অনেকবার এমন হয়েছে যে আমি একলাই কবরগুলোর উপর বসে আছি একা। তখনও কেউ আসেনি। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সেই সময় বেশ গা ছমছম করতো। আমি খুব ছোটোবেলা থেকেই একলা থাকতে অভ্যস্ত। সেকথা কিছু আগেই শুনিয়েছি। ভয় না পেলেও কেমন একটা শিরশিরানি অনুভূতি। এই যেন কেউ এসে পিছন থেকে---
এমনিই এক বিকেলে একলা বসে আছি। দীপ্ত এলো। এসে ঝোলার ভিতর থেকে একটা মোটা সবুজরঙের চৌকোমতো রাবার প্যাড বের করলো। আর নরুণের মতো কি একটা যন্ত্র বের করলো। এগুলো আবার কি রে বাবা! তা দীপ্ত বরাবরই একটু অন্যরকমের ছেলে। ওর গুণে ঘাট ছিলো না কোনোদিনও, আজও নেই। খুব ছোটোবেলাতেই ওর আঁকা ছবি বাঁকুড়ার গুণী মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। ওর পড়াশোনার পরিধিটাও বেশ বড়ো আর অন্যরকম। পরবর্তীকালে ও খুব নামী ছবি তুলিয়ে হয়েছিলো। ট্রেকিং করেছে নানা জায়গায়। তখন ও কোলকাতায় থাকতো। তারপর এক সর্দারনীকে জীবনে পেয়ে পুনেতে রেস্তোরাঁ খুলে বসলো। ও বরাবরই দারুণ রান্না করে। অনেকদিন হোলো একটা ওয়েবসাইট খুলেছে রান্না সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আর এখন তো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার বিরাট বড় কর্তাব্যক্তি। ভাবতে খুব ভালো লাগে যে আমার ছেলেবেলার বন্ধুরা নানা ক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
যা বলছিলাম, দীপ্তকে বললাম - এসব কি রে! ও কোনো উত্তর না দিয়ে একমনে নরুণটা দিয়ে সেই প্যাডটা কাটতে লাগলো। আমি হাঁ করে দেখছি। বেশ কিছুক্ষণ পরে গম্ভীরভাবে বললো- এটাকে বলে লিনো প্যাড। বললাম- অ। তা কাটছিস কেনো রে ওটাকে? একটু উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে বললো-প্রচ্ছদ তৈরি করছি প্রমিথিউস পত্রিকার। তারপর ও আমাকে কিভাবে লিনো কেটে প্রচ্ছদ তৈরি করতে হয় বোঝালো। আমি অবাক হয়ে শুনলাম। সেই প্রথম শুনলাম প্রমিথিউস এর নাম। মনে আছে দীপ্ত বলেছিলো - প্রমিথিউস কে জানিস? বললাম- না তো। -- প্রমিথিউসই প্রথম স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন মানুষের মুক্তির জন্য। পরে কলেজে পড়ার সময় প্রমিথিউস পত্রিকা হাতে পাই। তখন আমিও চিরন্তন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। প্রমিথিউসে শ্রেণী-সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, মানুষের মুক্তি - এসব বিষয়ে গ্রাম্ভারি প্রবন্ধ থাকতো। বিশেষ কিছু বুঝতে পারতাম না। আজও যে কিছু বুঝি তেমনটা নয়। আমি নিতান্তই ছাপোষা।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম যে প্রমিথিউস আবার বেরিয়েছে। বন্ধু প্রভাতকুসুম রায় ও আরও অনেকে মিলে উদ্যোগ নিয়ে বের করেছে। খুব ভালো লাগলো। আমি নিজেও আজ রূপশালি নামে একটা ছোটো পত্রিকা করি। তারকেশ্বর লিটিল ম্যাগাজিন মেলার সঙ্গে যুক্ত। তাই কিছুটা হলেও ছোটো পত্রিকার অসম্ভব প্রয়োজনের জায়গাটা বুঝতে পারি। অনেক শুভেচ্ছা রইলো প্রমিথিউসের জন্য।
কবরডাঙার আড্ডা সেরে সন্ধ্যেবেলায় আমরা সব একসঙ্গে ফিরতাম হৈ চৈ করতে করতে। আমাদের ইয়ার্কিগুলো ছিলো নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কখনও কাউকে টিটকিরি মেরেছে আমাদের কেউ এমনটা মনে পড়ে না। তবুও এক বিকেলে ফেরার সময় একটা ঝামেলা বাঁধলো পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। আমাদের পথ আটকালো জনা তিনেক ছেলে। বললো -অ্যাই তোরা কে রে? কোথায় যাস রে রোজ? আমাদের কেউ একজন বললো - তাতে তোদের কি দরকার? এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে হতে চরমে উঠলো ব্যাপারটা। আমরা নাকি ওই পাড়ার মেয়েদের পিছনে লাইন মারছি, তাদের টন্ট কেটেছি এমন সব অভিযোগ উঠে পড়লো। মাথা গরম হয়ে হাতাহাতি হবার উপক্রম। এদিকে বাড়ি ফেরার শেষ সময়সীমা অনেকক্ষণ পেরিয়ে গ্যাছে। তাই শেষমেষ সিদ্ধান্ত হোলো, আজ মুলতুবি থাক। কাল বিকেলে দেখা হবে। তোরাও ছেলেপিলে নিয়ে তৈরি থাকিস। আর কাকে কাকে টন্ট করা হয়েছে তাদেরকেও ডেকে আনিস। প্রমাণ করতে পারলে তার জুতো মুখে করে নিয়ে যাবো আমরা। আর না পারলে তোদের পিঠের ছালচামড়া তুলে নিয়ে যাবো।
এইসব বীরত্বব্যঞ্জক কথা বলে তো আসা হোলো। এবার কি করা যায়!! চললো পরামর্শ। চ্যালেঞ্জ যখন হয়েছে তখন তার যোগ্য জবাব তো দিতে হবে নাকি!
(আবার আসিবো ফিরে)
No comments:
Post a Comment