নবগৌরবাবুর কাছে বাংলা পড়লেও বাবা মাঝে মাঝে আমাদের পড়াতেন। বিকেলবেলা স্কুলডাঙার বাড়ির বাইরের ঘরে পড়া চলতো। আমি, রজত, শুদ্ধশীল। দীপ্তও মাঝে মাঝে আসতো। বাবা একটা ছোট টেবিল চেয়ারে বসতেন। আমরা কেউ বেঞ্চে, কেউ বিছানায় কেউ বা অন্য একটা টেবিলে বসতাম। কি পড়া হবে জেনে নিয়ে বাবা প্রথমেই সবাইকে দিয়ে রিডিং পড়াতেন। উচ্চারণের উপর খুব জোর দিতেন। নাটক পড়ানোর সময় এক একটা চরিত্র এক একজনকে নাটকের ঢঙে পড়তে হোতো। গান্ধারীর আবেদন ছিলো আমাদের পাঠক্রমে মনে পড়ে। বাবার বোঝানো ছিলো অননুকরণীয়। একেবারে মনে গেঁথে যেতো। আর ওইরকম দরাজ গলা। ছোটোবেলা থেকেই চাঁদুর গ্রামের বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী ছিলেন তিনি। পরেও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। বাবা বলতেন এসবের ফলে তাঁর গলা তৈরী হয়েছিলো। বলতেন-জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা।
একবার পড়াতে পড়াতে বনলতা সেন কবিতাটার কথা উঠলো। মনে হয় শুদ্ধশীল জানতে চেয়েছিলো। ওটা আমাদের পাঠ্যসূচীতে ছিলো না। যাই হোক, বাবা প্রথমে আবৃত্তি করলেন কবিতাটা। তারপর চরণ ধরে ধরে বোঝাতে শুরু করলেন। আমরা নিমগ্ন হয়ে শুনছি। ছবিটা একেবারে হৃদয়ে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে। প্রেম এবং নারী সম্পর্কে সেই সদ্য তরুণ বয়সে যা যা ধারণা ছিলো সব বদলে যাচ্ছে। প্রেমের গভীরতা যে কতখানি হতে পারে তা হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে ধীরে ধীরে। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে - এই চরণটা বলার পর বাবা প্রশ্ন করলেন - আচ্ছা, পাখীর নীড় কী সুন্দর? উদাহরণ দিয়ে বললেন - একমাত্র বাবুই এর বাসা ছাড়া আর কোনো পাখির বাসা তো সুন্দর নয় মোটেই। তাহলে কবি এমন কথা লিখলেন কেন? কি বোঝাতে চাইলেন তিনি। এই বলে একটা সেমিনারের কথা বললেন উনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেই সেমিনারে এই কবিতাটা নিয়ে আলোচনা চলছিলো। সবাই নিজের নিজের মতামত বলছেন, যুক্তি সাজাচ্ছেন। কেউ বলছেন এটি চরম নিরাশাবাদের কবিতা। কেউ বা বলছেন এর মতো আশাবাদের কবিতা কমই লেখা হয়েছে। এমনই নানা জমজমাট আলোচনা চলছে। এমন সময় কোনো একজন অধ্যাপক বলে বসলেন - পাখির নীড় তো সুন্দর নয়। তাই বনলতা সেনের চোখও মোটেই সুন্দর নয়। এ নিয়ে অ্যাতো আদিখ্যেতা করার কী আছে বুঝিনা। আর যায় কোথায়! মঞ্চে বিশেষজ্ঞ হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপিকা কবি কেতকী কুশারী ডাইসন। লাফ দিয়ে উঠলেন তিনি। সটান এগিয়ে এলেন সেই বক্তার কাছে। একটানে নিজের কালো চশমা খুলে বললেন- কে বললো বনলতা সেনের চোখ সুন্দর নয়!! ভালো করে দেখুন তো আমার চোখ সুন্দর কি না! একে অসামান্য সুন্দরী মহিলা, তদোপরি সাংঘাতিক বিদূষী কেতকীর এই ব্যবহারে সেই অধ্যাপকের তখন তো নাস্তানাবুদ অবস্থা। মনে হয় জীবনে আর কখনও তিনি বনলতা সেনের চোখ নিয়ে কিছু বলার সাহস পান নি।
বাবাকে নিয়ে করা -স্মরণে ও মননে রবীন্দ্রনাথ (রূপাই) সামন্ত -বইতে শুদ্ধশীল এই ঘটনাটা উল্লেখ করেছে তার লেখায়। আমার জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ বেড়ে যায় সেদিনের সেই আলোচনার পর থেকে। অনেক ভেবেছি এই বনলতা সেনকে নিয়ে। আমার জীবনের নারীদের মাঝে খুঁজে পেতে চেয়েছি বনলতাকে। কিছুদিন আগে আমার ফেসবুক ওয়ালে উষ্ণার সঙ্গে এক আলোচনার প্রেক্ষিতে লিখেছি বনলতাকে নিয়ে আমার অনুভব। মোটকথা বনলতা সেন আমার অনুভবে মিশে রয়েছে সেই তখন থেকে।
বারো ক্লাসে উঠেছি। পড়াশোনা বিশেষ কিছু করি না। পরীক্ষার ফলগুলো ফলার মতো বিঁধছে। গুরুজনদের বিদ্রূপ শুনে শুনে তো কান ঝালাপালা। কি করা যায়। আমাদের মধ্যে কারোর একজনের মাথায় খেলে গ্যালো মতলব। দি আইডিয়া। উঠে পড়ে লাগা হোলো। আমরা প্রশ্ন করবো, আমরাই উত্তর লিখবো, আমরাই খাতা দেখবো। আমাদের বাড়িতে বিকেলবেলা শুরু হয়ে গ্যালো পরীক্ষা-পরীক্ষা খেলা। সপ্তাহে একদিন। বিজ্ঞানের কোনো একটা অধ্যায় বেছে নেওয়া হোতো। প্রশ্ন করা, উত্তর দেওয়া চললো। আমি, রজত, শুদ্ধ ও দীপ্ত। মজা হোলো কি, বন্ধুদের একটু চেপে দেওয়ার জন্য আমরা খুঁজে খুঁজে বেশ জটিল জটিল প্রশ্ন দিতে লাগলাম। দ্যাখ কেমন লাগে! অবশ্য না পারলে প্রশ্নকর্তাকে সে প্রশ্নের উত্তর বুঝিয়ে দিতে হোতো। এমনি ভাবেই চললো। এর সুফল আমরা পেয়েছিলাম উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায়।
(আবার আসিবো ফিরে)
(আবার আসিবো ফিরে)
No comments:
Post a Comment