Tuesday, August 23, 2016

কলেজের রিডিংরুম : রূপক সামন্ত

সেটা ১৯৮৬ সালের কথা। আমি তখন সাম্মানিক পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনা কলেজ ট্যাঙ্কে বিসর্জন দিয়ে মেতে আছি ক্যান্টিনে, গাছতলায়, ছাত্র-সংসদ ঘরে, টিটি খেলার ঘরে, কলেজ মোড়ের আর রাণিগঞ্জের মোড়ের জমাটি আড্ডায়, ব্রাউন ছাত্রাবাসের নানা কুকীর্তিতে আর রাত গভীরের চণ্ডিদাস বীণাপাণি সিনেমায়। সংসদের চিপ স্টোর আর চিপ ক্যান্টিন সামলাই। সংসদের যাবতীয় কলম-চালনা কাজের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ন্যস্ত। এসব নিয়ে আমি সদা ব্যস্ত এবং উদ্ব্যস্ত। ভালোই চলছিলো দিনগুলো। একদিন কি কারণে যেন লাইব্রেরীতে ঢুকেছি পিছনের দরজাটা দিয়ে। আমাদের বিভাগের নিজস্ব লাইব্রেরীতে সাম্মানিকের বই সব পেয়ে যাওয়ার কারণে প্রধান লাইব্রেরীতে কমই যেতাম। যাইহোক ভিতরে ঢুকে নজর পড়লো বেশ কিছু বই এখানে ওখানে ডাঁই করে রাখা আছে। তার উপর কয়েক পরত ধূলো জমেছে। বেশ কিছু বইতে জল লেগে খুব সঙ্গীন দশা। বোঝা গ্যালো যে বইগুলো অনেকদিন ধরে ওইভাবেই পড়ে আছে। বই পড়ি বা না পড়ি বাবার কল্যাণে ছেটোবেলা থেকেই বইএর প্রতি একটা দুর্বলতা ও মমত্ব আমার বরাবরই ছিলো, আজও আছে। বইগুলো দেখে খুব কষ্ট হোলো। নানা বিষয়ের অমূল্য সব বই। পদার্থবিদ্যার বইও আছে দেখলাম। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, কি করবো বলো। রাখার জায়গা নেই। সত্যিকথা। সব আলমারি, তাক বইয়ে ঠাসা। তবু বললাম, এভাবে নষ্ট হবে তাবলে। উনি বললেন, আমার কিছু করার নেই। তোমরা সংসদ থেকে দ্যাখো কিছু করতে পারো কি না। অন্তত একটা রিডিং রুমও যদি করতে পারো তো ভালো হয়। সংসদ ঘরে এসে বললাম কথাটা। তখন পবন সেলামপুরিয়া সভাপতি, জহরদা সাধারণ সম্পাদক আর শান্তিময় চন্দ ( লালুদা ) কোষাধ্যক্ষ। লালুদাও আজ আর নেই। বহুকাল আগেই আত্মহত্যা করে জ্বালা জুড়িয়েছে। যাই হোক সংসদে আলোচনা হতে লাগলো কি করা যেতে পারে। আলোচনায় বেরোলো যে লাইব্রেরীর পিছনে যে একতলা বাড়িটায় তখন অর্থনীতিবিদ্যার পঠনপাঠন হোতো সেই বাড়িতে একটা বড়ো হলঘর অব্যবহৃত পড়ে আছে। ঠিক হোলো ওখানেই হবে রিডিং রুম। ওটাই রিডিং রুমের জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা। তখন ডি বি পাল স্যার আর হরিসাধনবাবু মিলে জোড়াতালি দিয়ে কলেজ চালাচ্ছেন। হরিসাধনবাবু অস্থায়ী অধ্যক্ষ হয়ে আছেন। সংসদ থেকে স্যারেদের বলা হোলো বিষয়টা। বেশ কিছু আলাপ আলোচনার পর স্যারেরা রাজি হলেন। ঘরটা খুলে পরিষ্কার করা হোলো। কিছু হাইবেঞ্চ আর লো বেঞ্চের ব্যবস্থা হোলো। বিদ্যুতের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা হোলো। আমি, চন্দন, বিকাশ, সুমনজিৎ, স্পর্শ, সোমনাথ সুরাল, সঞ্জীব নামহাতা, শক্তিশঙ্কর সিংহমহাপাত্র, সুভাশিষ পাল ও আরও কেউ কেউ মহানন্দে বই বইতে শুরু করলুম। লাইব্রেরী থেকে বইগুলো এনে ঝেড়ে মুছে আলমারীতে সাজানো হোলো। খুব আনন্দ আমাদের। বিরাট যুদ্ধই জয় করেছি যেন একটা। স্যারেরা দেখে খুব প্রশংসা করলেন পিঠ চাপড়ে। বান্ধবীরা বললে, বাব্বা তোরা তো দেশসেবায় নেমেছিস দেখছি। ছিনে বুকটা সাতহাত ফুলে উঠলো যেন। মোট তিনদিন ধরে বেশ কিছুক্ষণ করে খেটে সাজিয়েছিলুম সেই রিডিংরুম। শেষদিনে স্যারেরা কলেজের তরফ থেকে চা বিস্কুট খাইয়েছিলেন মনে আছে। সে কি আনন্দ বলে বোঝাতে পারবো না আজ। মাঝে মাঝে সেই রিডিংরুমে যেতাম। এটা ওটা পড়তাম। গল্প করতাম। আর মনে মনে গর্ব করতাম যে এই রিডিংরুমটা আমরা সাজিয়েছি। আজও আছে কী সেই রিডিংরুমটা??

No comments:

Post a Comment