!
আজকাল আবার জাতীয় সঙ্গীতের বদলে 'সারে জাঁহা সে আচ্ছা' গানটি অনেক অনুষ্ঠানেই গাইতে শুনি। এই গানটি একটি অসাধারণ রচনা এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কবি ইকবালের এই গানে অসাধারণ সুরারোপ করেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এই গানটিও স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি অন্যতম মূলমন্ত্র। তথাপি জনগণমন কে যখন জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তখন তা রক্ষা করার দায়টাও আমাদেরই। কবে যে আমাদের সেই বোধোদয় ঘটবে!!

১৫ আগষ্ট (তৃতীয় পর্ব) : রূপক সামন্ত

১৫ আগষ্ট সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কত অনুষ্ঠান হয়। কত মানুষ বক্তৃতা করেন, ভাষণ দেন। তাঁদের বক্তৃতায় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁদের অবদানের কথাও বলা হয়। সেই প্রসঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের নামও করেন অনেকে। আলিপুর বোমার মামলার কথাও বলেন তাঁরা। ১৫ আগষ্ট যে অরবিন্দের জন্মদিন একথা আমি কিন্তু কখনই কারও বক্তৃতায় শুনিনি। স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের আনন্দে এই মহান বিপ্লবী ও পরবর্তীকালের আধ্যাত্মিক দার্শনিকের জন্মদিনটি কোথায় যেন হারিয়ে যান।
চোখের ছানির শল্যচিকিৎসায় বর্তমানে LASIK একটি অতি পরিচিত শব্দ। এক্সিমার লেজারের সাহায্যে এই শল্যচিকিৎসা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে করা হয়। বাঙালি পদার্থবিদ ডঃ মণি ভৌমিক এক সহকর্মীর সাথে যৌথ গবেষণায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই এক্সিমার লেজারের আবিষ্কার করেন। ডঃ ভৌমিকের জন্ম তমলুক শহরের কাছে এক গ্রামে। তাঁর বাবা গুণধর ভৌমিক ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। এর বাইরেও তাঁর একটি পরিচয় আছে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সৈনিক। পুলিশের তাড়ায় প্রায়ই বাড়ির বাইরে অজানা ডেরায় আত্মগোপন করে থাকতে হোতো তাঁকে। ঠাকুমা আর মায়ের সাথে মণি ভৌমিকের জীবনের প্রথম পর্যায় কেটেছে। অতি দরিদ্র এই পরিবারটির সবদিন ভালোভাবে খাওয়াও জুটতো না। বাবার খোঁজে প্রায়ই পুলিশ এসে তল্লাশির নামে জিনিসপত্র তছনছ করতো, মারধোর কোরতো। মণি ভৌমিকের বাবা এক গভীর রাতে লুকিয়ে বাড়িতে এলেন। তাঁর সঙ্গে এক দরিদ্র মাঝবয়সী বিধবা মহিলা। গুণধরবাবুর প্রেরণায় এই বিধবা মহিলা স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হয়েছেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বাস, সাহস আর ধৈর্যের প্রতীক এই মহিলাই হলেন 'গান্ধীবুড়ি' মাতঙ্গিনী হাজরা। হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে তিনি। তাঁর বাবা বিয়ের পণ জোগাড় করতে পারেন নি। তাই বারো বছর বয়সে ষাট বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হোলো তাঁর। সেটাও আবার দ্বিতীয়পক্ষের বিয়ে। মাত্র আঠারো বয়সে বিধবা হলেন মাতঙ্গিনী। সৎ ছেলে তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে দিলে। মাতঙ্গিনী একটি ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়ে পরের বাড়িতে ধান ভেনে পেট চালাতে লাগলেন। আর গান্ধীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ তখন আছড়ে পড়েছে সারা বাঙলায়। মেদিনীপুর তথা তমলুক সেই আন্দোলনের এক পীঠস্থান। স্বাধীনতার জন্য পদযাত্রা চলছে। মাতঙ্গিনী সেই পদযাত্রার একেবারে প্রথমে স্বাধীনতার পতাকা উঁচু করে ধরে চলেছেন। বাঙলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে গভর্নর মজা দেখছেন। বেয়নেটধারী অজস্র পুলিশ তাঁর বাড়ি ঘিরে রেখেছে। মাতঙ্গিনী কিন্তু বেয়োনেটকে অগ্রাহ্য করে লাইন ভেঙে এগিয়ে গিয়ে গভর্নরের সামনে গিয়ে পতাকা তুলে ধরে বললেন- লাটসাহেব ফিরে যাও, গো ব্যক লাটসাহেব। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হোলো। ছ'মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হোলো তাঁর। ছাড়া পাওয়ার পরই তিনি গান্ধীর নির্দেশে অচ্ছুৎদের মাঝে গিয়ে সামাজিক কাজ করতে লাগলেন। এদিকে গুণধরবাবুও পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার নেমে এলো।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী শুরু করলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলন। শুরুতেই ইংরেজ সরকার তাঁকে জেলে পুরে দিলে। সাধারণ জনগণকে কিন্তু থামানো গ্যালো না। তমলুকে হাজার হাজার স্বাধীনতা যোদ্ধা পদযাত্রা করলেন। মাতঙ্গিনী পতাকা আর শাঁখ নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হাজার কণ্ঠে ধ্বনি উঠছে- বন্দে মাতরম। পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করলো। আশেপাশের সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলেও একা এগিয়ে চললেন মাতঙ্গিনী। 'মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে'।
প্রথম গুলিতে ডান হাত ছিন্নভিন্ন হলে গ্যালো তাঁর। হাত থেকে পড়ে শাঁখটি টুকরোটুকরো হয়ে গ্যালো। রক্তাক্ত দুহাতে পতাকা তুলে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি- বন্দে মাতরম। পায়ে লাগলো দ্বিতীয় গুলিটা। পড়ে গেলেন তিনি। তথাপি মনের জোরে আবার উঠে দাঁড়ালেন। বন্দেমাতরম বলতে বলতে পতাকাটা নাড়তে লাগলেন। এমন সময় তিন নম্বর গুলিটা তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গ্যালো। আরও তিন পা এগিয়ে গ্যালো তাঁর মৃতদেহ। তারপর চিরতরে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ইংরেজ সৈনিকরা এসে তাঁর শক্ত মুঠি থেকে ছিনিয়ে নিলো সেই পতাকাটি।
আজ স্বাধীনতার মোচ্ছবে কোথায় হারিয়ে গেলেন সেই মাতঙ্গিনী!!! কেবল মাইকে বাজতে থাকে - মা তুঝে সালাম।

১৫ আগষ্ট (দ্বিতীয় পর্ব) :রূপক সামন্ত

যাঁরা পদার্থবিদ্যা বা গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা প্রাস বা projectile সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কোনো বস্তুকে কত বেগে মাটির সঙ্গে কত কোণে ছুঁড়লে তা কত উঁচুতে উঠবে আর কত দূরেই বা গিয়ে মাটিতে পড়বে এসবই হোলো প্রাস নিয়ে আলোচনার বিষয়। কোন বস্তুকে মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে দাঁড়িয়ে ছুঁড়লেই বা তার গতি কেমন হবে তাও আলোচনা করা হয়। এগারো ক্লাসে আমাকে এসব পড়াতে হয়। এই প্রাস পড়াতে গিয়েই সেদিন রাসবিহারী বসুর কথা এলো। রাসবিহারী বিপ্লবী দলের নেতা। সিদ্ধান্ত হোলো যে লর্ড হার্ডিঞ্জ যখন দিল্লিতে আসবেন তখন তাঁকে বোমা মারা হবে। রাসবিহারী এই কাজের প্রস্তুতিতে প্রথমেই প্রাসের গতিপথ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় পড়ে আত্মস্থ করলেন। কতদূর থেকে বোমাটা কত গতিবেগে আর মাটির সঙ্গে কত কোণে ছুঁড়লে তা হার্ডিঞ্জকে আঘাত করবে তা নিখুঁত অঙ্ক কষে বার করলেন। বোমাটার ভর কত হবে তাও গণনা করলেন তিনি। এবার ঠিক ওই বোমার আকৃতির খোল তৈরী করে তাতে বালি ভর্তি করে ওই ভরের সমান করা হোলো। শুরু হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে অনুশীলন। আরও কয়েকজনকে শেখালেন তিনি। বেশ কয়েকমাসের অনুশীলনে সবাই বেশ দক্ষ হয়ে উঠলো। এরপর এলো সেই বিশেষ দিন। দিল্লির রাজপথ লোকে লোকারণ্য। লর্ড হার্ডিঞ্জের শোভাযাত্রা বেরিয়েছে। সুসজ্জিত হাতির পিঠে চেপে আসছেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। রাস্তার দুপাশে কাতারে কাতারে লোক বড়লাটকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত রাস্তাটা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আর গোয়েন্দা গুপ্তচরেরা যে কোন বেশে কোথায় না কোথায় লুকিয়ে আছে তা কেউ বলতে পারে না। তাদের কাছে খবর আছে যে বড়লাটের উপর বোমা মারার চক্রান্ত করেছে বিপ্লবীরা। আর তাদের মাথা হলেন রাসবিহারী বসু। এদিকে রাসবিহারী বসু কিন্তু এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবীর ছদ্মবেশে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার পাশের এক বাড়ির উঁচু দাওয়ায়। বাকী সঙ্গীরাও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। শোভাযাত্রা কাছে এগিয়ে এসেছে। বসন্ত বিশ্বাস বোমা নিয়ে প্রস্তুত। ছোঁড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে রাসবিহারীর খেয়াল হোলো যে তিনি অনুশীলন করেছিলেন মাটিতে দাঁড়িয়ে। আর এখন তিনি মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন। কাজেই বোমা ছোঁড়ার গতিবেগ বা কোণ বদলাতে হবে। এদিকে সময় নেই আর। দ্রুত অঙ্ক কষলেন মনে মনে। কিন্তু বোমা তো ছুঁড়বেন বসন্ত বিশ্বাস। ছুঁড়লেনও। না, বোমা হার্ডিঞ্জকে আঘাত করলো না। একটুর জন্য বেঁচে গেলেন তিনি। বোমা ফাটার আওয়াজে মুহূর্তে জায়গাটা এক রণক্ষেত্রের চেহারা নিলো। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। পুলিশ ব্যাপক লাঠি চালাচ্ছে। হার্ডিঞ্জকে ঘিরে মুহূর্তে সুকঠিন নিরাপত্তা বলয় তৈরী হয়ে গ্যালো। আর এই ডামাডোলে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়লেন রাসবিহারী বসু।
রাসবিহারী বসুর আর একটি ঘটনা মনে পড়ছে।ইংরেজ সরকার তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছে সরকার। এক বাঙালি দারোগা নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে রয়েছে রাসবিহারীর পিছনে। যেভাবেই হোক এই পালের গোদাটাকে ধরতেই হবে। একেবারে যাকে বলে আদাজল খেয়ে লেগে আছে সেই দারোগা। কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে শেষ মুহূর্তে পালিয়ে গিয়েছেন রাসবিহারী। এমন সময় সেই দারোগার কাছে নিশ্চিত খবর এলো যে একটি বাড়িতে রাসবিহারী সমেত অন্য বিপ্লবীরা জমা হয়ে সভা করছে। বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে ছুটলো সেই দারোগা। আজকে রাসবিহারীকে ধরতেই হবে। এদিকে পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলতে চলেছে খবর পেয়ে রাসবিহারী সবাইকে কোনোক্রমে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। নিজে কিন্তু আটকা পড়ে গেলেন সেই বাড়িতে। পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরে ফেললো। চোঙা ফুঁকে বিপ্লবীদের আত্মসমর্পণ করার জন্য বলতে লাগলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তখন পুলিশ দরজা ভেঙে ঢুকলো বাড়ির মধ্যে। রাসবিহারী ততক্ষণে উপায় না দেখে নোংরা ময়লা ছেঁড়া একটা ধুতি পরে নেমে পড়েছেন ওই বাড়ির খাটা পায়খানায়। বেশ করে মুখে, গোটা গায়ে গু মেখে মাথায় গুয়ের টিন নিয়ে মেথরদের যাবার রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। সোজা গিয়ে দারোগা সাহেবকে লম্বা একটা সেলাম ঠুকলেন। এদিকে দারোগার তো গুয়ের গন্ধে ভূত পালায় অবস্থা। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে গর্জে উঠলেন - ভাগো হিঁয়াসে। সেই মেথর দারোগাবাবুকে আবার একটা লম্বা সেলাম ঠুকে ভয়ে ভয়ে সরে পড়লো সেখান থেকে। এদিকে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে কাউকেই খুঁজে পেলো না। দারোগাসাহেব যখন বুঝলো যে ওই নোংরা মাখা মেথরই রাসবিহারী বসু তখন মাথার চুল ছিঁড়েছিলো নিশ্চয়ই। না রাসবিহারী বসুকে কেনোদিনই ব্রিটিশ পুলিশ টিকিটিও ছুঁতে পারে নি। আমাদের বাঁকুড়া মিশন স্কুলের বাংলার শিক্ষক শৈলজাবাবু একবার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সব্যসাচীর সাথে রাসবিহারী বসুর জীবনের অনেক মিল। অথচ পথের দাবী উপন্যাস অনেক আগেই লেখা হয়েছিলো।
আর একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। কাঁথির উকিল। দেশের মানুষ শ্রদ্ধায় তাঁর নাম রেখেছেন দেশপ্রাণ। মানুষটি অসম্ভব জেদী। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে ইংরেজের সামনে কখনও মাথা নোয়াবেন না তিনি। প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন সেই অদম্য মানুষটি। ইংরেজের শত অত্যাচারেও আমৃত্যু মাথা উঁচু করেই চলেছিলেন। তাঁর এই প্রতিজ্ঞাকে শ্রদ্ধা জানাতে মৃতুর পর তাঁর নশ্বর দেহটাকে দাঁড় করিয়েই পোড়ানো হয়েছিলো।
মেদিনীপুর জেলারই হেমচন্দ্র কানুনগোকে কেই বা আজ মনে রেখেছে। আঠাশ বছরের বিবাহিত যুবক। সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। অরবিন্দ, বারীন ঘোষের আহ্বানে সংসার ত্যাগ করে বিপ্লবী কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। হয়ে উঠলেন বিপ্লবী দলের সর্বাধিনায়ক। ইংরেজের অকথ্য অত্যাচার নেমে এলো এই মানুষটির প্রতি ও তাঁর পরিবারের প্রতি। আজ কেই বা জানে যে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম রূপকার এই বিপ্লবী হেম কানুনগো।
ভগিনী নিবেদিতার অবদানও কী ভোলা যায়! আইরিশ এই মহিলা প্রথম যৌবনে তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অনেক কাজকর্ম করেছেন। তারপর তো গুরু বিবেকানন্দের আহ্বানে চলে এলেন কলকাতায়। সব ত্যাগ করে হলেন সন্ন্যাসিনী। হলে কী হবে রক্তে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব। ধীরে ধীরে কলকাতার বিপ্লবীদের এক অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলেন তিনি। অরবিন্দ, বারীণ ঘোষ প্রমুখের কাজকর্মের সঙ্গে গোপনে যুক্ত হলেন। রাতের অন্ধকারে বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট দিয়ে কত বিপ্লবীকে যে তিনি পার করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। ইংরেজ পুলিশের সন্দেহের তালিকায় অনেকদিন ধরেই তাঁর নাম উঠেছে। মঠে মাঝেমাঝেই পুলিশ গোয়েন্দা গিয়ে তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মঠ কর্তৃপক্ষ অনেকবার নিবেদিতাকে সতর্কও করেছেন। তিনি শোনেন নি। অবশেষে রামকৃষ্ণ মিশন তাঁকে একপ্রকার বিতাড়িতই করলো। তবু দমলেন না মা সারদার এই দামাল খুঁকি। এমনকি অরবিন্দ যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তখন তিনি নিবেদিতাকেই তাঁর পত্রিকা চালানোর ভার দিয়ে গেলেন। নিবেদিতা সে কথা রেখেছিলেন। ইংরেজের লালচোখ উপেক্ষা করেই সেই বিপ্লবী পত্রিকা প্রকাশ করে গ্যাছেন।
উদাহরণ আর বাড়িয়ে কী লাভ। আর আমিই বা জানি কতটুকু! আজকের প্রজন্মের অনেকেই অরবিন্দকেও দুষতে ছাড়েন না। বলেন - আরে উনি তো ইংরেজের ভয়ে পণ্ডিচেরীতে পালিয়ে গিয়ে সাধু হয়ে গেছিলেন। এই বলে এককথায় তাঁর সমস্ত অবদান তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বেশ 'আমি কি হনু' মার্কা একটা ভাব করেন। তেল চকচকে গাল বেয়ে চুঁইয়ে নামে অহঙ্কার। আমি ছাপোষা মাষ্টার চুপ করে যাই। বুঝি - মেরা India মহান।।

স্মৃতি কথা : প্রদ্যোত পাত্র

1980 সাল ,সময় হবে তখন 
4টা , বেলাটা সবে বিকাল !
ব্রাউন হস্টেল এ পেলাম স্থান ,
সুপার তখন তপনবাবু , বললেন 
আজ আর না , কাল এসো সকাল ,সকাল !
কি করি দূরগ্রামের থেকে আসা
ছেলে আমি ,-:না কিছু জানি ,
না কিছু চিনি ! মনে মনে বলি ,
ভগবানই এখন একমাত্র ভরসা !!
ভাবলাম , ভালই ছিলাম গ্রামে ,কেন যে
বাবা ভর্তি করলো এখানে ,
কেমিস্ট্রি অনার্সে ক্রিস্টান কলেজে
কিছুই না জেনে , না শুনে !!
মনে , মনে ভাবছি - অজানা শহর
দেখিনি তো আগে কখনো ,
তাই ভয়ে ভয়ে বলি , সাহস কর ,
গ্রামের ছেলে , জঙ্গলে কাটান ছেলে
তোর আবার কিসের ডর !!
হায় কপাল ,বেডিংটা রাখি কোথা ,
তখন তো কাওকে চিনিনে
এমন সময় ,দেখা পেলাম তরুণে,
মানে তরুণদা , বলল তুই কে ?
আমি বললাম আদি ও অন্ত !!
তরুণদা শুনে , বললো আমিও কেমিস্ট্রীতে
2ন্ড ইয়ার ,,
বুঝে নিলাম হলো আমার একটা
গতি রাতের মতো অন্তত !!
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম , ফেলালো
তরুণদা ,
পরেরদিন একটা রুম আমার ঠিক
হলো !!
তপনবাবুই ঠিক করলো !!
তারপর কদিন করলাম বুদ্ধবাবুদের
ক্লাসে আনাগোনা !!
কদিন পরে জয়েন্ট এন্ট্রান্সএর বেরুলো
রেজাল্ট , আমি পেলাম চান্স !!
এইখানেই শেষ হলো আমার ,,""খৃষ্টান কলেজের
গল্প শোনা !!
এই সময় রেগিঙ্গ এর ভয় নেই বলে যে
দাদারা দিয়েছিল আশ্বাস ,,
তাদের নাম এখনো মনে আছে , দাদারা
হলো , শ্যামলদা আর শুবিকাশ !!
এই হলো আমার হস্টেল ব্রাউন
যখনি মনে হয় তখন মাথায় হাত
দিয়ে খুঁজি যদি পাই কোন ক্রাউন !!
সেই ক্রাউন কি কেউ জানেন ?
উত্তর এরি মধ্যে আছে
দয়া করে একটু খুঁজেন !!!!

ইচ্ছে : প্রদ্যোত পাত্র

মাঝে , মাঝে মনে হয় , পড়াশুনা ,
চাকরির দিন কবে হবে তার দিন গুনা !
কি হবে বাবু ওই দিন গুনে ? এর চেয়ে 
ভালো রাজনীতির ঠেকে পয়সা ঢালো ,
ভাবিষ্যতে দিনগুলো নিশ্চিত কাটবে ভালো !!
পড়াশুনা করতে হলে , পড়তে হবে অনেক করে ,
রাজনীতিতে বড়ো হবে , শুধু তেলমেরে !
তারও আবার পর আছে , চাকরিতে তুমি চাকর ,
রাজনীতি করে কিছু না জেনেও , তুমি সবার উপর !!
হলেই বা তুমি চাকরিতে সবার উপরের আধিকারিক ,
তোমা কিন্তু মানতে হবে টেন পাশ নেতার টিক !!
হলোই বা ওটা একটা চিন্হ , না মানলে হবে রোষ !
শাস্তি তোমা পেতে হবে ফাঁসাবে তোমা দিয়ে অন্য দোষ !!
ট্রান্সফার ? তার আছে নিয়ম , ওদেরই তৈরি !
তোমাকে বিপদে ফেলতে নিয়ম পাল্টাতে করে না ওরা দেরী !!
পড়াশুনা করে সবাই তো আর হবে না সাহিত্যিক বা বিঞ্জানিক ,
কিছু করে তো বাঁচতে হবে , চাকরি না পেলে : তো ভাই হও রাজনীতিক !!!

১৫ আগষ্ট (প্রথম পর্ব) : রূপক সামন্ত

জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখছি ১৫ আগষ্ট - এই দিনটা এলেই সাজো সাজো রব। ভোর থেকে মাইকে বাজছে বন্দেমাতরম বা সারে জাঁহা সে আচ্ছা। ও হ্যাঁ, কারার ওই লৌহকপাট, ও আমার দেশের মাটি- এসব গানও ওই একদিনই বাজতো বটে। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে জাতীয় পতাকা উড়তো পতপত করে। স্কুলের বাচ্চারা সাদা পোষাক পরে ঘুম ঘুম চোখে সাতসকালেই স্কুলে হাজির। কারো কারো হাতে প্যাকাটিতে লাগানো তিরঙ্গা পতাকা। স্কুলের সামনের মাঠে সরু খুঁটিতে দুটো দড়ি বাঁধা জাতীয় পতাকা নামিয়ে রাখা আছে। তাতে আবার কুচো ফুল বাঁধা। মাষ্টারমশাইরা হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক করছেন। ধমকাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রধানশিক্ষক ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রায়! অবশেষে তিনি এলেন। তিনি মানে কোনো মান্যগণ্য ব্যক্তি। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। আমার পাঠশালা জীবনে গ্রামেরই একজন প্রাচীন স্বাধীনতা সংগ্রামী আসতেন। তাঁর নাতনী আমাদের সঙ্গেই পড়তো। নাহ্ আমার এই আটচল্লিশ বছরের জীবনে কোনো স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপনে আমি কোনো মহিলাকে প্রধান অতিথি হতে দেখিনি। বোধহয় মহিলাদের সে যোগ্যতা আছে বলে মনে করেন না কর্তৃপক্ষ। যাকগে সেসব কথা। আমি নারীবাদী বা নারীবিদ্বেষী কোনোটাই নই। আমি এক নিতান্তই ছাপোষা স্কুলমাষ্টার। তো সেই মান্যগণ্য মানুষটি এলেই মাষ্টারমশাইরা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যেতেন। তারপর তাঁকে নিয়ে সোজা পতাকাতলায়। তিনি দড়ি ধরে টানতে লাগলেন, ফুলভরা পেটমোটা পতাকা উপরে উঠতে লাগলো। সবাইকার ঘাড় তখন বেঁকে উপরের দিকে চোখ। কি হয় কি হয় উৎকণ্ঠা চেপে বসেছে সবার মনে। পতাকা আটকে গেলেই বা উপরে উঠে ফুল বাঁধার গিঁট না খুললেই কেলেংকারীর একশেষ। স্বাধীনতা ঝুলে থাকবে যে! তা এমন হতে কয়েকবার দেখেছি আমি। তখন স্বাধীনতা ওড়াবার জন্য সে কি কসরৎ। যাই হোক পতাকা তো উড়লো কোনোরকমে। তারপর সমবেতকণ্ঠে জন গণ মন অধিনায়ক। জয় হিন্দ। তারপর হোতো গ্রাম পরিক্রমা। বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ, ভারত মাতা কী জয় বলতে বলতে আধখানা গ্রাম ঘুরে আবার সেই পাঠশালার মাঠে। দুটো চকোলেট আর দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। সে কি আনন্দ। তবে চুপি চুপি বলে রাখি অনেক এঁচোড়ে পাকা ছেলে শিখিয়েছিলো - বন্দে মাতরম / বোঁদে খেয়ে পেট গরম।
আজও প্রায় সেরকমই চলছে। জৌলুস চাকচিক্য বেড়েছে অনেক। ধোপদূরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবি, লালপাড় শাড়ির সে কি চমক। বাড়িতে, পাড়ার মোড়ে, স্কুলে, ক্লাবে স্বাধীনতা পালনের কি হুল্লোড়। পতাকা উড়ে যাবার কিছু পরেই শুরু হয়ে গ্যালো ডিজে। ঝ্যাম্পার ঝ্যাম্পার ঝ্যাম। সারাদিন সারারাত চলবে। দিনের শেষে জাতীয় পতাকা নামিয়ে আনা হবে না। ওটা প্রজাতন্ত্র দিবস অবধি ঝুলতেই থাকবে। সারাদিন মাছ মাংস বিরিয়ানি - পুরো ছুটি ছুটি উৎসব। আর সন্ধ্যে হলেই তরলে গরলে নরক গুলজার। আমি স্কুলে আসি শুনে অনেকেই খুব অবাক হয়ে বলেন - সে কী! আজ ছুটির দিনে আবার স্কুল কী!!!
এখন কেউ কোনো আবেগের বশে কোনো ভালো কাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বলা হয় -ব্যাটা যেমন ক্ষুদিরাম সাজতে গ্যাছে!! মাষ্টারদা তো ছিলো ডাকাত। গান্ধীজীর মতো খারাপ লোক আর দুটো হয় না। জহরলাল তো পুরো ধান্দাবাজ। আর রবিঠাকুর তো ইংরেজদের পায়ে তেল মেরে নাইট উপাধি আর নোবেল প্রাইজটা বাগিয়ে নিলে। কেবল ওই সুভাষচন্দ্রই যা একটু---। তা সেও তো জার্মানিতে গিয়ে বিয়ে করে ফেললে। আর যারা স্বাধীনতায় লড়েছিলো তারা তো সব তাম্রপত্র পেয়েছে, পেনশন পেয়েছে আবার কি চাই!
কিছুদিন আগে এগারোর বিজ্ঞান ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলাম- বল তো রাসবিহারী বসু কে ছিলেন। সবাই চুপ। একজন আমতা আমতা করে বললে - স্যার মনে হয় আমাদের পি.এম. ছিলো। আমি কী বলবো বুঝতে না পেরে হাঁ করে রইলাম। দোষ কারো নয় গো মা! আমিই তো শেখাতে পারি নি এদের।
আজ যখন আমার স্কুলে পতাকা উত্তোলন হচ্ছে আমার বুক মুচড়ে কান্না উঠে এলো। মনে মনে বললাম- মাতঙ্গিনী, কেন তুমি বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েও পতাকা ছাড়ো নি হাত থেকে! মাষ্টারদা, কে তোমাকে না খেয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে মাথার দিব্যি দিয়েছিলো। প্রীতিলতা তো পড়াশোনা শেষ করে বেশ বিয়ে থা করে সংসারী হতে পারতো। বাঘা যতীন যে কেন মরতে টেগার্টের গুলি খেতে গ্যালো! আরও কতো যে পাগল ছাগল এই করে মরলো। বোকার হদ্দ সব।
না না। আমি খুব বেশী আবেগী হয়ে পড়ি নি। এই আজ বিকেল থেকেই সব ভুলে যাবো। বনের মোষ তাড়াবো, এন্তার বুলি ঝাড়বো সুযোগ পেলেই। মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখবো। আর সুযোগ পেলেই ছিনিয়ে নেবো যা পাওয়া যায় লুটের মাল। আর হ্যাঁ কাজ বাগাতে তেল দিতে কোনো দ্বিধা করবো না। আজীবন কর্তাভজা স্বভাব কিনা আমার।।

রাসবিহারীরা আজো আসে : চঞ্চল রায়

ইলা সেন মীরা বাই রা
এসে আজো দাঁড়ায় ।
তুমি কার বংশধর ?
আমি ইলা মীরা দের ।
অষ্টমের দুটি মেয়ে
হত্যা করলো ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট
স্বাধীনতার জন্য ।
নেতা , আমলা , আই.এস, আই.পি.এস
মন্ত্রী, আম্বানি সম্প্রদায় , ঠিকাদার
ইলাদের বংশধর নয় ।
তখনো ভারতীয় ছিল দুরকম ,এখনো তাই।আমি ইলা সেন দের উত্তরসুরি ।
ওরা আজো আসে চিৎকার করে বলে ---
যারা দেশ চালায়
যারা দেশ ভোগ করে
যারা নয়া সাম্রাজ্যবাদের ভারতীয় প্রতিনিধি , তাদের পূর্বসুরী আমরা নই ।
আমি রাসবিহারীয় ভারতীয় । তুমি ?

মা এর জন্য সহজ কবিতা : সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

তোমাকে অনেক দিন দেখিনি মা ,
তোমার ছবি ও দেখিনি ,
হয়তো দেখেছি ,কিন্তু খেয়াল করিনি 
তোমার মুখের বলি রেখা কতটা গভীর হয়েছে l
হয়তো খেয়াল করেছি ,কিন্তু শুনিনি তোমার কণ্ঠস্বর l
হয়তো শুনেওছি ,কিন্তু গভীর ভাবে মন দিইনি
তোমার গলার কম্পনে অনুচ্চারিত বিষাদ l
হয়তো শুনেছি কিন্তু অনেকদিন তোমার পরশ পাইনি মা !
তোমার হলুদ আর স্নেহ মাখানো আঁচলের ভিজে পরশ ,বিরক্তই করেছে আমাকে l
তোমাকে প্রতিটি কথায় থামিয়ে দিয়েছি,
তোমার কিছু বলার ছিলো ,তোমার কিছু শোনানোর ছিলো
তোমার কিছু জানানোর ছিলো ?
আজ তুমি আর কিছুই বলবেনা ,শুনবেনা ,ধরবেনা -
মা
কিন্তু তোমার প্রায় সত্তর কুঁচকে যাওয়া চোখে
এখনো আশা আর করুণার রঙ্গিন আলো খেলে যাবে --
যদি কখনো চোখে চোখ রাখতে পারি
জানি মা ll
স .মা .

কিঞ্চিত অধিক -- যাকে ' রাখী 'সেই রাখে ! : সঙ্ঘমিত্র মাকুড়

কাকে রাখী কেই বা রাখে !উঠতি বয়সে আমরা রাখী বাঁধতে চাইতাম না মোটেও ,রাখী পূর্নিমার দিন সাবধানে থাকতাম ,সুন্দরী তন্বী বান্ধবী রা রাখী পরিয়ে দিলে তো পেস্টিজ পানচার এক্কেরে !রাখ দেখি তোর রাখী ----মনে মনে কল্পনার ফানুস টা হিলিয়াম গ্যাস ভরে ভরে মহাকাশে উড়ছে ,আর তারই মধ্যে একরত্তি একটা রাখী কিনা তাকে আলপিন এর মতো ফুটো করে চুপসে দেবে এও সহ্য হয় !এক দু কেলাশের উঁচু দিদি দের হতেও রাখী -মুদগর খাও য়ার ইচ্ছে থাকতো না মোটেও ,কলেজ বেলায় এরকম এক দিদি কাম ডিরিম গার্ল কে মনে হতো ,তখনকার হিন্দি সিনেমার লাস্ট সিনের মতো ,ওই যে রাখী গুলজার কে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখতো না ; (পরে অনিল কাপুর এসে ছাড়াবে! ) রাখী বন্ধনের দিনে কেউ বেঁধে রাখেনা কেন ?
* * *
এ হেন রাখী যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বদলে গেলো !রাখী বহু উদ্দেশ্য সাধক !দিদি জী কে মোদী জী র টুইটার রাখী lহেলমেট বিহীন বাইকার কে পুলিশের (গোবদা মতো ,গুঁফো ) সচেতনতা রাখী,রিকশা ওলা -অটো ওলা -টোটো ওলা কে এলাকার তেরোন্গা সংঘে র বোন দের দ্বারা গন -রাখী ,"সুভ উদ্বাঁধন করবেন থানিয় জনদরদি বুল্টোন দা " l এই দাদা বিশেষ কারো স্নেহ ধন্য ,হাতেই পরিচয় ,হাত ভর্তি রাখী তে মুখ ঢেকে যায় যায় !এরপর ছাত্র সংগঠনের পান্ডাদের (শঙ্কুদেব নয় !)কলেজ ছাত্র ছাত্রী দের বল -রাখী (বল পূর্বক রাখী !) মায় সাস্থ্য দপ্তর এবছর পরলে ডেন্গি মশা দের ধরে ধরে শুঁড়ে রাখী পরিয়ে দেয় !দেখিস মা চাকরি টা রাখিস ,নর্থবেঙ্গল টা আটকাস মা গো !!
* * * *
কেতা র ইস্কুলে খুব রাখী র চল !রাখী র বাহার ওজন ও সংখ্যা দিয়ে পদমর্যাদা বোঝার ব্যবস্থা বহুল প্রচলিত l যে মিস টির ফর্সা গোল গাল দুটি হাতে কনুই পর্যন্ত নানা কিসিমের রাখী ,আর তিনশো চৌষট্টি দিনের গম্ভীর মুখে অল্প হাসির রেশন ,তিনি নিঃসন্দেহে প্রিন্সিপাল !এর পর ক্রমান্নয়ে ক্লাস টিচার ,গেম টিচার ,পিওন কাকু ,বাস কাকু -----উল্টো টা হলেই বিপত্তি !
* * *
সরকারি অফিসেও রাখির হরেক ব্যবস্থা !বাম রাখী ,ডান রাখী ,স্বদেশী রাখী , "আরে এই সাদা -আকাশি রাখী টাকে সামনে ঘুরিয়ে দাও হে !লোকের যাতে চোখে পড়ে !"যার যেমন ডিমান্ড তার তেমন রাখী !যে রাখে মশাই তাকেই রাখী l সারা দিন গম্ভীর মুখে অফিস কোচ্চি আর কেউ এলেই কব্জির জোর জুল জুল কোরে মাপার চেষ্টা কোচ্চি l বিকেলের দিকে অফিসের বড় বাবু কী কাজে চেম্বারে ঢুকতেই চক্ষুচড়কগাছ !বড় বাবু তো দু হাতে সবাইকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেছে !(জনান্তিকে :আক্ষরিক অর্থে শুনেছি উনি দু হাতে টেক্কা দেন ....)তা হলে বড় সাহেবের থে বড় বাবু র খাতির বেশী !খাস বেয়ারা কে তুতে তুতলিয়ে সে কথা পাড়তেই বলে ,--এ আর কি দেখলেন স্যার, বাহাদুর দা(এনার হাতেই ফাইলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ হয় ) নিচে বসে আছে ,ওর বৌ ঘন্টায় ঘন্টায় খুলে নিয়ে যাচ্ছে ....l না হলে এতখনে পা পর্যন্ত স্যার!
* * * *
( অস্ত্রপচার করে এ বছর আর অফিসে নাই ,কিন্তু ইদানিং হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেবু র দৌলতে ১৮ থেকে ৭৮ অনেকগুলি বোন, ভাই, বন্ধু ,দাদা ,দিদি ,সব্বাই খুব ভালো ,খুব লাইক দুরস্ত !এরই রেখেছে ,এদেরই রাখী !
দাও ভাই ভারচুয়াল কবজী গুলোকে বাড়িয়ে ,এক এক খানা ভালোবাসার রাখী পরিয়ে দিই এই বেলা !হ্যাপী রাখী,হ্যাপা হীন !)
স মা

জেদ : রূপক সামন্ত

সকাল থেকেই হিমসিম খাচ্ছে রুদ্র। একগাদা প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞানের রচনা, চিঠিপত্র নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। তার নিজের লেখাটাও আধখেঁচড়া হয়ে পড়ে রয়েছে। হলেই বা ছোট পত্রিকা! সম্পাদক হওয়ার হ্যাপা কী কম! একে তো লেখকদের বারবার তাগাদা দিয়ে তবে লেখা আদায় হয়। কেউ কেউ তো একেবারে ছাপার আগের মুহূর্তে লেখা দ্যান। আর লেখকদের হাতের লেখাও বলিহারি। অধিকাংশ লেখকেরই হাতের লেখা উদ্ধার করতে কালঘাম ছুটে যায়। আর বানান নিয়ে বেশি কিছু না বলাই ভালো। তার উপর রয়েছে বাঙলা বানান বিধি। এখন কোন বানানটা যে ঠিক আর কোনটা ভুল তা বোঝা শিবের বাপের অসাধ্যি। এদিকে মহালয়ায় পত্রিকা প্রকাশ করতেই হবে। মাঝে দুবার প্রুফ দেখা, প্রেসে বসে লেখা সাজানো, প্রচ্ছদ বিষয় নিয়ে মাথাখারাপ, সম্পাদকীয় লেখা--। তার উপরে আবার বিজ্ঞাপন জোগাড়ের জন্য দোকানদারদের সামনে হয়ত জোড় করে মিনতি করার পালা। যেন বাপ মা মরার দায়!! এতোসব করে যদি বা বেরোলো এবার সহ্য করো সমালোচনার ঝড়- এ কী করেছেন মশায়! এটা পত্রিকা হয়েছে!! এইসব খাজা মাল চালাচ্ছেন পত্রিকার নামে!! সম্পাদকের এক্ষেত্রে চুপ করে থাকাই রীতি। অবশ্য কেউ কেউ প্রশংসাও করেন। তখন বুকটা ভরে যায় এক আলোভরা খুশিতে।
সবসময় পুরো টাকাও ওঠে না। তবু হাল ছাড়ে না রুদ্র। পত্রিকা করা তার নেশা। রক্তের সাথে মিশে গ্যাছে। নইলে প্রতিবারই ধার দেনা করে কেনই বা করতে যাবে কেউ! বছরে দুবার নিশির ডাকের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। পালাবার পথ নেই।
কদিনের মতো আজও এসবের মাঝে ডুবে ছিলো রুদ্র। আজ সন্ধ্যাতেই প্রেসে ম্যাটার দিতে হবে। তাই উঠেপড়ে লেগেছে সে। দুবার কড়া লিকার চা আর গোটা দুই সিগারেট - এর জোরেই গাড়ি চলছে। এমন সময় কলিংবেলটা সুর করে বেজে উঠলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলে সকাল দশটা বেজে বারো মিনিট। এসময় আবার কে এলো রে বাবা! বিরক্ত হয়ে হাঁক দিলে- রিনি, দ্যাখোতো কে আবার এলো।
রুদ্রর স্ত্রী রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এসে বারান্দা থেকে দেখে বললে - একজন বয়স্ক মানুষ। ঠিক চিনি না। তোমাকে খোঁজ করছে।
আমাকে আবার কে খোঁজ করবে এখন- প্যান্ট সার্ট পরতে পরতে গজগজ করে উঠলো রুদ্র। বিরক্তি ভরা মুখে বারান্দায় বেরিয়ে দ্যাখে গেট খুলে ঢুকে আসছেন ধুতি- সার্ট পরা, মাঝারি লম্বা, একহারা চেহারার একজন বৃদ্ধ। হাতে লাল- সাদা একটা ছাতা। চোখে চশমা। অন্যহাতে একটা সাধারণ কাপড়ের ময়লা ব্যাগ। রুদ্রের কৌতুহলী মুখের দিকে চেয়ে হাত তুলে নমস্কার করে বললেন - আপনিই রুদ্রবাবু? অনমিত্র পত্রিকার সম্পাদক?
রুদ্র প্রতিনমস্কার করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে উনি বললেন - আমি সুদর্শন ভট্টাচার্য। আসছি সেই বন্দীপুর থেকে। এর আগেও দুবার এসেছিলাম। শেষবার আপনার ছেলের হাতে আমার কবিতা আর গল্প দিয়ে গিয়েছিলাম। সে ব্যাপারেই--
রুদ্র মনে করতে পারলো লেখাগুলো। পুরোনো ভঙ্গিতে লেখা। মানও খুব উঁচু নয়। তবু তার মধ্যে থেকেই একটি কবিতা এবারের পূজাসংখ্যার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। সেকথা বলতে তিনি বললেন- জোরে বলুন স্যার, শুনতে পাই না মোটে।
রুদ্র মনে মনে বললো- তাহলে তো হোলো ভালো। মুখে চেঁচিয়ে বলল-আপনি ভিতরে আসুন। স্ত্রীকে ডেকে দুকাপ চা দিতে বললো।
ভদ্রলোক এই গরমে খুব ঘেমে গ্যাছেন। রুদ্র ফ্যানটা পাঁচে দিয়ে দিলো। ভদ্রলোক চেয়ারে বসে পকেট থেকে একটা ময়লা রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন- স্যার, আমার লেখা কি পছন্দ হয়েছে।
রুদ্র বললো- একটি কবিতা এবারের সংখ্যার জন্য নিয়েছি। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন দেখে বুঝলো যে উনি শুনতে পান নি। তাই আবার জোরে চেঁচিয়ে বললো কথাগুলো। ভদ্রলোকের মুখের হাসি দেখে বুঝলো যে এবার কথাগুলো কানে ঢুকেছে।
রুদ্র জিজ্ঞেস করলো - কানে যন্ত্র ব্যবহার করেন না কেন?
- যন্ত্র ছিলো তো স্যার। তিনবার কিনেছি। বেশিদিন চলে না জানেন। বড়জোর একবছর কি দেড়বছর। এক একটা যন্ত্রের দাম সাত আট হাজার টাকা। আমি গরীব মানুষ। কোথায় পাবো অতো টাকা!
-
ইতিমধ্যে রিনি চা বিস্কুট দিয়ে গ্যাছে। উনি চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে বললেন- আজকাল আর সাইকেল চাপি না এই কানের জন্য। পিছন থেকে কোনো গাড়ি হর্ন দিলে শুনতে পাই না তো। সকালবেলায় দুটো ভাত খেয়ে ব্যাগে টিফিন নিয়ে তিনমাইল হেঁটে বাহিরখণ্ড স্টেশনে আসি। তারপর ট্রেন ধরে নানা জায়গায় যাই। প্রতিবন্ধী কার্ড থাকায় ট্রেনে বাসে ভাড়া লাগে না। এটাই সুবিধে। আপনার মতো পত্রিকা করা লোকজনদের বাড়ি যাই। সাহিত্য আলোচনায় যোগ দিই। খুব ভালো লাগে এসব।
রুদ্র জিজ্ঞেস করে- আপনি কি করেন?
এবার মানুষটির চোখে বিষাদের ছায়া দেখতে পায় রুদ্র। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন তিনি। চোখ থেকে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মোছেন। তারপর বলেন- আমিও শিক্ষকতা করতাম। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলাম আমার গ্রামে। চেয়ে চিন্তে বিদ্যালয়ের পাকা বাড়িও করেছিলাম। অনেকদিন চালিয়েছি। কিন্তু--
রুদ্র কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে।
ভদ্রলোক আবার শুরু করেন- আমি বরাবরই কংগ্রেস করি। সে কারণেই আমার বিদ্যালয়টা অনুমোদন পেলো না। বামফ্রন্ট সরকারের আমল তখন। কয়েকবার পরিদর্শনও হয়েছিলো। তবুও ওরা অনুমোদন দিলো না। যা যা প্রয়োজন সবই ছিলো। তবুও---। আমার কাছে এমন কিছু দাবি করা হোলো যা আমি মানতে পারি নি। কেনই বা অন্যায় দাবি মানবো বলুন! আমি তো কোনো অপরাধ করি নি। আর কাউকে তেল মেরে চলতেও শিখি নি কখনও। তাই আমারও জেদ চেপে গ্যালো। যদি অনুমোদন পায় তবে সব নিয়ম মেনেই পাবে। পিছনের দরজা দিয়ে কেন যাবো বলুন তো?
রুদ্র চুপ করে রইলো। এমন অভিজ্ঞতা তারও হয়েছে। তার স্ত্রীও এমনই একটা বিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর পড়িয়েছে। সেই বিদ্যালয়টারও নিজস্ব বাড়ি গড়ে দিয়েছিলো গ্রামের লোকেরা। স্থানীয় সিপিএম নেতারা সেই বিদ্যালয় বন্ধ করে অন্য নামে অনুমোদন করালো। ক্যাডার পাঠিয়ে দিদিমণিদের গালাগাল দেওয়া করালো। তারা বলে গ্যালো যে বেশি বাড়াবাড়ি করলে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়বে। রিনিরা কেস করেছিলো। সেও ধামাচাপা পড়ে গ্যালো। নতুন বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক শিক্ষিকারা এলেন। ভিতরে লাখ লাখ টাকার খেলা চললো। এমন উদাহরণ সারা পশ্চিমবঙ্গে আকছার পাওয়া যাবে।
সুদর্শনবাবু বলে চললেন-কেস করেছিলাম জানেন। জমি জায়গা বিক্রি করে কেস চালিয়েছি। একবার ডিক্রি হোলো। সরকার মানলো না। এখন আদালত অবমাননার কেস চলছে। দেখি কি হয়!
কিছুক্ষণ থেমে হতাশ গলায় বললেন- এখন রায় বেরোলেই বা হবে কি বলুন। এই তিয়াত্তর বছর বয়েসে চাকরী তো আর পাবো না। আমার জীবন শেষ। তবে কি জানেন, অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াই নি আজও। মাঝে একবার মনে হয়েছিলো আত্মহত্যা করি। বেশ কয়েকমাস ধরে যমযণ্ত্রণা ভোগ করেছি। তারপর ভাবলাম, কেন আত্মহত্যা করবো আমি। আমি তো চুরি ডাকাতি করি নি। কারও মেরে একপয়সাও খাই নি জীবনে। কাউকে কোনোদিন ঠকাই নি। তাহলে আমার ভয় কী। আমি বেঁচে থেকে লড়াইটা চালিয়ে যাবো মাথা উঁচু করে। দেখি না কি হয়।
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন- সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন! সিপিএম সরকারের শেষ দিকে গ্রামের নেতারা এসে জোর করে বিদ্যালয়টাকে বন্ধ করে দিলো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলোকে পড়াতে খুব ভালো লাগতো। সেটাও গ্যালো।
- আপনার তাহলে চলে কি করে?
- আমার বিঘে দশেক জমি ছিলো জানেন। দুটো মেয়ের বিয়ে দিতে আর কেস চালাতে পাঁচবিঘে জমি বেচতে হোলো। আর ছেলেটাকে এম.কম. পড়াতে আরও দুবিঘে গ্যালো। এখন আছে আর তিনবিঘে। তাও চাষীরা বর্গা রেকর্ড করেছে। ফসল দেয় না ঠিকমতো। ছেলেটা কত চেষ্টা করছে। কম্পিউটারও শিখলো। চাকরী পেলো না এখনও। জানিনা কি করে চলবে!
একটু চুপ করে থেকে চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে বললেন- এই সরকারও তো কিছু করলো না। আমার বিপিএল কার্ড আছে, প্রতিবন্ধী কার্ড আছে। তবুও আজ পর্যন্ত কোনো সাহায্য পেলাম না। আমি তো এই দলেরই সমর্থক, তবুও পাই নি কিছু। বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর।
খানিকটা চুপ থেকে নিজের মনেই বললেন- আসলে ওসব পড়াশোনা, ডিগ্রি, সততা কিছুই নয়। সবই কপাল। কপালে থাকলে মুখ্যু গুণ্ডাও মন্ত্রী হয়ে স্যালুট পায়। নইলে অনেক লেখাপড়া শিখেও লবডঙ্কা।
কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে রুদ্র। শুধু বুঝতে পারে প্রতিবাদী ছোটো পত্রিকা করার গর্বটা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গ্যাছে তার।
সুদর্শনবাবু বললেন- আজ তাহলে আসি। এখন যাবো শ্যাওড়াফুলি। ওখান থেকে যাবো কোন্নগর। সেখানে এক সাহিত্যসভা আছে। তারপর সেই রাত্রে বাড়ি ফিরবো। এখন এসব নিয়ে ভালো আছি জানেন। আচ্ছা আসি এখন। নমস্কার। পত্রিকা বেরোলে খবর দেবেন একটা। এসে নিয়ে যাবো।
রুদ্র গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো ভদ্রলোককে। সেই লাল-সাদা ছাতা মাথায় দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চললেন। গলির মোড়ে গিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে একটু হাসলেন। তারপর আর দেখা গ্যালো না তাঁকে।

একটা রাখী বেঁধে দিও : মানবেন্দ্র ব্যানার্জী

একটা রাখী বেঁধে দিও বাড়িয়ে দিলাম হাত
সব বাধাকে করবো আমি এবার কুপোকাত্
পাখি হয়ে উড়বো আমি নীল গগনের পানে
তোমার উঠোন ভরিয়ে দেবে মিষ্টি মধুর গানে…
একটা রাখী দাও পরিয়ে আজকে শুভ দিনে
খুশি দিয়ে নেবো আমি জগত টাকে কিনে
আঁখি হয়ে থাকবো আমি সজাগ পাহারা
ইচ্ছে মতো ঘুরবে যত দেশের বোনেরা…

টুকরো টাকরা বেঁচে আছি : মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

কিছু খেলা নিজের জন্য থাকে।
আলগোছে শুধু একটুখানি ছোঁয়া,
চমকে দিয়ে বৃষ্টি ভেজায় আর
এক পেয়ালা স্মৃতিমেদুর ধোঁয়া।
কিছু অসুখ মনের মতো হয়।
বুকের ভেতর পাকদন্ডী পথ,
মোচড় দিয়ে চওড়া কোন বাঁকে
বাঁদিক ঘেষে জীবনযাপন শ্লথ।
কিছু কিছু ব্যথাও বন্ধু হয়।
গভীর রাতে নিশ্চুপে বসে পাশে,
নোনতা জলের গল্প শোনে একা
হাতের ওপর হাত রাখে বিশ্বাসে।
টুকরো টুকরো বাঁচতে বাঁচতে আলোকবর্ষ পার,
দেখবো মৃত্যু হার মেনে গ্যাছে,হেরেছে অন্ধকার ।

Tuesday, August 16, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-২১ : রূপক সামন্ত

কলেজ মোড়ের আড্ডা ছাড়াও প্রায় বিকেলেই প্রতাপবাগানের বাঁকুড়া ইনস্টিটিউট এ যেতাম। রজতও যেতো বলে মনে পড়ছে। দীপ্তই প্রথম নিয়ে গিয়েছিলো ওখানে। দোতলা বাড়িটার উপরতলায় বেশকিছু ইনডোর খেলার ব্যবস্থা ছিলো। টেবিলটেনিস, ক্যারম এসব ছিলো। এই দুটো খেলার প্রতিই আমার ঝোঁক ছিলো। খুব ভালো খেলতে না পারলেও খেলতে ভালো লাগতো। আর একটা ঘরে অনেক খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, কমিকস এসব থাকতো। পড়তাম সেসব। অনেক ছেলে যেতো এই ইনস্টিটিউটে। এক বিকেলে খেলাধূলা চলছে, দীপ্ত বললো- আজ একটু থেকে যাস। একটা মিটিং আছে। কিসের আবার মিটিং রে বাবা! দেরী হলে আবার বাড়িতে বকুনি আছে। তখনও তো অতোটা লায়েক হয়ে উঠি নি। যাইহোক থেকেই গেলাম। সন্ধ্যের মুখে মুখে একটা ঘরে শতরঞ্জি পেতে বসা হোলো। অনেক ছেলেমেয়ে হাজির হয়েছে। টুকটাক কথা চলছে। একজন বেঁটেখাটো, ধুতি- পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তি ঘরে ঢুকলেন। চোখে কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো এলোমেলো। সবাই উঠে দাঁড়ালাম। সেই প্রথম দেখলাম বিমান বসুকে। অনেক কথা আলোচনা করলেন তিনি। ঠিক কি নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো তা আজ আর মনে নেই। তবে একটা বিষয় খুব ভালোভাবেই মনে আছে। অনেক ছেলেকেই উনি নাম ধরে ডাকছিলেন। দীপ্তর মতো বারো ক্লাসে পড়া একটা বাচ্চা ছেলেকেও উনি নামে চেনেন দেখে বেশ অবাক লেগেছিলো। এখন বুঝতে পারি যে একজন ভালো সংগঠক হতে গেলে সবাইকে নামে চেনাটা অত্যন্ত জরুরী। প্রতাপবাগানেই ছিলো আদিত্যবাবুর বাড়ি। জেলা স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। স্যারের কাছে মাধ্যমিক পর্যায়ে কিছুদিন পড়েছিলাম। ওঁর ছেলে মলি আমাদের সহপাঠী। যদিও সে জেলা স্কুলে পড়তো। আমরা স্যারের কাছে যখন পড়তাম মলিও পড়তে বসতো। স্যার ভালোই বোঝাতেন। অনেক অঙ্ক করাতেন। কি কারণে স্যারের কাছে পড়া ছেড়েছিলাম তা আর মনে নেই। বারো ক্লাসে পড়ার সময় থেকে শ্যামাপ্রসাদ ওরফে চন্দন ওরফে ভাইয়াদের বাড়িতে আমার যাতায়াত শুরু হোলো। ওরা তখন দোলতলায় একতলা একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতো। চন্দনের বাবা রাঘব মুখোপাধ্যায় ছিলেন গোয়েঙ্কা স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক। খুব অদ্ভুত ধরণের মানুষ ছিলেন তিনি। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মতো মিশতেন। আমি তো সারাজীবন গুরুগম্ভীর বাবাকে দেখেছি। আমার খুব আশ্চর্য লাগতো। ওঁর দুই স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে জমজমাট সংসার। বড়মার ছেলে স্বপনদা আর মেয়ে শিখাদি। ছোটমার ছেলে খোকন ( সত্যব্রত ) আর চন্দন। মেয়ে টুকুনদি। প্রত্যেকেই খুব আন্তরিক। মনে আছে খোকনদা আমাকে প্রথমদিন দেখে বলেছিলো- ইটা আবার কে বটে রে? বিড়ি খাস তো দে একটা। চল গোয়াল ঘরে গিয়ে মেরে আসি। মনে পড়ছে যে সরু গলির মধ্যে দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটা গোয়ালঘর ছিলো। সেখানে আমরা আড্ডা মারতাম আর বিড়ি খেতাম। স্বপনদা, খোকনদা, শিখাদি, চন্দন - সবাই আমাদের কলেজেরই ছাত্রছাত্রী। খোকনদা প্রাণীবিদ্যার ছাত্র, চন্দনের বিষয় অর্থনীতি। শিখাদি ইংরাজি সাম্মানিকের ছাত্রী। স্বপনদার বিষয়টা মনে পড়ছে না। টুকুনদি কলেজে পড়ে নি। ওর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বপনদা ও খোকনদা দুজনেই পরে শিক্ষক হয়েছে। চন্দন তৃতীয় বর্ষে উঠে বায়ুসেনার চাকরী পেয়ে চলে যায়। পরে ওই চাকরী করতে করতেই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে ইংরাজি নিয়ে এম. এ. পাশ করে। বায়ুসেনার চাকরী থেকে অবসর নিয়ে ও এখন স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মী। রজতের পরে এই চন্দনের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশি ছিলো। চন্দনকে বলতাম ভাই। আমার জীবনে ওদের পরিবারের বিরাট প্রভাব আছে। (আবার আসিবো ফিরে)

কলেজ স্মৃতিকথা-২০ : রূপক সামন্ত

আমার বড়পিসির ছেলে টিঙ্কুদার একটা ব্যাঙ কাটার ট্রে ছিলো। টিঙ্কুদা বারো ক্লাসে পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই ট্রেটা আমি বাঁকুড়ায় নিয়ে আসি। স্কুলে পিথ করে ব্যাঙকে অজ্ঞান করা শিখিয়েছিলেন সুখেন্দুবাবু। আর দীপ্ত তো ছিলোই। ও একদিন আমাদের স্কুলডাঙার বাড়িতে এসে ব্যাঙ ধরা, অজ্ঞান করা, পিন আপ করা, কাটা - সবটাই করে দ্যাখালো। আর পায় কে! শুরু হয়ে গ্যালো ব্যাঙ কাটা যজ্ঞ। কত ব্যাঙ যে কেটেছি আমরা তার ইয়ত্তা নেই। পৌষ্টিক তন্ত্র, রেচন তন্ত্র, জনন তন্ত্র - সবেরই ভুষ্টিনাশ করে ছাড়লাম। কাটা হয়ে যাবার পরও ব্যাঙগুলো তো বেঁচে থাকতো। কিছুক্ষণ পরে নড়াচড়া করতো। ওদের যে কষ্ট, যণ্ত্রণা হচ্ছে সেসব ব্যাপারে কোনো খেয়ালই থাকতো না। কেমন যেন একটা জল্লাদীয় উল্লাস ভর করেছিলো আমাকে। ডিমওলা ব্যাঙও রেহাই পায় নি আমার হাত থেকে। সেই সব ব্যাঙদের নীরব অভিশাপ বুঝি লেগেছে আমায়। তাই একটুতেই ঠাণ্ডা লাগার ধাত আমার। সেইসময় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে অলকানন্দা নামে একটি মেয়ে এসে মাঝরাস্তায় ভর্তি হোলো। মেয়েটি আবার বিকাশের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। থাকে বিকাশদের পাঠকপাড়াতেই। সে নাকি মারকাটারি সুন্দরী!! আর পায় কে! আমাদের সব আলোচনা তখন সেই সুন্দরীখাতে বইতে লাগলো। বিকাশ, চন্দন, দীপ্ত, স্পর্শ - এই সব কলেজ-ছাত্ররা তার হাসি, চোখের চাউনি, হাওয়ায় ওড়া চুল, চলা, কথা বলার ঢঙ - এমন সব গুরুতর বিষয় নিয়ে রোজ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিতে লাগলো। সেসব শুনে আমার মতো বান্ধবী বিহীন স্কুলে পড়া উঠতি কিশোরের বুকের রক্তে ছল-ছলাৎ আর থামতেই চায় না। সেই না-দেখা সুন্দরী চোখের সামনে সদা বিরাজমানা হয়ে দারুণ নয়নবাণে দগ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু সাক্ষাৎ দরশনের উপায় কি! তা উপায় একটা হোলো বৈ কি। ওই যে ব্যাঙ কাটা ট্রে। ওটাই মুশকিল আসান হোলো। কে যেন একদিন বললো- তোর ট্রে টা দিবি একদিন? বললাম- কেন রে? কি হবে? -ব্যাঙ কাটা হবে। অলকানন্দা দেখবে। -ও আচ্ছা। তা দিতে পারি একটা শর্তে। আমিও থাকবো আর ব্যাঙটা আমিই কাটবো।
জানতাম আমার প্রস্তাবে ওদের রাজি হতেই হবে। নইলে ট্রে তো আর পাবে না। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গ্যালো। বিকাশদের বাড়িতে সবাই গিয়ে জুটলাম। চা বিস্কুট খেয়ে ব্যাঙ কাটার তোড়জোড় শুরু হয়ে গ্যালো। কিন্তু সেই তিনি কই!! দেখা তো পাচ্ছি না এখনও! তা তিনি এলেন। মানে বিরাজিত হলেন। উড়িয়ে লাল দোপাট্টা মলমল কা। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটতে লাগলো যেন। আমার সেই লাজুক স্বভাব ফিরে এলো। ব্যাঙ ছেড়ে চোখ আর উঠছেই না কিছুতে।
ব্যাঙ ফ্যাঙ কাটা হয়ে যাবার পর গল্পগুজব চলতে লাগলো। আমিও তখন একটু সাহস পেয়েছি। দুএকটা কথা বলছি। হঠাৎ কি যে হোলো, দুম করে বলে ফেললাম- আমরা আজ এখানে কি জন্যে এসেছি জানো? -কি জন্যে আবার! ব্যাঙ কাটা দেখাতে। -আরে ওটা তো একটা ছল মাত্র। আসল কথাটা হোলো শুনেছিলাম অলকানন্দা নামে খুব সুন্দরী এক নদী নাকি হিমালয় থেকে কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে। তাকেই দেখতে এসেছিলাম।
এই কথা শুনে সে মেয়ে তো ভড়কে গ্যালো একটু। বন্ধুরা কটমট করে তাকাতে লাগলো আমার দিকে। ভাবটা-গ্যাঁড়া বেরো তুই আজ। তারপর দেখছি তোকে। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে সে মেয়ে বললো-তা কেমন দেখলে? বললাম-খুব সুন্দর। মন ভরে গ্যালো। বলে হেসে ফেললাম। সেও সুন্দর মুখটি সুন্দরতর হাসিতে ভরিয়ে তুললো। ওখান থেকে বেরিয়ে বন্ধুরা তো এই মারে সেই মারে। বললাম- আমার যা মনে হয়েছে বলেছি। মিথ্যে তো আর বলিনি।
কলেজে পড়ার সময় অলকানন্দার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। দেখা হলেই দুজনে হেসে উঠতাম সেদিনের কথা ভেবে। খুব ভালো মেয়ে ছিলো সে। আজ কোথায় আছে কে জানে!!
(আবার আসিবো ফিরে)