পরের দিন রজতকে ডেকে নিয়ে যথাসময়ে গেলাম। একে একে সবাই এসে জুটলো। বিকাশদের পাঠকপাড়া থেকে, চন্দনদের দোলতলা থেকে অনেক ছেলে এলো। বাজারের বেশ কিছু ছেলে এলো। এছাড়াও নানা জায়গা থেকে ছেলেপিলে জুটলো কম নয়। জনা কুড়ি তো হবেই সব মিলিয়ে। আড্ডা দিয়ে ফেরার সময় দাঁড়ানো হোলো দেবীবাবুর ঘরের কাছে। পাড়ার দাদারা কেউ নেই। না থাকলে হবে কি! শুরু হোলো ওদের নাম ধরে তুমুল চিৎকার। শ-কার, ব-কারও চলতে লাগলো। আশেপাশের বাড়ির সবাই বেরিয়ে এলো। তাদের মধ্যে জনাদুয়েক কিশোরীও ছিলো বৈ কি। আর যায় কোথায়। আমাদের বীরত্ব বেড়ে গ্যালো শতগুণ। সে চিৎকারের চোটে ছেলেগুলো আসতে বাধ্য হোলো। জনা পাঁচেক ছিলো ওরা। আরে বাবা, ভীমের গালাগালির চোটে দ্বৈপায়ন হ্রদে লুকিয়ে থাকা দুর্যোধন পর্যন্ত না এসে পারে নি। আর এরা তো সবে গোঁফ গজানো চ্যাংড়া। এইবার ওদের ঘিরে ধরে শুরু হোলো তুমুল হট্টগোল। ধাক্কাধাক্কি চললো। ওরা তো ভাবতেই পারে নি যে এতো ছেলে আসবে। আর ওদের হাতে সত্যিকারের কোনো প্রমাণও ছিলো না। নিছকই দাদাগিরি দেখাতে গিয়ে এখন লে ঠ্যালা সামলা। হঠাৎ দেখি আমাদেরই একজন সাইকেলের চেনের উপর বারবার লাথি মারছে। কি ব্যাপার! না চেন ছিঁড়ে সেই দিয়ে মারবে। এসব তো চললোই। ওদের দু-একজন চাঁটি থাপ্পড়ও খেলো। আশেপাশের বাড়ির কাকু-কাকীমারা জিজ্ঞেস করতে লাগলো- কি হয়েছে বাবা? আমরা বললাম- আমরা তো রোজ আপনাদের সামনে দিয়েই যাই আড্ডা মারতে। কোনোদিন কিছু খারাপ দেখেছেন আমাদের ব্যবহারে? প্রায় সবাই বললেন - না তো। আমরা তো তেমন কিছু দেখি নি। তাহলে বলুন না মাসিমা, আমাদের নামে এমন অপবাদ দেওয়া হচ্ছে কেন? এক বাড়ির সামনে এক কিশোরী বাবা-মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। কে একজন সটান তার কাছে গিয়ে বললো - একগ্লাস জল খাওয়াবে? তার মা শশব্যস্ত হয়ে বললেন-হ্যাঁ বাবা, এখুনি এনে দিচ্ছি। বলে বাড়ি থেকে এক জগ জল আর গ্লাস নিয়ে এলেন। আমরা খেলাম সেই জল। এদিকে ঝগড়া চলছেই। শেষে পাড়ার বড়রা এসে একটা মিটমাট করে দিলেন। বিনা কারণে এমন দোষারোপ করার জন্য ওদেরকেই বকলেন। ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হোলো।
ওই পাড়ার ছেলেগুলোর মধ্যে একজন রোগা ছেলে ছিলো। তার ডাকনাম ন-ন। আমাদের চেয়ে একবছর সিনিয়র। কলেজে পড়ার সময় সে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে। যদিও সে আমাদের কলেজে পড়তো না। কলেজ মোড়ের আড্ডায় রোজই আসতো। খুব তাড়াতাড়ি মাস্টারি পেয়ে যায় সে। ওকে আমরা মাঝেমাঝেই ওই ঘটনাটা বলে রাগাতাম।
আর একটা ঘটনার কথা বলি। আমরা রাতের বেলা নবগৌরবাবুর কাছে টিউশনি পড়তাম। দশটার পর ছাড়তেন উনি। তারপর প্রতাপবাগানের ঢাল বেয়ে আমি, রজত, ভাস্কর- এমনই কয়েকজন পাড়া কাঁপিয়ে ফিরতাম। জামিল স্যারের বাড়ির সামনেটা ছিলো অনেক ঝোপঝাড়ে অন্ধকার। দু-একটা মোটে বাড়ি ছিলো তখন ওখানে। তারপর ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে মতিবাবুর বাড়ির পাশ দিয়ে উঠে আসতাম আমরা। তো জামিলবাবুর বাড়ির সামনের অন্ধকারটা ছিলো আমাদের সিগারেট টানার জায়গা। কি সব ভয় ছিলো তখন। রজত তারপর মতিবাবুর গাছ থেকে লেবুপাতা ছিঁড়ে চিবোতো। হাতে কচলাতো। তাহলে নাকি কাকীমা আর গন্ধ পাবেন না! যাইহোক, তখন শীতকাল। রাত দশটার পর পুরো প্রতাপবাগান নিস্তব্ধ। আমরা সিগারেট টানছি। হঠাৎ রজত হেঁড়ে গলায় বিকট চিৎকার করে উঠলো- মানসিং টোবাকু লাও। কি হোলো কেসটা তা বোঝার আগেই সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠলাম - মানসিং টোবাকু লাও। সে যে কি বিভৎস আওয়াজ উঠলো তা আর কহতব্য নয়। পাশেই একটা ডোবার ওপারে জাহ্নবীবাবু, বেলাদি, মেরী-দেবাদা, চন্দন চৌধুরীদের বাড়ি। ওখানে কয়েকটা বাড়ির আলো জ্বলে উঠলো। এপাশে একটা বাড়ির জানালা খুলে গ্যালো। আর দাঁড়ায় সেখানে! মার দৌড়। একেবারে মতিবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে তবে দাঁড়াই। রজত বললো-এটা কি জানিস? আগে এটা ছিলো ঠ্যাঙাড়ে-ঠগীদের সঙ্কেত। কোনো পথিককে বাগে পেলে এই বলে চেঁচিয়ে নিজেদের মধ্যে সঙ্কেত পাঠাতো। তারপর পাবড়া ছুঁড়ে মারতো সেই পথিককে। আমরা বললাম-তুই জানলি কি করে? তুই কী ঠগীদের দলে ছিলি নাকি? রজত বললো-আমি পড়েছি। তা ভালো। সপ্তাহে তিনদিন রাতের বেলা ফেরার পথে এই ব্যাপার চলতে লাগলো। পাড়া পুরো কেঁপে উঠতে লাগলো। আর কোনো বাড়ির জানালা খুললেই পগার পার। এরকম চলতে চলতে একদিন ওখানে গিয়ে সিগারেট ধরাতেই এক বাড়ি থেকে এক কাকু বেরিয়ে এসে বললেন- তোমরা এখানে কি করছো? বললাম - এই পড়ে ফিরছি। অ, তা তোমরাই রোজ চিৎকার করো বুঝি? আমরা চুপ। নিপাট ভালোমানুষ। ততক্ষণে আরও দু-একটা বাড়ি থেকে লোক বেরিয়ে এসেছে। ধমকা-ধমকি চললো। আমরা বেশ কিছুক্ষণ পরে বললাম-আমরা মজা করার জন্য এটা করতাম। আর করবো না। একজন বললেন - তোমরা কি যেন বলে চ্যাঁচাও! কি মানে ওর। রজত আবার তাঁকে বলে বোঝালো ঠগী বেত্তান্ত। তিনি তো রজতের এহেন জ্ঞানে হাঁ হয়ে গেলেন। ওঁরা নবগৌরবাবুকে রিপোর্টও করেছিলেন। স্যার বকলেন আমাদের। বোঝালেন। আমরাও আর করিনি ও কাজ। কিন্তু রজতের ওই ঠগী-সঙ্কেত আজও ভুলিনি।
(আবার আসিবো ফিরে)
(আবার আসিবো ফিরে)
No comments:
Post a Comment