Thursday, August 11, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা - ১৯ : রূপক সামন্ত

বারো ক্লাসের প্রথম দিক থেকেই চন্দন-ভাইয়া আর বিকাশের টানে টানে কলেজ মোড়ে আড্ডা দিতে শুরু করলাম আমরা। তখন ওখানে অনেক ছেলে আড্ডা দিতো। যাত্রী দাঁড়ানোর শেডে, চায়ের দোকানগুলোতে আর গেট দিয়ে ঢুকে বাঁধানো চৌবাচ্ছাগুলোতে আড্ডা জমতো আমাদের। খুব পুরোনোদের মধ্যে শ্যামদা আর অসীম নন্দীদা। শ্যামদা খুব ভালো ছবি আঁকতো। পরে লালবাজার মোড়ে একটা ছবি তোলার স্টুডিও করে। অসীমদা পরে বাঁকুড়া ন্যায়ালয়ের উকিল হয়েছে। আর ছিলো সুভাষদা। জুনবেদিয়ায় বাড়ি। ওদের বাসটাই মনে হচ্ছে মানকানালি যেতো। এছাড়া জহরদা, পার্থদা, রাজাদা, দেবু সেনদা, অমিত বটব্যালদা, দেবা চক্রবর্তীদা, শৈবালদা, দাদাদা আর ভাইদা, নির্মাল্যদা (নিম), শোভনদা, লাল্টুদা, অমরনাথদা, পল্টনদা এবং আরও অনেকে। প্রায় পঁচাত্তর জনের বিশাল আড্ডা। প্রথম থেকে দেবু সেনদার সঙ্গে খুব ভালো আলাপ হয়ে গিয়েছিলো। জহরদাকে খুব সম্মান করতাম আমরা। ওকে দেখলেই সিগারেট বিড়ি লুকোতাম বা ফেলে দিতাম। এরকমই একদিন সিগারেট ধরিয়েছি। জহরদা বাড়ি থেকে সাইকেলে করে এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনে। আমরা তো সিগারেট লুকিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে। বিকাশের একটা অদ্ভুত গোবেচারামার্কা কান এঁটো করা হাসি ছিলো। ও তো জহরদাকে দেখে সেই হাসিটা দিলো। জহরদাও হেসে বললো- সিগারেট খাচ্ছিস বুঝি! দে, আমাকে একটান দে তো। খুব লজ্জার সঙ্গে বিকাশ সিগারেটটা এগিয়ে দিলো। জহরদা দুটান মেরে বললো- আমাকে দেখে সিগারেট লুকোনোর কোনো দরকার নেই বুঝলি। ব্যস, আর আমাদের পায় কে। পুরোদমে সিগারেট বিড়ি টানা শুরু হয়ে গ্যালো সবাইকার সামনে। এখানেই আলাপ হোলো সুভাশিষ, সুশান্ত আর শক্তির সঙ্গে। ওরা আমাদেরই ব্যাচ। কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তো।
সুভাশিষ আমার মতোই বেঁটেখাটো। চোখে চশমা। ফোলা ফোলা গালদুটো দেখলেই বোঝা যায় মহা বিচ্ছু ছেলে। তখন কলেজেরই এক ললনার সঙ্গে মূহুর্মূহু প্রেম চলছে তার। শক্তি একেবারেই নিরীহ, গ্রামের ছেলে। একটু নাকি গলায় কথা বলতো। প্রতি কথায় আঁই বলে একটা শব্দ করতো। সেই নিয়ে কম রাগিয়েছি আমরা ওকে। সুশান্ত মাথার কোঁকড়ানো চুল সবসময় বেশ পরিপাটি করে আঁচড়াতো। পরে পরে কলেজেরই দেবী, সুদীপ, স্পর্শ, চন্দন চৌধুরী -এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হোলো। সঞ্জীব নামহাতা ছয় ক্লাসে জেলা স্কুলে চলে গিয়েছিলো। ওকেও ফিরে পেলাম এই কলেজ মোড়ের ঠেকে। চন্দন- ভাইয়া, বিকাশ, দেবাশিষ সরকার তো ছিলোই। আরও কতজনের যে নাম ভুলে গেছি তার ইয়ত্তা নেই। রজত সবসময় এই কলেজমোড়ের ঠেকে আসতো না। ও পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলতো। কখনও বা স্কুলের বন্ধু কৌশিকের সঙ্গে আড্ডা দিতো। কৌশিকের কথায় মনটা ভারি হয়ে গ্যালো। কিছুদিন পরেই আমার স্কুলজীবনের একেবারে শুরুর এই বন্ধুটি আত্মহত্যা করে। সে বড় মর্মান্তিক দুঃসংবাদ ছিলো আমাদের কাছে। রজত পুরো তিনদিন ধরে কেঁদেছিলো। ওর কথা অন্য কোনো সময় বলার ইচ্ছা রইলো। আমরা যারা স্কুলে পড়তাম তাদের রাজনীতি সম্পর্কে প্রায় কোনো ধারণাই ছিলো না। বান্ধবী সম্পর্কেও যাকে বলে কিছুই জানি না। আমাদের কলেজের বন্ধুরা এসব ব্যাপারে ততদিনে অনেকটাই পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে। তাদের নানা গল্প শুনতাম আর হা-হুতাশ করতাম মনে মনে। ভাবতাম, আহা ওরা কি সুখেই না আছে! তবে কলেজ মোড়ের ঠেকে তখনও রাজনীতি তার অশুভ ছায়া ফেলে নি। মাঝেমাঝেই জহরদা, দেবুদা, লাল্টুদাদের সঙ্গে শৈবালদা, দেবাদাদের তুমুল তর্ক হোতো। তবে তা ওই অবধিই। চা আর বিড়ির যৌথ টানে সব মিলেমিশে যেতো আবার। দেবু সেনদা তার অসাধারণ রোমান্টিক গলায় কত কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতো। দেবাদা খোলা গলায় গণসঙ্গীত গাইতো- লাল মাটির কলিজা লাল/ তাই ঝাণ্ডা লাল। আরেকটা গানে দেবাদা খুব মজা করতো। বান এসেছে মরা গাঙে/ জুড়তে হবে নাও/ তোমরা এখনো ঘুমাও--- এই গানটা গাইতে গাইতে ওই এখনো ঘুমাও টা গাইবার সময় হাই তোলার ঢঙে গাইতো। সে এক অদ্ভুত শুনতে লাগতো। তবে যে যাই করুক, জহরদা এসে গেলে মুহূর্তে ও ই সবের কেন্দ্রবিন্দু। সবাই জহরদাকে কাছে পেতে চাইতো। আর আমাদের কাছে ও তখন স্বয়ং দেবদূত। (আবার আসিবো ফিরে)

No comments:

Post a Comment