Tuesday, August 16, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-২০ : রূপক সামন্ত

আমার বড়পিসির ছেলে টিঙ্কুদার একটা ব্যাঙ কাটার ট্রে ছিলো। টিঙ্কুদা বারো ক্লাসে পরীক্ষা দেওয়ার পর ওই ট্রেটা আমি বাঁকুড়ায় নিয়ে আসি। স্কুলে পিথ করে ব্যাঙকে অজ্ঞান করা শিখিয়েছিলেন সুখেন্দুবাবু। আর দীপ্ত তো ছিলোই। ও একদিন আমাদের স্কুলডাঙার বাড়িতে এসে ব্যাঙ ধরা, অজ্ঞান করা, পিন আপ করা, কাটা - সবটাই করে দ্যাখালো। আর পায় কে! শুরু হয়ে গ্যালো ব্যাঙ কাটা যজ্ঞ। কত ব্যাঙ যে কেটেছি আমরা তার ইয়ত্তা নেই। পৌষ্টিক তন্ত্র, রেচন তন্ত্র, জনন তন্ত্র - সবেরই ভুষ্টিনাশ করে ছাড়লাম। কাটা হয়ে যাবার পরও ব্যাঙগুলো তো বেঁচে থাকতো। কিছুক্ষণ পরে নড়াচড়া করতো। ওদের যে কষ্ট, যণ্ত্রণা হচ্ছে সেসব ব্যাপারে কোনো খেয়ালই থাকতো না। কেমন যেন একটা জল্লাদীয় উল্লাস ভর করেছিলো আমাকে। ডিমওলা ব্যাঙও রেহাই পায় নি আমার হাত থেকে। সেই সব ব্যাঙদের নীরব অভিশাপ বুঝি লেগেছে আমায়। তাই একটুতেই ঠাণ্ডা লাগার ধাত আমার। সেইসময় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে অলকানন্দা নামে একটি মেয়ে এসে মাঝরাস্তায় ভর্তি হোলো। মেয়েটি আবার বিকাশের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। থাকে বিকাশদের পাঠকপাড়াতেই। সে নাকি মারকাটারি সুন্দরী!! আর পায় কে! আমাদের সব আলোচনা তখন সেই সুন্দরীখাতে বইতে লাগলো। বিকাশ, চন্দন, দীপ্ত, স্পর্শ - এই সব কলেজ-ছাত্ররা তার হাসি, চোখের চাউনি, হাওয়ায় ওড়া চুল, চলা, কথা বলার ঢঙ - এমন সব গুরুতর বিষয় নিয়ে রোজ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিতে লাগলো। সেসব শুনে আমার মতো বান্ধবী বিহীন স্কুলে পড়া উঠতি কিশোরের বুকের রক্তে ছল-ছলাৎ আর থামতেই চায় না। সেই না-দেখা সুন্দরী চোখের সামনে সদা বিরাজমানা হয়ে দারুণ নয়নবাণে দগ্ধ করতে লাগলো। কিন্তু সাক্ষাৎ দরশনের উপায় কি! তা উপায় একটা হোলো বৈ কি। ওই যে ব্যাঙ কাটা ট্রে। ওটাই মুশকিল আসান হোলো। কে যেন একদিন বললো- তোর ট্রে টা দিবি একদিন? বললাম- কেন রে? কি হবে? -ব্যাঙ কাটা হবে। অলকানন্দা দেখবে। -ও আচ্ছা। তা দিতে পারি একটা শর্তে। আমিও থাকবো আর ব্যাঙটা আমিই কাটবো।
জানতাম আমার প্রস্তাবে ওদের রাজি হতেই হবে। নইলে ট্রে তো আর পাবে না। দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গ্যালো। বিকাশদের বাড়িতে সবাই গিয়ে জুটলাম। চা বিস্কুট খেয়ে ব্যাঙ কাটার তোড়জোড় শুরু হয়ে গ্যালো। কিন্তু সেই তিনি কই!! দেখা তো পাচ্ছি না এখনও! তা তিনি এলেন। মানে বিরাজিত হলেন। উড়িয়ে লাল দোপাট্টা মলমল কা। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটতে লাগলো যেন। আমার সেই লাজুক স্বভাব ফিরে এলো। ব্যাঙ ছেড়ে চোখ আর উঠছেই না কিছুতে।
ব্যাঙ ফ্যাঙ কাটা হয়ে যাবার পর গল্পগুজব চলতে লাগলো। আমিও তখন একটু সাহস পেয়েছি। দুএকটা কথা বলছি। হঠাৎ কি যে হোলো, দুম করে বলে ফেললাম- আমরা আজ এখানে কি জন্যে এসেছি জানো? -কি জন্যে আবার! ব্যাঙ কাটা দেখাতে। -আরে ওটা তো একটা ছল মাত্র। আসল কথাটা হোলো শুনেছিলাম অলকানন্দা নামে খুব সুন্দরী এক নদী নাকি হিমালয় থেকে কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে। তাকেই দেখতে এসেছিলাম।
এই কথা শুনে সে মেয়ে তো ভড়কে গ্যালো একটু। বন্ধুরা কটমট করে তাকাতে লাগলো আমার দিকে। ভাবটা-গ্যাঁড়া বেরো তুই আজ। তারপর দেখছি তোকে। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে সে মেয়ে বললো-তা কেমন দেখলে? বললাম-খুব সুন্দর। মন ভরে গ্যালো। বলে হেসে ফেললাম। সেও সুন্দর মুখটি সুন্দরতর হাসিতে ভরিয়ে তুললো। ওখান থেকে বেরিয়ে বন্ধুরা তো এই মারে সেই মারে। বললাম- আমার যা মনে হয়েছে বলেছি। মিথ্যে তো আর বলিনি।
কলেজে পড়ার সময় অলকানন্দার সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। দেখা হলেই দুজনে হেসে উঠতাম সেদিনের কথা ভেবে। খুব ভালো মেয়ে ছিলো সে। আজ কোথায় আছে কে জানে!!
(আবার আসিবো ফিরে)

No comments:

Post a Comment