Tuesday, August 23, 2016

১৫ আগষ্ট (পঞ্চম পর্ব) : রূপক সামন্ত

আজ একজন সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকে এই মানুষটির অবদান কম ছিলো না। তাঁর নাম আজ ভারতবাসী প্রায় ভুলেই গ্যাছে। তাঁর নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দেবীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে ছোটো ছেলে তিনি। অল্পবয়সেই মাতৃহারা। তাঁর জন্ম হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার কাছে খন্নিয়াম গ্রামে, ১২৬৭ সনের ১-লা ফাল্গুন ( ১৮৬১ খ্রি.)। ভবানীচরণ নামে অবশ্য তাঁকে কেউই চেনে না। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামে অবশ্য তাঁকে কেউ কেউ মনে রেখেছেন আজও।
ছোটেবেলা থেকেই পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। বিশেষ ইংরেজি ভাষায় তাঁর অসামান্য দখল ছিলো। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ভাটপাড়ার টোলে সংস্কৃত সাহিত্য ও ব্যাকরণে অসামান্য বুৎপত্তি লাভ করেন। অসাধারণ শারীরিক শক্তির অধিকারী এই মানুষটির কুস্তি, জিমনাস্টিক, লাঠিখেলা, ক্রিকেটখেলায় খুব উৎসাহ ছিলো।
তখনকার দিনে আর্মানী, ফিরিঙ্গি, গোরা ইংরেজরা এদেশীয় নারী পুরুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতো। একবার চুঁচুৃঁড়ায় এরা স্ত্রীলোকদের উপর খুব খারাপ ব্যবহার করে। ভবানীচরণ পাড়ার ছেলেদের নিয়ে তাদের উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাদের কোট- প্যাণ্ট ছিঁড়ে, মাথার টুপি কেড়ে নিয়ে, বেধড়ক পেটানো হয়। এরপর থেকে এমন কাজ করার সাহস তাদের আর হয় নি।
বিচিত্র মানুষ ছিলেন এই ভবানীচরণ ওরফে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। দেশের প্রতি তাঁর ছিলো অকৃত্রিম ভালোবাসা। একই সঙ্গে একই তীব্রতায় ধর্ম ও দেশের কাজের আবেদন তাঁর মনকে নাড়া দিয়েছিলো। কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে এসে তিনি বেশ কিছুদিন ব্রাহ্মধর্মের প্রচার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরে প্রোটেষ্টান্ট ও ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, জব্বলপুরে হিন্দুধর্মের আদলে মঠ স্থাপন, বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর ধর্মীয় কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য মাত্র সাতাশ টাকা সম্বল করে বিলাতযাত্রা- এমন নানা বিচিত্র ধর্মীয় কাজ করেছেন এই অশান্ত ঝোড়ো প্রকৃতির মানুষটি।
ব্রহ্মবান্ধব প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতেন যে ইংরেজদের অত্যাচারের জবাবে পাল্টা মার দিতে হবে। তাঁর বিপ্লব ছিলো আনন্দমঠের সন্ন্যাসী সত্যানন্দের ন্যায় তরবারির বিপ্লব। মাত্র ষোলো- সতের বছর বয়সে কংগ্রেস সভাপতি
আনন্দমোহন বসুর মুখের উপর বলেছিলেন- not through pen but through sword। ওসব ' কলমবাজিতে হইবে না-তলোয়ারবাজিতেই ভারত উদ্ধার হইবে।' মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ তখন বাগ্মীতায় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে ' মুকুটবিহীন সম্রাট'। তাঁরা তখন সংবিধান- সম্মত বৈধ আন্দোলনের পথে কংগ্রেসকে পরিচালনা করছেন। ব্রহ্মবান্ধব সুরেন্দ্রনাথের মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন না। তিনি চাইতেন সমগ্র ভারতবাসীর সমবেত চেষ্টায় দেশ শৃঙ্খলামুক্ত হবে এবং তারজন্য বোমাবারুদ গুলিগোলা লাঠি-তরবারি সব কিছু প্রয়োগ করতে হবে। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে বিয়ে সংসার না করে দেশের কাজে জীবন নিয়োগ করবেন।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মাত্র সতের বছর বয়সে কলেজের পড়া ছেড়ে তিনজন সঙ্গীর সাথে দশটাকা মাত্র সম্বল করে গোয়ালিয়র রাজ্যের সেনাপতির কাছে যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য রওয়ানা দিলেন। অনেক কষ্ট সহ্য করে গোয়ালিয়র পৌঁছলেও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোলো না। বাড়ির লোকে খবর পেয়ে তাঁদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনলেন। পুনরায় বিদ্যাসাগর মশায়ের কলেজে পড়াশোনা শুরু করলেন।
হলে কি হবে, তাঁর মনে সবসময় সেনাদল গঠন করে ইংরেজ তাড়ানোর ইচ্ছা কাজ করছে। আবার মাত্র ত্রিশ টাকা সম্বল করে একাই গোয়ালিয়রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন তিনি। আগ্রা হয়ে বোলপুর গিয়ে সেখান থেকে উটের গাড়িতে চললেন গোয়ালিয়র। এবার গোয়ালিয়রের সেনাপতির সাথে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হোলো। সেনাদল গঠন করার সাধ কিন্তু পূর্ণ হোলো না। ফিরে এলেন কলকাতায়।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিনা বেতনে ছাত্রদের পড়ানোর জন্য 'সারস্বত আয়তন' প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। উদ্দেশ্য- প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের আদর্শে নবভারতে ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এইসময়েই রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ শুরু হোলো। সেই সময় ব্রহ্মবান্ধব তাঁর সম্পাদিত Twentieth Century পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য কাব্যের কবিতাগুলির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন - "তিনি তাঁর কয়েকটি অনুগত শিষ্য ও ছাত্র নিয়ে আশ্রমের কাজে প্রবেশ করলেন।-- তখন উপাধ্যায় আমাকে যে গুরুদেব উপাধি দিয়েছিলেন, আজ পর্যন্ত আশ্রমবাসীদের কাছে আমাকে সেই উপাধি বহন করতে হচ্চে"। বস্তুতপক্ষে ব্রহ্মবান্ধবের ন্যায় কর্মযোগীর সহায়তায় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয় ও আশ্রম গঠনের কাজ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথকে 'বিশ্বকবি' আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন-' বিদেশিরা যদি কোনদিন বাংলা ভাষা শেখে তা হলে তারা তা শিখবে শুধু রবীন্দ্রনাথের জন্যই'।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৫-ই জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফেরার পথে হাওড়া স্টেশনে নেমেই তার আগের দিন, ৪-ঠা জুলাই, যে বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়েছে সেই সংবাদ পান। বিবেকানন্দের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য বিলাত যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মাত্র সাতাশ টাকা সম্বল করে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৫-ই অক্টোবর তিনি বিলাত যাত্রা করলেন। সেখানে অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্তের ব্যাখ্যা করলেন তিনি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের 'বড় বড় অধ্যাপকেরা আমার ব্যখ্যান শুনিলেন ও হিন্দু অধ্যাপক নিযুক্ত করিয়া বেদান্ত-বিজ্ঞান শিক্ষা করিবেন বলিয়া স্বীকার করিলেন' - লিখেছেন ব্রহ্মবান্ধব নিজেই। বিবেকানন্দের প্রতিনিধিস্বরূপ বেদান্ত প্রচার করে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে দেশে ফিরে এলেন তিনি।
বিবেকানন্দের সঙ্গে একবার হেদুয়ায় দেখা হয়েছিলো তাঁর। তাঁর ভাষাতেই শোনা যাক সে বৃত্তান্ত-" আমি বলিলাম - ভাই চুপ করিয়া বসিয়া আছ কেন। এখন - এস একবার কলিকাতা সহরে একটা বেদান্ত-বিজ্ঞানের রোল তোলা যাউক। আমি সব আয়োজন করিয়া দিব তুমি একবার আসরে আসিয়া নামো। - বিবেকানন্দ কাতরস্বরে বলিল- ভবানী ভাই - আমি আর বাঁচিব না ( বিবেকানন্দের তিরোভাবের ঠিক ছয় মাস আগের কথোপকথন) - যাহাতে আমার মঠটি শেষ করিয়া কাজের একটা সুবন্দোবস্ত করিয়া যাইতে পারি - তাহারি জন্য ব্যস্ত আছি- আমার অবসর নাই। সেইদিন তাঁহার সকরুণ একাগ্রতা দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে লোকটার হৃদয় বেদনাময়- ব্যথায় প্রপীড়িত। -- দেশের জন্য বেদনা- দেশের জন্য ব্যথা"।
ব্রহ্মবান্ধব ফিরলেন বিলেত থেকে। এদিকে লর্ড কার্জনের একের পর এক সিদ্ধান্তে ভারতবর্ষ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে। এমন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন তাঁর ভাষণে ভারতীয়দের প্রতি কটূক্তি করলেন। ভারতীয়দের মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করলেন তিনি। আগুনে ঘি পড়লো। দেশের সর্বত্র বিলেতী দ্রব্য আগুনে পোড়ানো হতে লাগলো। ব্রহ্মবান্ধব বিলেতী স্টিলের কলম বর্জন করে বাংলার খাগের কলম হাতে তুলে নিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠনের জন্য ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬-ই ডিসেম্বর (১ লা পৌষ,১৩১১ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্রহ্মবান্ধব দৈনিক 'সন্ধ্যা' নামক এক সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন। এই পত্রিকা ভারতীয় সংবাদপত্রের ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিলো।
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৩-রা ডিসেম্বর ভারত-সচিব রিজলী বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করেন। সেই প্রস্তাবে চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা আসামের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়। এই প্রস্তাব প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গে এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ভারত-সচিব এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ৭-ই জুলাই সিমলা থেকে কার্জন ঘোষণা করেন যে আসাম, ঢাকা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ, পার্বত্য ত্রিপুরা, দার্জিলিং ও সমস্ত রাজশাহী বিভাগ একত্র করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে এক নতুন প্রদেশ গঠিত হবে। এই নতুন প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। একজন ছোটলাট এই নতুন প্রদেশের শাসনকর্তা হবেন। ২০-জুলাই ঘোষণা করা হোলো যে ১৬ অক্টোবর এই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠলো। কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর 'সঞ্জীবনী' পত্রিকার ১৩-ই জুলাই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক বয়কটের ডাক দিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ, মতিলাল ঘোষ প্রমুখ নিজ নিজ পত্রিকায় জ্বালাময়ী লেখা লিখতে লাগলেন। সভা সমিতিতে, নানা পত্রিকায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হোলো।
১০-ই অক্টোবর কার্লাইল সার্কুলার জারি করে সরকার সভা সমিতি, পিকেটিং, বক্তৃতা ইত্যাদিতে ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করলেন। এর বিরুদ্ধে যুবসমাজ নভেম্বর মাসে 'অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটি' গঠন করলেন। সতীশ মুখোপাধ্যায়ের 'ডন সোসাইটি' আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করলো। শুরু হোলো বিলেতী দ্রব্য বর্জন কর্মসূচী। অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের নেতৃত্বে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিলো। জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচী গৃহীত হোলো। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১-ই মার্চ স্থাপিত হোলো 'জাতীয় শিক্ষা পরিষদ'। আগষ্ট মাসে 'বেঙ্গল ন্যাশন্যাল কলেজ অ্যাণ্ড স্কুল' স্থাপিত হোলো। অরবিন্দ হলেন এর প্রথম অধ্যক্ষ। আর সতীশ মুখোপাধ্যায় হলেন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক।
এর আগে থেকেই ব্রহ্মবান্ধব সন্ধ্যা পত্রিকায় অগ্নিয়ুগের সূচনা করেছেন। ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়েছেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রহ্মবান্ধব সম্পাকীয় কলমে সর্বপ্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুললেন। তাঁর নির্ভীকতা আর স্পষ্টবাদিতা সম্পর্কে বিপিনচন্দ্র পাল লিখলেন- The first successful venture of popular journalism in vernacular of our province। 'বন্দেমাতরম' সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষ লিখলেন- The trumpet-call to liberty sounded in the fulness of faith।
সহজ সরল তেজোময় ভাষায় লেখা সন্ধ্যা পত্রিকা দোকানী, পশারী, মুটে, মজুর, আপামর জনসাধারণের হাতে হাতে ঘুরতে লাগলো। সকলের মুখেই সন্ধ্যা পত্রিকার আলোচনা। হিন্দু জনমানসে ইংরেজদের যে মায়াজাল বিস্তার লাভ করেছিলো ব্রহ্মবান্ধবের সন্ধ্যা পত্রিকা তার মূলে কুঠারাঘাত করলো। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অচিরেই ভারতের প্রথম জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হোলো।
শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, সুরেশ সমাজপতি প্রমুখ ব্যক্তিগণ ছাড়াও বহু মানুষ স্বদেশভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে সন্ধ্যা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন। সন্ধ্যা পত্রিকা জ্বালাময়ী ভাষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অগ্নিবর্ষণ করে যেতে লাগলো। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১১-ই জানুয়ারি লেখা হোলো-
'যেমন পারবে সরাসরি মার ফেরৎ দেবে। যদি কপালের একটি ঘুষি জোটে সঙ্গে সঙ্গে লাথি মেরে সে ঋণ পরিশোধ করতে যেন ভুল না হয়'।
বেনেটোলার মোড়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে ইংরেজ পুলিশ একবার একদল যুবককে তাড়া করে। সেই যুবকদল ঘুরে দাঁড়িয়ে এক সার্জেন্টের হাত কেটে নেয়। সন্ধ্যা'য় খবর বেরোলো এই শিরোনামে- 'ফিরিঙ্গির থাবা সাবাড়'। এরকম আরও কয়েকটি শিরোনাম তখনকার মানুষের মুখে মুখে ফিরতো- 'সিডিশনের হুড়ুম দুড়ুম, ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম', ' বোম ফটাফট, লাঠি খটাখট', ' ঢিলের বদলে পাটকেল' প্রভৃতি। সন্ধ্যা পত্রিকার অনুসরণে বাংলা ভাষায় যুগান্তর, নবশক্তি, ধর্ম এবং ইংরেজি ভাষায় বন্দেমাতরম, কর্মযোগিন প্রভৃতি কাগজ আত্মপ্রকাশ করে। পুলিশের ভয়ে সেইসময় সাধারণ গ্রন্থাগার তো দূরের কথা ব্যক্তিগত সংগ্রহেও কেউ সন্ধ্যা পত্রিকা রাখতে সাহস করেন নি। ব্রহ্মবান্ধব গবেষক 'শনিবারের চিঠি' খ্যাত সজনীকান্ত দাস ব্রিটিশ মিউজিয়ম, ইণ্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী, জাতীয় গ্রন্থাগার, এমনকি আরক্ষা বাহিনীর দপ্তরেও এই পত্রিকার কোনো আদত সংস্করণের সন্ধান পান নি।
প্রথমদিকে ব্রহ্মবান্ধব Sophia এবং Twentieth Century নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দে সন্ধ্যা পত্রিকার কার্যালয় থেকে অর্ধ সাপ্তাহিক 'করালী' এবং সাপ্তাহিক ' স্বরাজ ' পত্রিকা (১০-ই মার্চ,১৯০৭) প্রকাশিত হয়েছিলো। এই পত্রিকার কেবলমাত্র বারোটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো।
সন্ধ্যা পত্রিকায় মাঝেমাঝে বাঙালি প্রযুক্তিবিদ ও শিল্পোদ্যোগীদের নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক প্রবন্ধ লিখতেন তিনি। ফিচার ধর্মী গদ্য রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর লেখা 'বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি' বইতে সদালাপী ও রসিক ব্রহ্মবান্ধবের পরিচয় মেলে। সজনীকান্ত বিস্তর অনুসন্ধান করে তাঁর সাহিত্য কীর্তির যে তালিকা প্রস্তুত করেছেন তা নিম্নরূপ-
জীবিতাবস্থায়--
১. বিলাতযাত্রী সন্ন্যাসীর চিঠি, ৩-রা সেপ্টেম্বর,১৯০৬
২. স্বরাজ পত্রিকায় তাঁর রচিত বহু প্রবন্ধ
৩. সাহিত্য-সংহিতা নামক সাময়িকপত্রে লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব' ও 'অবতার-তত্ত্ব'।
মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর গুণমুগ্ধরা যে যে বইতে তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে স্থায়িত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন সেগুলি হোলো--
১. ব্রহ্মামৃত ১-ম ভাগ, ১-লা ডিসেম্বর, ১৯০৯
২. সমাজ- তত্ত্ব ১৫-ই মে, ১৯১০
৩. আমার ভারত উদ্ধার ১৯২৪
৪. পাল-পার্বণ ১৩-ই জানুয়ারি, ১৯২৫
১৩১৩ বঙ্গাব্দে ব্রহ্মবান্ধব 'শিবাজী উৎসবে'র আয়োজন করেন। তিলক, খাপার্দে, মুঞ্জে প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কলকাতায় এলেন। বিপুল জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা সৃষ্টি হোলো। তিনিই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি-উৎসব উপলক্ষ্যে 'মাতৃপূজা'র আয়োজন করেন। ১৩১৩ বঙ্গাব্দেই সন্ধ্যা পত্রিকায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা প্রবন্ধ প্রকাশ করার অপরাধে ব্রহ্মবান্ধবের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। গ্রেফতারি সমন জারি হয়। সন্ধ্যা'র দপ্তরে খানাতল্লাশি হয়। ব্রহ্মবান্ধব নিজেই পুলিশকে ডেকে গ্রেপ্তার হলেন। ইংরেজের জেলে গেরুয়ার অমর্যাদা হবে ভেবে সাদা পোষাকে জেলে গেলেন। মামলা শুরু হতেই সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে বিচারক কিংসফোর্ডকে লিখিতভাবে জানালেন-
আমি এই বিচারে কোনভাবেই অংশগ্রহণ
করতে রাজি নই। আমি মনে করি না
বিধি-নির্দিষ্ট স্বরাজ ব্রত পালনের যে
সাধনায় আমি নিয়োজিত আছি তার জন্য
বিদেশিদের কাছে কোনভাবেই আমি
জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিশেষতঃ সেইসব
বিদেশিদের কাছে যারা আমাদের ওপর কর্তৃত্ব
করছে এবং যাদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ
পরস্পর পরিপন্থী।।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর তেজোদৃপ্ত ভঙ্গিতে তিনি অনুগামীদের বললেন-
যদি ফিরিঙ্গি আমাকে যন্ত্রণার যূপকাষ্ঠে
আবদ্ধ করে, আমি দেহটাকে ঠনঠনের
চটির মতো তাহার মুখের ওপর ফেলিয়া
দিব।।
না, ইংরেজ আদালত তাঁকে শাস্তি দিতে পারে নি। বিচার চলাকালীন দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর চিরসঙ্গী অণ্ত্রবৃদ্ধি রোগ বেড়ে যায়। আদালত তাঁর বসবার দরকার আছে কি না জানতে চাওয়ায় উত্তর দেন-
ফিরিঙ্গির কাছে ভিক্ষা, কখনই না।
তিনি বলেছিলেন-
ফিরিঙ্গি আমাকে কারাগারে রাখে এমন
সাধ্য ফিরিঙ্গির নাই।
রোগ বেড়ে যাওয়ায় বন্দি অবস্থায় কারাগারে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। অবশেষে ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ১০-ই কার্তিক (১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) সকাল আটটায় তাঁর জীবনাবসান হয়। সন্ধ্যা পত্রিকা লিখলো-
ইহাই সশরীরে স্বর্গারোহণ-ইহাই তেজস্বীর
ইচ্ছা-মৃত্যু-ইহাই কর্মবীরের অবসান।
সকল ধর্মের প্রায় হাজার দশেক লোক তাঁদের প্রিয় নেতার মরদেহ নিয়ে বন্দেমাতরম গাইতে গাইতে এলেন নিমতলা মহাশ্মশানে। জাতীয় সঙ্গীতে মুখরিত সেই জনতা চিতার অগ্নি সাক্ষী রেখে স্বদেশমন্ত্রে নতুন করে শপথ নিলেন।
এই মহান জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা-সংগ্রামী সন্ন্যাসীকে আমরা কবেই ভুলে গেছি। এমনই কত লক্ষ মানুষের কথা যে ভুলেছি আমরা তার ইয়ত্তা নেই। ভুলে যাওয়া আমাদের জাতীয় রোগ। নইলে কী আর বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাতে হয়-
মেরা ভারত মহান।।।
তথ্যসূত্র:-
১. ভারতকোষ, ৫-ম খণ্ড
২. হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ ১-ম ও
২-য় খণ্ড: সুধীরকুমার মিত্র
৩. ফিরিঙ্গি ভয়-হারী ব্রহ্মবান্ধব; সজনীকান্ত
দাস

No comments:

Post a Comment