Friday, August 19, 2016

১৫ আগষ্ট (দ্বিতীয় পর্ব) :রূপক সামন্ত

যাঁরা পদার্থবিদ্যা বা গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা প্রাস বা projectile সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কোনো বস্তুকে কত বেগে মাটির সঙ্গে কত কোণে ছুঁড়লে তা কত উঁচুতে উঠবে আর কত দূরেই বা গিয়ে মাটিতে পড়বে এসবই হোলো প্রাস নিয়ে আলোচনার বিষয়। কোন বস্তুকে মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে দাঁড়িয়ে ছুঁড়লেই বা তার গতি কেমন হবে তাও আলোচনা করা হয়। এগারো ক্লাসে আমাকে এসব পড়াতে হয়। এই প্রাস পড়াতে গিয়েই সেদিন রাসবিহারী বসুর কথা এলো। রাসবিহারী বিপ্লবী দলের নেতা। সিদ্ধান্ত হোলো যে লর্ড হার্ডিঞ্জ যখন দিল্লিতে আসবেন তখন তাঁকে বোমা মারা হবে। রাসবিহারী এই কাজের প্রস্তুতিতে প্রথমেই প্রাসের গতিপথ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় পড়ে আত্মস্থ করলেন। কতদূর থেকে বোমাটা কত গতিবেগে আর মাটির সঙ্গে কত কোণে ছুঁড়লে তা হার্ডিঞ্জকে আঘাত করবে তা নিখুঁত অঙ্ক কষে বার করলেন। বোমাটার ভর কত হবে তাও গণনা করলেন তিনি। এবার ঠিক ওই বোমার আকৃতির খোল তৈরী করে তাতে বালি ভর্তি করে ওই ভরের সমান করা হোলো। শুরু হোলো গভীর জঙ্গলের মধ্যে অনুশীলন। আরও কয়েকজনকে শেখালেন তিনি। বেশ কয়েকমাসের অনুশীলনে সবাই বেশ দক্ষ হয়ে উঠলো। এরপর এলো সেই বিশেষ দিন। দিল্লির রাজপথ লোকে লোকারণ্য। লর্ড হার্ডিঞ্জের শোভাযাত্রা বেরিয়েছে। সুসজ্জিত হাতির পিঠে চেপে আসছেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। রাস্তার দুপাশে কাতারে কাতারে লোক বড়লাটকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্ত রাস্তাটা পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। আর গোয়েন্দা গুপ্তচরেরা যে কোন বেশে কোথায় না কোথায় লুকিয়ে আছে তা কেউ বলতে পারে না। তাদের কাছে খবর আছে যে বড়লাটের উপর বোমা মারার চক্রান্ত করেছে বিপ্লবীরা। আর তাদের মাথা হলেন রাসবিহারী বসু। এদিকে রাসবিহারী বসু কিন্তু এক বৃদ্ধ পাঞ্জাবীর ছদ্মবেশে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার পাশের এক বাড়ির উঁচু দাওয়ায়। বাকী সঙ্গীরাও এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। শোভাযাত্রা কাছে এগিয়ে এসেছে। বসন্ত বিশ্বাস বোমা নিয়ে প্রস্তুত। ছোঁড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে রাসবিহারীর খেয়াল হোলো যে তিনি অনুশীলন করেছিলেন মাটিতে দাঁড়িয়ে। আর এখন তিনি মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছেন। কাজেই বোমা ছোঁড়ার গতিবেগ বা কোণ বদলাতে হবে। এদিকে সময় নেই আর। দ্রুত অঙ্ক কষলেন মনে মনে। কিন্তু বোমা তো ছুঁড়বেন বসন্ত বিশ্বাস। ছুঁড়লেনও। না, বোমা হার্ডিঞ্জকে আঘাত করলো না। একটুর জন্য বেঁচে গেলেন তিনি। বোমা ফাটার আওয়াজে মুহূর্তে জায়গাটা এক রণক্ষেত্রের চেহারা নিলো। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। পুলিশ ব্যাপক লাঠি চালাচ্ছে। হার্ডিঞ্জকে ঘিরে মুহূর্তে সুকঠিন নিরাপত্তা বলয় তৈরী হয়ে গ্যালো। আর এই ডামাডোলে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়লেন রাসবিহারী বসু।
রাসবিহারী বসুর আর একটি ঘটনা মনে পড়ছে।ইংরেজ সরকার তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছে সরকার। এক বাঙালি দারোগা নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে রয়েছে রাসবিহারীর পিছনে। যেভাবেই হোক এই পালের গোদাটাকে ধরতেই হবে। একেবারে যাকে বলে আদাজল খেয়ে লেগে আছে সেই দারোগা। কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে শেষ মুহূর্তে পালিয়ে গিয়েছেন রাসবিহারী। এমন সময় সেই দারোগার কাছে নিশ্চিত খবর এলো যে একটি বাড়িতে রাসবিহারী সমেত অন্য বিপ্লবীরা জমা হয়ে সভা করছে। বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে ছুটলো সেই দারোগা। আজকে রাসবিহারীকে ধরতেই হবে। এদিকে পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলতে চলেছে খবর পেয়ে রাসবিহারী সবাইকে কোনোক্রমে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। নিজে কিন্তু আটকা পড়ে গেলেন সেই বাড়িতে। পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরে ফেললো। চোঙা ফুঁকে বিপ্লবীদের আত্মসমর্পণ করার জন্য বলতে লাগলো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তখন পুলিশ দরজা ভেঙে ঢুকলো বাড়ির মধ্যে। রাসবিহারী ততক্ষণে উপায় না দেখে নোংরা ময়লা ছেঁড়া একটা ধুতি পরে নেমে পড়েছেন ওই বাড়ির খাটা পায়খানায়। বেশ করে মুখে, গোটা গায়ে গু মেখে মাথায় গুয়ের টিন নিয়ে মেথরদের যাবার রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। সোজা গিয়ে দারোগা সাহেবকে লম্বা একটা সেলাম ঠুকলেন। এদিকে দারোগার তো গুয়ের গন্ধে ভূত পালায় অবস্থা। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে গর্জে উঠলেন - ভাগো হিঁয়াসে। সেই মেথর দারোগাবাবুকে আবার একটা লম্বা সেলাম ঠুকে ভয়ে ভয়ে সরে পড়লো সেখান থেকে। এদিকে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে কাউকেই খুঁজে পেলো না। দারোগাসাহেব যখন বুঝলো যে ওই নোংরা মাখা মেথরই রাসবিহারী বসু তখন মাথার চুল ছিঁড়েছিলো নিশ্চয়ই। না রাসবিহারী বসুকে কেনোদিনই ব্রিটিশ পুলিশ টিকিটিও ছুঁতে পারে নি। আমাদের বাঁকুড়া মিশন স্কুলের বাংলার শিক্ষক শৈলজাবাবু একবার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর সব্যসাচীর সাথে রাসবিহারী বসুর জীবনের অনেক মিল। অথচ পথের দাবী উপন্যাস অনেক আগেই লেখা হয়েছিলো।
আর একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। কাঁথির উকিল। দেশের মানুষ শ্রদ্ধায় তাঁর নাম রেখেছেন দেশপ্রাণ। মানুষটি অসম্ভব জেদী। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে ইংরেজের সামনে কখনও মাথা নোয়াবেন না তিনি। প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন সেই অদম্য মানুষটি। ইংরেজের শত অত্যাচারেও আমৃত্যু মাথা উঁচু করেই চলেছিলেন। তাঁর এই প্রতিজ্ঞাকে শ্রদ্ধা জানাতে মৃতুর পর তাঁর নশ্বর দেহটাকে দাঁড় করিয়েই পোড়ানো হয়েছিলো।
মেদিনীপুর জেলারই হেমচন্দ্র কানুনগোকে কেই বা আজ মনে রেখেছে। আঠাশ বছরের বিবাহিত যুবক। সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। অরবিন্দ, বারীন ঘোষের আহ্বানে সংসার ত্যাগ করে বিপ্লবী কাজকর্মে জড়িয়ে পড়লেন। হয়ে উঠলেন বিপ্লবী দলের সর্বাধিনায়ক। ইংরেজের অকথ্য অত্যাচার নেমে এলো এই মানুষটির প্রতি ও তাঁর পরিবারের প্রতি। আজ কেই বা জানে যে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম রূপকার এই বিপ্লবী হেম কানুনগো।
ভগিনী নিবেদিতার অবদানও কী ভোলা যায়! আইরিশ এই মহিলা প্রথম যৌবনে তাঁর মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অনেক কাজকর্ম করেছেন। তারপর তো গুরু বিবেকানন্দের আহ্বানে চলে এলেন কলকাতায়। সব ত্যাগ করে হলেন সন্ন্যাসিনী। হলে কী হবে রক্তে রয়েছে স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব। ধীরে ধীরে কলকাতার বিপ্লবীদের এক অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলেন তিনি। অরবিন্দ, বারীণ ঘোষ প্রমুখের কাজকর্মের সঙ্গে গোপনে যুক্ত হলেন। রাতের অন্ধকারে বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট দিয়ে কত বিপ্লবীকে যে তিনি পার করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। ইংরেজ পুলিশের সন্দেহের তালিকায় অনেকদিন ধরেই তাঁর নাম উঠেছে। মঠে মাঝেমাঝেই পুলিশ গোয়েন্দা গিয়ে তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মঠ কর্তৃপক্ষ অনেকবার নিবেদিতাকে সতর্কও করেছেন। তিনি শোনেন নি। অবশেষে রামকৃষ্ণ মিশন তাঁকে একপ্রকার বিতাড়িতই করলো। তবু দমলেন না মা সারদার এই দামাল খুঁকি। এমনকি অরবিন্দ যখন কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তখন তিনি নিবেদিতাকেই তাঁর পত্রিকা চালানোর ভার দিয়ে গেলেন। নিবেদিতা সে কথা রেখেছিলেন। ইংরেজের লালচোখ উপেক্ষা করেই সেই বিপ্লবী পত্রিকা প্রকাশ করে গ্যাছেন।
উদাহরণ আর বাড়িয়ে কী লাভ। আর আমিই বা জানি কতটুকু! আজকের প্রজন্মের অনেকেই অরবিন্দকেও দুষতে ছাড়েন না। বলেন - আরে উনি তো ইংরেজের ভয়ে পণ্ডিচেরীতে পালিয়ে গিয়ে সাধু হয়ে গেছিলেন। এই বলে এককথায় তাঁর সমস্ত অবদান তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বেশ 'আমি কি হনু' মার্কা একটা ভাব করেন। তেল চকচকে গাল বেয়ে চুঁইয়ে নামে অহঙ্কার। আমি ছাপোষা মাষ্টার চুপ করে যাই। বুঝি - মেরা India মহান।।

No comments:

Post a Comment