Tuesday, August 23, 2016

সোমনাথ সুরাল : রূপক সামন্ত

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মিশন স্কুলের বেড়া টপকে সাম্মানিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হলাম খ্রিস্টান কলেজে। প্রচুর বাধানিষেধের জীবনটা হঠাৎ করে পুরোপুরি লাগামছাড়া হয়ে গেলো। রজত সঞ্জীব দীপ্ত অরূপ নন্দিতা অরণি সুভাশিষ বিকাশ শ্যামা সুমনজিৎ এসব পুরোনো বন্ধুরা তো ছিলই, নতুন করে বন্ধুত্ব হল ইন্দ্র প্রভাত চন্দন স্পর্শ অমিত শক্তি জ্ঞানবিকাশ সোমনাথ সুরাল ও আরও অনেকের সঙ্গে। কলেজ মাঠে, কলেজমোড়ের ঠেকে এবং আরও নানা জায়গায় আড্ডা জমে উঠলো। সেইসঙ্গে পড়াশোনা উঠলো লাটে। এদের মধ্যে সোমনাথ সুরালের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। সোমনাথ সুরালের চেহারাটা ছিল বেশ তাগড়াই। মুখে হাসি লেগেই থাকতো। আর প্রচুর লম্বা চওড়া কথা বলতো। যাকে চাটি মারা বলে আর কি। ব্যাস আর যায় কোথা। ওর প্রায় প্রতিটা কথা ধরে ওকে রাগানো শুরু হয়ে গেলো। ওকে ফেঁপো বলে ডাকতে শুরু করলাম আমরা। বিকাশ আবার মিচকে হেসে সুর করে সুরোল বলে ডাকতে আরম্ভ করলো। সেই দেখে আমরাও ওকে ফেঁপো সুরোল বলে খ্যাপাতে শুরু করলাম। কি রেগে যেতো ছেলেটা। তেড়ে মারতে আসতো। দুএকবার পিঠে ঘা ও পড়েছে বৈকি। আমাদের তাতে দুগুণ মজা। আরও বেশী করে রাগাতাম। তবে সুরাল খুব সরল মনের ছেলে ছিলো। মাঝেমাঝেই আমাদেরকে দাদুর দোকানে চা আর লঙ খাওয়াতো। সেইসঙ্গে পান আর সিগারেট। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরাল সক্রিয়ভাবে অংশ নিতো। আমরা একই রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলাম। সেসব কাজেও সবসময় সুরালের সক্রিয় প্রাণবন্ত উপস্থিতি থাকতো। ঠিক ভুল যাই হোক না কেন সুরাল কিছু একটা বলবেই। আর ওর বলা মানেই শুরু হয়ে যেতো পিছু লাগা। তার থেকে ঝগড়া। তারপর আবার মান অভিমান ভুলে যেই কে সেই হতে সুরালের বেশী সময় লাগতো না। ক্যারাম আর টিটি খেলতে খুব ভালোবাসতো সুরাল। একবার নাটকেও অংশ নিয়েছিলো। দারোগার পার্ট। যতদূর মনে পড়ছে রবীন্দ্রভবনে চিরন্তনের ব্যানারে নাটকটা হয়েছিলো। তো সুরাল ধরাচূড়া পরে স্টেজে এন্ট্রি নিলো। আমি প্রম্পটার। সুরালকে পার্ট ধরিয়ে দিচ্ছি। সুরাল কিন্তু কিছু বলছে না। কি হল ব্যাপারটা! তাকিয়ে দেখি ও পকেট থেকে একটা কিং সাইজের সবুজ রঙের MORE সিগারেটের প্যাকেট বেশ কায়দা করে বের করছে। তারপর সেটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটের এককোণে দারুণ কায়দা করে লাগালো। আমি তো থ। সহঅভিনেতা ডায়ালগ ভুলে হাঁ করে সুরালের কীর্তি দেখছে। সুরালের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আর এক পকেট থেকে বের করলো একটা দেশলাই। বেশ কায়দা করে ধরালো সিগারেটটা। এদিকে তখন দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গ্যাছে। কেউ একজন তো চেঁচিয়ে বলে উঠলো- এই সুরাল, ডায়ালগ বল না বে। সুরাল নির্বিকার। কলেজের স্যারদের সামনে আর মেয়েদের সামনে কেতা দেখানোর সুযোগ কি আর ছাড়ে সে! পায়চারী করতে করতে সিগারেটে টান দিয়ে গোটাদুয়েক রিঙ ছেড়ে সুরাল ডায়ালগ দিলো-- হ্যাঁ বলুন এবার। কি আপনার সমস্যা। সহঅভিনেতা পার্ট ফার্ট ভুলে থতোমতো খেয়ে সে এক কেংকেলাস অবস্থা। পরে আমরা তো সুরালকে এই মারি তো সেই মারি করছি। সুরালের ঝাঁঝালো জবাব- বেশ করেছি। আমার সিগারেট আমি খেয়েছি তো তাতে কার বাবার কি? ১৯৮৯ সাল থেকে বাঁকুড়া ছাড়ার পর সুরালের সঙ্গে আর দেখা হয়েছিলো কি না মনে পড়ছে না। যোগযোগও আর ছিলো না। পরশু কস্তূরী মন্তব্য লিখতে জানলাম বছর পাঁচেক আগেই সুরাল সব পাট চুকিয়ে চিরতরে চলে গ্যাছে। রয়ে গ্যাছে ওর ছবি আর কিছু স্মৃতি।

No comments:

Post a Comment