Friday, August 19, 2016

১৫ আগষ্ট (তৃতীয় পর্ব) : রূপক সামন্ত

১৫ আগষ্ট সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কত অনুষ্ঠান হয়। কত মানুষ বক্তৃতা করেন, ভাষণ দেন। তাঁদের বক্তৃতায় অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁদের অবদানের কথাও বলা হয়। সেই প্রসঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের নামও করেন অনেকে। আলিপুর বোমার মামলার কথাও বলেন তাঁরা। ১৫ আগষ্ট যে অরবিন্দের জন্মদিন একথা আমি কিন্তু কখনই কারও বক্তৃতায় শুনিনি। স্বাধীনতা দিবসের উৎসবের আনন্দে এই মহান বিপ্লবী ও পরবর্তীকালের আধ্যাত্মিক দার্শনিকের জন্মদিনটি কোথায় যেন হারিয়ে যান।
চোখের ছানির শল্যচিকিৎসায় বর্তমানে LASIK একটি অতি পরিচিত শব্দ। এক্সিমার লেজারের সাহায্যে এই শল্যচিকিৎসা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে করা হয়। বাঙালি পদার্থবিদ ডঃ মণি ভৌমিক এক সহকর্মীর সাথে যৌথ গবেষণায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই এক্সিমার লেজারের আবিষ্কার করেন। ডঃ ভৌমিকের জন্ম তমলুক শহরের কাছে এক গ্রামে। তাঁর বাবা গুণধর ভৌমিক ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। এর বাইরেও তাঁর একটি পরিচয় আছে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সৈনিক। পুলিশের তাড়ায় প্রায়ই বাড়ির বাইরে অজানা ডেরায় আত্মগোপন করে থাকতে হোতো তাঁকে। ঠাকুমা আর মায়ের সাথে মণি ভৌমিকের জীবনের প্রথম পর্যায় কেটেছে। অতি দরিদ্র এই পরিবারটির সবদিন ভালোভাবে খাওয়াও জুটতো না। বাবার খোঁজে প্রায়ই পুলিশ এসে তল্লাশির নামে জিনিসপত্র তছনছ করতো, মারধোর কোরতো। মণি ভৌমিকের বাবা এক গভীর রাতে লুকিয়ে বাড়িতে এলেন। তাঁর সঙ্গে এক দরিদ্র মাঝবয়সী বিধবা মহিলা। গুণধরবাবুর প্রেরণায় এই বিধবা মহিলা স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হয়েছেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বাস, সাহস আর ধৈর্যের প্রতীক এই মহিলাই হলেন 'গান্ধীবুড়ি' মাতঙ্গিনী হাজরা। হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে তিনি। তাঁর বাবা বিয়ের পণ জোগাড় করতে পারেন নি। তাই বারো বছর বয়সে ষাট বছরের এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হোলো তাঁর। সেটাও আবার দ্বিতীয়পক্ষের বিয়ে। মাত্র আঠারো বয়সে বিধবা হলেন মাতঙ্গিনী। সৎ ছেলে তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে দিলে। মাতঙ্গিনী একটি ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়ে পরের বাড়িতে ধান ভেনে পেট চালাতে লাগলেন। আর গান্ধীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ তখন আছড়ে পড়েছে সারা বাঙলায়। মেদিনীপুর তথা তমলুক সেই আন্দোলনের এক পীঠস্থান। স্বাধীনতার জন্য পদযাত্রা চলছে। মাতঙ্গিনী সেই পদযাত্রার একেবারে প্রথমে স্বাধীনতার পতাকা উঁচু করে ধরে চলেছেন। বাঙলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে গভর্নর মজা দেখছেন। বেয়নেটধারী অজস্র পুলিশ তাঁর বাড়ি ঘিরে রেখেছে। মাতঙ্গিনী কিন্তু বেয়োনেটকে অগ্রাহ্য করে লাইন ভেঙে এগিয়ে গিয়ে গভর্নরের সামনে গিয়ে পতাকা তুলে ধরে বললেন- লাটসাহেব ফিরে যাও, গো ব্যক লাটসাহেব। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হোলো। ছ'মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হোলো তাঁর। ছাড়া পাওয়ার পরই তিনি গান্ধীর নির্দেশে অচ্ছুৎদের মাঝে গিয়ে সামাজিক কাজ করতে লাগলেন। এদিকে গুণধরবাবুও পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার নেমে এলো।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী শুরু করলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলন। শুরুতেই ইংরেজ সরকার তাঁকে জেলে পুরে দিলে। সাধারণ জনগণকে কিন্তু থামানো গ্যালো না। তমলুকে হাজার হাজার স্বাধীনতা যোদ্ধা পদযাত্রা করলেন। মাতঙ্গিনী পতাকা আর শাঁখ নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হাজার কণ্ঠে ধ্বনি উঠছে- বন্দে মাতরম। পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করলো। আশেপাশের সবাই ভয়ে পালিয়ে গেলেও একা এগিয়ে চললেন মাতঙ্গিনী। 'মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে'।
প্রথম গুলিতে ডান হাত ছিন্নভিন্ন হলে গ্যালো তাঁর। হাত থেকে পড়ে শাঁখটি টুকরোটুকরো হয়ে গ্যালো। রক্তাক্ত দুহাতে পতাকা তুলে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি- বন্দে মাতরম। পায়ে লাগলো দ্বিতীয় গুলিটা। পড়ে গেলেন তিনি। তথাপি মনের জোরে আবার উঠে দাঁড়ালেন। বন্দেমাতরম বলতে বলতে পতাকাটা নাড়তে লাগলেন। এমন সময় তিন নম্বর গুলিটা তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গ্যালো। আরও তিন পা এগিয়ে গ্যালো তাঁর মৃতদেহ। তারপর চিরতরে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ইংরেজ সৈনিকরা এসে তাঁর শক্ত মুঠি থেকে ছিনিয়ে নিলো সেই পতাকাটি।
আজ স্বাধীনতার মোচ্ছবে কোথায় হারিয়ে গেলেন সেই মাতঙ্গিনী!!! কেবল মাইকে বাজতে থাকে - মা তুঝে সালাম।

No comments:

Post a Comment