Thursday, August 4, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-৯ : রূপক সামন্ত

মিশন স্কুলের আর এক শিক্ষক রঞ্জিৎবাবু ছিলেন কলেজেরই ছাত্র। যুবক রঞ্জিৎবাবুর গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। রচনা মুখস্থ বলতে না পারলে সেই হাতের গাঁট্টা অবধারিত। রঞ্জিৎবাবুর টিউশনির তখন রীতিমতো রমরমা। জনা পঞ্চাশেক ছাত্র-ছাত্রী এক এক ব্যাচে পড়তো বলে শুনেছি।

সেদিন অনুরূপার কথা বলছিলাম। অনুরূপার কাকা দেবুবাবু ছিলেন আমাদের স্কুলের ইংরাজির বাঘা শিক্ষক। প্রায় ছফুট লম্বা, টকটকে গায়ের রঙ, কালো পরিপাটি ব্যাকব্রাশ চুল, তীক্ষ্ণ নাক। পাটভাঙা প্যাণ্ট, সার্ট আর চকচকে জুতোয় পাক্কা সাহেব। কোনো কোনো দিন ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরেও আসতেন। খুব রাশভারী ছিলেন। ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতেন। মনে আছে মাঝে মাঝে কালো বাঁকানো পাইপও খেতেন। নিঁখুত উচ্চারণে ডেভিড কপারফিল্ড পড়াতেন। বদরাগীও ছিলেন খুব। একবার সেকেণ্ড বেঞ্চে বসে রজত কার সঙ্গে যেন গল্প করছে নীচুগলায়। দেবুবাবু বসে ছিলেন চেয়ারে। কোনো কথা না বলে ডাস্টারটা তুলে ছুঁড়ে দিলেন। নিঁখুত টিপ। রজতের ভুরুর উপরটা ফেটে গিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগলো। এখনকার দিন হলে চঞ্চলদার একজন মক্কেল বাড়তো সন্দেহ নেই।

এগুলো কোনো ব্যাপারই ছিলো না তখন। অন্য একটি কারণে চিরকালই আমাদের মনে তাঁর জন্য শ্রদ্ধার আসনই পাতা ছিলো। শুনেছিলাম তিনি নাকি স্কুল জীবন থেকেই ভয়ঙ্কর বিপ্লবী ছিলেন। পড়তেন জেলা স্কুলে। তখন ইংরেজ আমল। সবাই ভয়ে তটস্থ। অকুতোভয় দেবুবাবু নাকি তেরঙ্গা পতাকা তুলে একাই বন্দে মাতরম ধ্বনি তুলেছিলেন। পরে তিনি কোনো এক কারণে জেলও খেটেছিলেন বলে শুনেছি।

স্কুলের অঙ্কের স্যার হৃষিকেশবাবুর মেয়ে সঞ্চিতাদি কলেজের ছাত্রী ছিলো। সঞ্চিতাদির সঙ্গে প্রেম ছিলো দেবাশিষ লাহাদার। পরে ওরা বিয়েও করে।

১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সালে যোগেশপল্লীর অশোক আঠাবাবু স্কুলে রসায়নের শিক্ষক রূপে যোগ দ্যান। তিনিও কলেজের ছাত্র। যতদূর মনে পড়ছে শিক্ষকদের মধ্যে রসায়নের শ্যামলবাবু, ইংরাজির বিকাশবাবু, প্রাণিবিদ্যার সুখেন্দুবাবু, ভোতবিজ্ঞানের রামকৃষ্ণ দেওঘরিয়াবাবু ছিলেন কলেজের ছাত্র। ভুলও হতে পারে। আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন। আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

স্কুলে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো স্কুলডাঙারই রজত বিশ্বাস। গান্ধী বিচার পরিষদ পেরিয়ে যে বিখ্যাত লালবাড়ি তার পিছনেই একতলা বাড়িটায় রজতরা ভাড়া থাকতো। রজতের বাবা রামদাসকাকু ডি আই বি তে কাজ করতেন। খুবই কম কথা বলতেন। রজত আমার সহপাঠী হলেও আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো। ওর ভাই পার্থ বরং আমার বয়সী। ওই বাড়িতে বহু দিন রাত কেটেছে আমার। কাকীমা পরিচয় দিতেন আমার তিন ছেলে- রজত, রূপক, পার্থ। আমার যখনতখন অবাধ যাতায়াত, খাওয়া, থাকা ওই বাড়িতে। আজও বাঁকুড়ায় গেলে ওখানেই উঠি। কাকীমা ও কাকু দুজনেই বাঙাল। কাকীমার রান্নার ফোড়নের হাতটি অসাধারণ। আমি তো সোজা কাকীমার কোলে গিয়ে বসতাম। কাকীমা খাইয়ে দিতেন নিজের হাতে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পার করে গবেষণা করার সময়ও আমি কাকীমার কোলে বসেই খেয়েছি। রজত কলেজে সাম্মানিক রসায়ন পড়তো। কলেজ থেকে পাশ করেই বি.এড. পড়তে ঢোকে। পাশ করেই পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পায় সিকিমের এক কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে। আজও সে সিকিমেই আছে। বিয়ে করেছে শিলিগুড়িতে। এখন সেখানে ফ্ল্যাট কিনে জাঁকিয়ে বসেছে। রজত খুব ভালো ছবি আঁকতো। বেশ কিছুদিন ছাঁদারে শ্লেট কেটে, চকের উপরে মূর্তি গড়া শিখেছিলো। ওদের বাঁকুড়ার বাড়িতে সেসব নিদর্শন আজও কিছু আছে। কলেজে পড়ার সময় কাকীমা সবসময় তিন চারজনের চাল বেশি নিতেন। আমি তো ছিলামই। চন্দন, বিকাশ, স্পর্শ, সুমনজিৎ, স্বপ্না, বন্দনা, অনিতা, অমিত, সুভাশিষ- কে যে কখন গিয়ে বলবে - কাকীমা খিদে পেয়েছে খুব। খেতে দিন। কাকীমা বলতেন - আয়। হাত মুখ ধো। দিচ্ছি বোস। কখনও কোনো বিরক্তি দেখি নি মুখে। রজতের ভাই পার্থ আর আমি ছয়ক্লাসে পড়ার সময় একটা ইলেকট্রনিক্স বেতার প্রেরক যন্ত্র ট্রান্সমিটার তৈরি করেছিলাম। কিশোর ভারতীর পাতায় পেয়েছিলাম সার্কিটটা। খুব ভালো কাজ করতো যন্ত্রটা। রজতদের রেডিও সেটটা ছিলো আমাদের রিসিভার। হেঁড়ে গলায় গান, হ্যালো টেস্টিং, হা হা হাসি এসব চলতো। আশেপাশের বাড়ির রেডিওতেও ধরতো আমাদের সেই প্রোগ্রাম। সেই আমার ইলেকট্রনিক্সের নেশা শুরু। পরে আমার সামান্য গবেষণার অনেকটাই এই শাস্ত্রেই হয়েছিলো। পার্থও তার ইলেকট্রনিক্সের নেশা বজায় রাখে। বছরের পর বছর সারারাত জেগে টেপ, টিভি, ভিসিডি, কম্পিউটার এসবের উপর নিজস্ব গবেষণা করে মাস্টার হয়ে ওঠে। স্টেট ব্যাঙ্কের পরেই যে মার্কেট সেখানে তার বিখ্যাত 'তরঙ্গ' দোকান খোলে। পার্থর স্ত্রী ঈশিতা ওই মার্কেটেই বিউটি পার্লার চালায়। ঈশিতা কলেজেরই ছাত্রী। এই শহরের অনেক সুন্দরী ওই পার্লারে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা হতে যান- এ খবর আমার কাছে আছে।

( আবার আসিবো ফিরে )

No comments:

Post a Comment