পাঁচক্লাসে মিশন স্কুলে ভর্তি হলাম। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাসবিহারী কিস্কু মহাশয়। ছোটোখাটো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষটির অঙ্ক ছিলো বিষয়। রুটিনে ওঁর ক্লাস থাকলেও প্রায়ই অন্য স্যার ক্লাস নিতেন। প্রধানশিক্ষক হিসাবে নানা দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে ক্লাসে আসা হয়ে উঠতো না তাঁর।
স্কুলের নানা দায়িত্ব সামলাতে রাসবিহারীবাবুকে সবসময় যিনি সাহায্য করতেন তিনি হলেন নবগৌরবাবু- নবগৌর সিংহ। খুব ছোটবেলা থেকে ওঁর প্রতাপবাগানের বাড়িতে বাংলা আর ইংরাজি টিউশন পড়েছি। স্কুলেও উনি বাংলা পড়াতেন। ওঁর কাছে আমার আবদারের শেষ ছিলো না। বাঁদরামিও ছিলো চূড়ান্ত পর্যায়ের। তবুও ইংরাজি ও বাংলা যতখানি শিখেছি তার পিছনে স্যারের অনেকটাই অবদান আছে। সেসব কথা বেশ কিছুূদিন আগে আমার ফেসবুক দেওয়ালে লিখেছি। স্যারের ছেলেমেয়েরা সবাই আমাদের কলেজের ছাত্র। বড়দা বিবেকানন্দ এখন বাঁকুড়া ন্যায়ালয়ের উকিল। ছোটো অচ্চ্যুতানন্দ, মানে লাল্টুদার সঙ্গে আমার দারুণ ঘনিষ্টতা। অনেক আগে আমাদের চাঁদুরের বাড়িতে এসেছিলো। এখন ডানকুনিতে থাকে। মাসকয়েক আগে আমার তারকেশ্বরের বাড়িতে এসে প্রচুর সাঁটিয়ে গ্যালো। প্রায়ই আমাকে চাঁটি মারার হুমকি দ্যায়। আমি যে একটা মাস্টার, চাঁটানোর অধিকার যে কেবল আমারই আছে তা মোটেই মানতে চায় না।
লাল্টুূদা কলেজেরই একটি মেয়েকে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলো। সেসব গোপনকথা শোনার লোক ছিলাম আমি। মেয়েটির সঙ্গে লাল্টুদার কলেজে পড়ার সময়ই কিসব কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই সকালটার কথা আজও ভুলতে পারিনি। কলেজ থেকে ডেকে নিয়ে কলেজমোড়ে গিয়ে লাল্টুদা আমাকে নিয়ে গ্যালো ফার্মের ভিতরে। বললো সব কথা। চোখে জল নিয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। না টানা বিড়ি জ্বলতে জ্বলতে নিভে গ্যালো কখন। আমি বিড়ি আর সিগারেট টেনেই যাচ্ছি। দুএকটা কথাও বলছি। ঘন্টাখানেক পরে পোড়া বিড়িটাকে সজোরে পা দিয়ে মাড়িয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো লাল্টুদা। বললে, নিকুচি করেছে শালার প্রেমের। অমন কত জুটবে! এই বলে আমাকে টেনে নিয়ে সোজা বাইরে এলো। তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। মোড়ে একটা বাস দাঁড়িয়েছিলো। লাল্টুদা মাইম করতে করতে সেই বাসের হাতল ধরে উঠতে লাগলো। আবার ঠিক ওইভাবেই নেমে এলো। বারতিনেক চললো এই মহড়া। বাসশুদ্ধু লোক হাঁ করে দেখছে দাদার কীর্তি। বন্ধুরা হাসছে। বলছে- এই লালটা, কি হোলো বে তোর। লাল্টুদার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষে বাস ছাড়ার হর্ন দিতে কন্ডাকটরকে গলা জড়িয়ে চুমু খেয়ে নেমে এলো। বললে- অ্যাই রূপকা, একটা বিড়ি দে। বিড়িটা খেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর এগিয়ে গ্যালো একটা রিক্সার দিকে। রিক্সাওলাকে সিটে বসিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো। হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলে- সাইকেলের দুটি চাকা, মধ্যে ফাঁকা, আবার চাপতে হয় ভাই ঠ্যাং তুলেএএএএএএএ। রিক্সাওলাতো জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পরে নেমে এলো রিক্সাওলার গলা জড়িয়ে। এদিকে সবাই তখন আমাকে ব্যাপারটা কি তা জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছে। আমি কি আর বলি। বললাম- লাল্টুদা কোথায় নাটকে অভিনয় করবে। তাই একটু মাইম প্র্যাকটিস করছে। সেদিন অনেকক্ষণ বুঝিয়ে তাকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠাই।
না, লাল্টুদা আর কাউকে প্রেম করতে পারে নি এজীবনে। দেখাশোনার বিয়েতে লাল্টুদা আজ সংসারী। ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে তার। এখনও কিন্তু সে ভুলতে পারেনি তার সেই প্রেমকে। আজও নাইট ডিউটি করতে করতে আমার সঙ্গে ইনবক্সে তার সম্পর্কে নানা কথা বলে। বলে- জানিস ও সংসার করেনি। কোনো মিশনে নান হয়ে গ্যাছে। ও আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো রে। আমি কি আর বলি! চুপ করে শুনি। বলি-ছাড়োতো ওসব কথা।
লাল্টুদার মেজদা কালিকানন্দ খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। হঠাৎ এক দুঃখজনক কারণে প্রাণ বিসর্জন দেয় সেই তরতাজা যুবক। আমরা তখন স্কুলে সাত কি আট ক্লাসের ছাত্র। খবর আসতে স্কুলে হৈ চৈ পড়ে গ্যালো। স্যারকে মনে হয় কোনো স্যার ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। স্কুল ছুটি হয়ে গ্যালো। দলবেঁধে সবাই চললো স্যারের বাড়ির দিকে। দূর থেকেই বিকট আর্তনাদ কানে এলো। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, স্যার মাথায় হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছেন। মাসিমা অজ্ঞান। দিদিরা কাঁদছে। আর হাউহাউ করে বিকট আর্তনাদ করছে পদ্মখেপী- ওরে আমার মানিক রে ---।
স্যারের বাড়ি থেকে পরে কালিকানন্দ স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালু করা হয়। আজও সেই টুর্নামেন্ট চলে বলে জানি।
( আবার আসিবো ফিরে )
স্কুলের নানা দায়িত্ব সামলাতে রাসবিহারীবাবুকে সবসময় যিনি সাহায্য করতেন তিনি হলেন নবগৌরবাবু- নবগৌর সিংহ। খুব ছোটবেলা থেকে ওঁর প্রতাপবাগানের বাড়িতে বাংলা আর ইংরাজি টিউশন পড়েছি। স্কুলেও উনি বাংলা পড়াতেন। ওঁর কাছে আমার আবদারের শেষ ছিলো না। বাঁদরামিও ছিলো চূড়ান্ত পর্যায়ের। তবুও ইংরাজি ও বাংলা যতখানি শিখেছি তার পিছনে স্যারের অনেকটাই অবদান আছে। সেসব কথা বেশ কিছুূদিন আগে আমার ফেসবুক দেওয়ালে লিখেছি। স্যারের ছেলেমেয়েরা সবাই আমাদের কলেজের ছাত্র। বড়দা বিবেকানন্দ এখন বাঁকুড়া ন্যায়ালয়ের উকিল। ছোটো অচ্চ্যুতানন্দ, মানে লাল্টুদার সঙ্গে আমার দারুণ ঘনিষ্টতা। অনেক আগে আমাদের চাঁদুরের বাড়িতে এসেছিলো। এখন ডানকুনিতে থাকে। মাসকয়েক আগে আমার তারকেশ্বরের বাড়িতে এসে প্রচুর সাঁটিয়ে গ্যালো। প্রায়ই আমাকে চাঁটি মারার হুমকি দ্যায়। আমি যে একটা মাস্টার, চাঁটানোর অধিকার যে কেবল আমারই আছে তা মোটেই মানতে চায় না।
লাল্টুূদা কলেজেরই একটি মেয়েকে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলো। সেসব গোপনকথা শোনার লোক ছিলাম আমি। মেয়েটির সঙ্গে লাল্টুদার কলেজে পড়ার সময়ই কিসব কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই সকালটার কথা আজও ভুলতে পারিনি। কলেজ থেকে ডেকে নিয়ে কলেজমোড়ে গিয়ে লাল্টুদা আমাকে নিয়ে গ্যালো ফার্মের ভিতরে। বললো সব কথা। চোখে জল নিয়ে বসে রইলো অনেকক্ষণ। না টানা বিড়ি জ্বলতে জ্বলতে নিভে গ্যালো কখন। আমি বিড়ি আর সিগারেট টেনেই যাচ্ছি। দুএকটা কথাও বলছি। ঘন্টাখানেক পরে পোড়া বিড়িটাকে সজোরে পা দিয়ে মাড়িয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো লাল্টুদা। বললে, নিকুচি করেছে শালার প্রেমের। অমন কত জুটবে! এই বলে আমাকে টেনে নিয়ে সোজা বাইরে এলো। তখন ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে। মোড়ে একটা বাস দাঁড়িয়েছিলো। লাল্টুদা মাইম করতে করতে সেই বাসের হাতল ধরে উঠতে লাগলো। আবার ঠিক ওইভাবেই নেমে এলো। বারতিনেক চললো এই মহড়া। বাসশুদ্ধু লোক হাঁ করে দেখছে দাদার কীর্তি। বন্ধুরা হাসছে। বলছে- এই লালটা, কি হোলো বে তোর। লাল্টুদার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষে বাস ছাড়ার হর্ন দিতে কন্ডাকটরকে গলা জড়িয়ে চুমু খেয়ে নেমে এলো। বললে- অ্যাই রূপকা, একটা বিড়ি দে। বিড়িটা খেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর এগিয়ে গ্যালো একটা রিক্সার দিকে। রিক্সাওলাকে সিটে বসিয়ে গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো। হঠাৎ গলা ছেড়ে গান ধরলে- সাইকেলের দুটি চাকা, মধ্যে ফাঁকা, আবার চাপতে হয় ভাই ঠ্যাং তুলেএএএএএএএ। রিক্সাওলাতো জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পরে নেমে এলো রিক্সাওলার গলা জড়িয়ে। এদিকে সবাই তখন আমাকে ব্যাপারটা কি তা জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছে। আমি কি আর বলি। বললাম- লাল্টুদা কোথায় নাটকে অভিনয় করবে। তাই একটু মাইম প্র্যাকটিস করছে। সেদিন অনেকক্ষণ বুঝিয়ে তাকে বাড়িতে ফেরৎ পাঠাই।
না, লাল্টুদা আর কাউকে প্রেম করতে পারে নি এজীবনে। দেখাশোনার বিয়েতে লাল্টুদা আজ সংসারী। ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে তার। এখনও কিন্তু সে ভুলতে পারেনি তার সেই প্রেমকে। আজও নাইট ডিউটি করতে করতে আমার সঙ্গে ইনবক্সে তার সম্পর্কে নানা কথা বলে। বলে- জানিস ও সংসার করেনি। কোনো মিশনে নান হয়ে গ্যাছে। ও আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসতো রে। আমি কি আর বলি! চুপ করে শুনি। বলি-ছাড়োতো ওসব কথা।
লাল্টুদার মেজদা কালিকানন্দ খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। হঠাৎ এক দুঃখজনক কারণে প্রাণ বিসর্জন দেয় সেই তরতাজা যুবক। আমরা তখন স্কুলে সাত কি আট ক্লাসের ছাত্র। খবর আসতে স্কুলে হৈ চৈ পড়ে গ্যালো। স্যারকে মনে হয় কোনো স্যার ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। স্কুল ছুটি হয়ে গ্যালো। দলবেঁধে সবাই চললো স্যারের বাড়ির দিকে। দূর থেকেই বিকট আর্তনাদ কানে এলো। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, স্যার মাথায় হাত দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছেন। মাসিমা অজ্ঞান। দিদিরা কাঁদছে। আর হাউহাউ করে বিকট আর্তনাদ করছে পদ্মখেপী- ওরে আমার মানিক রে ---।
স্যারের বাড়ি থেকে পরে কালিকানন্দ স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালু করা হয়। আজও সেই টুর্নামেন্ট চলে বলে জানি।
( আবার আসিবো ফিরে )
No comments:
Post a Comment