Friday, August 19, 2016

১৫ আগষ্ট (প্রথম পর্ব) : রূপক সামন্ত

জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখছি ১৫ আগষ্ট - এই দিনটা এলেই সাজো সাজো রব। ভোর থেকে মাইকে বাজছে বন্দেমাতরম বা সারে জাঁহা সে আচ্ছা। ও হ্যাঁ, কারার ওই লৌহকপাট, ও আমার দেশের মাটি- এসব গানও ওই একদিনই বাজতো বটে। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে জাতীয় পতাকা উড়তো পতপত করে। স্কুলের বাচ্চারা সাদা পোষাক পরে ঘুম ঘুম চোখে সাতসকালেই স্কুলে হাজির। কারো কারো হাতে প্যাকাটিতে লাগানো তিরঙ্গা পতাকা। স্কুলের সামনের মাঠে সরু খুঁটিতে দুটো দড়ি বাঁধা জাতীয় পতাকা নামিয়ে রাখা আছে। তাতে আবার কুচো ফুল বাঁধা। মাষ্টারমশাইরা হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক করছেন। ধমকাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীদের। প্রধানশিক্ষক ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রায়! অবশেষে তিনি এলেন। তিনি মানে কোনো মান্যগণ্য ব্যক্তি। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। আমার পাঠশালা জীবনে গ্রামেরই একজন প্রাচীন স্বাধীনতা সংগ্রামী আসতেন। তাঁর নাতনী আমাদের সঙ্গেই পড়তো। নাহ্ আমার এই আটচল্লিশ বছরের জীবনে কোনো স্বাধীনতা দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবসের উদযাপনে আমি কোনো মহিলাকে প্রধান অতিথি হতে দেখিনি। বোধহয় মহিলাদের সে যোগ্যতা আছে বলে মনে করেন না কর্তৃপক্ষ। যাকগে সেসব কথা। আমি নারীবাদী বা নারীবিদ্বেষী কোনোটাই নই। আমি এক নিতান্তই ছাপোষা স্কুলমাষ্টার। তো সেই মান্যগণ্য মানুষটি এলেই মাষ্টারমশাইরা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যেতেন। তারপর তাঁকে নিয়ে সোজা পতাকাতলায়। তিনি দড়ি ধরে টানতে লাগলেন, ফুলভরা পেটমোটা পতাকা উপরে উঠতে লাগলো। সবাইকার ঘাড় তখন বেঁকে উপরের দিকে চোখ। কি হয় কি হয় উৎকণ্ঠা চেপে বসেছে সবার মনে। পতাকা আটকে গেলেই বা উপরে উঠে ফুল বাঁধার গিঁট না খুললেই কেলেংকারীর একশেষ। স্বাধীনতা ঝুলে থাকবে যে! তা এমন হতে কয়েকবার দেখেছি আমি। তখন স্বাধীনতা ওড়াবার জন্য সে কি কসরৎ। যাই হোক পতাকা তো উড়লো কোনোরকমে। তারপর সমবেতকণ্ঠে জন গণ মন অধিনায়ক। জয় হিন্দ। তারপর হোতো গ্রাম পরিক্রমা। বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ, ভারত মাতা কী জয় বলতে বলতে আধখানা গ্রাম ঘুরে আবার সেই পাঠশালার মাঠে। দুটো চকোলেট আর দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। সে কি আনন্দ। তবে চুপি চুপি বলে রাখি অনেক এঁচোড়ে পাকা ছেলে শিখিয়েছিলো - বন্দে মাতরম / বোঁদে খেয়ে পেট গরম।
আজও প্রায় সেরকমই চলছে। জৌলুস চাকচিক্য বেড়েছে অনেক। ধোপদূরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবি, লালপাড় শাড়ির সে কি চমক। বাড়িতে, পাড়ার মোড়ে, স্কুলে, ক্লাবে স্বাধীনতা পালনের কি হুল্লোড়। পতাকা উড়ে যাবার কিছু পরেই শুরু হয়ে গ্যালো ডিজে। ঝ্যাম্পার ঝ্যাম্পার ঝ্যাম। সারাদিন সারারাত চলবে। দিনের শেষে জাতীয় পতাকা নামিয়ে আনা হবে না। ওটা প্রজাতন্ত্র দিবস অবধি ঝুলতেই থাকবে। সারাদিন মাছ মাংস বিরিয়ানি - পুরো ছুটি ছুটি উৎসব। আর সন্ধ্যে হলেই তরলে গরলে নরক গুলজার। আমি স্কুলে আসি শুনে অনেকেই খুব অবাক হয়ে বলেন - সে কী! আজ ছুটির দিনে আবার স্কুল কী!!!
এখন কেউ কোনো আবেগের বশে কোনো ভালো কাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বলা হয় -ব্যাটা যেমন ক্ষুদিরাম সাজতে গ্যাছে!! মাষ্টারদা তো ছিলো ডাকাত। গান্ধীজীর মতো খারাপ লোক আর দুটো হয় না। জহরলাল তো পুরো ধান্দাবাজ। আর রবিঠাকুর তো ইংরেজদের পায়ে তেল মেরে নাইট উপাধি আর নোবেল প্রাইজটা বাগিয়ে নিলে। কেবল ওই সুভাষচন্দ্রই যা একটু---। তা সেও তো জার্মানিতে গিয়ে বিয়ে করে ফেললে। আর যারা স্বাধীনতায় লড়েছিলো তারা তো সব তাম্রপত্র পেয়েছে, পেনশন পেয়েছে আবার কি চাই!
কিছুদিন আগে এগারোর বিজ্ঞান ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলাম- বল তো রাসবিহারী বসু কে ছিলেন। সবাই চুপ। একজন আমতা আমতা করে বললে - স্যার মনে হয় আমাদের পি.এম. ছিলো। আমি কী বলবো বুঝতে না পেরে হাঁ করে রইলাম। দোষ কারো নয় গো মা! আমিই তো শেখাতে পারি নি এদের।
আজ যখন আমার স্কুলে পতাকা উত্তোলন হচ্ছে আমার বুক মুচড়ে কান্না উঠে এলো। মনে মনে বললাম- মাতঙ্গিনী, কেন তুমি বুলেটে ঝাঁঝরা হয়েও পতাকা ছাড়ো নি হাত থেকে! মাষ্টারদা, কে তোমাকে না খেয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে মাথার দিব্যি দিয়েছিলো। প্রীতিলতা তো পড়াশোনা শেষ করে বেশ বিয়ে থা করে সংসারী হতে পারতো। বাঘা যতীন যে কেন মরতে টেগার্টের গুলি খেতে গ্যালো! আরও কতো যে পাগল ছাগল এই করে মরলো। বোকার হদ্দ সব।
না না। আমি খুব বেশী আবেগী হয়ে পড়ি নি। এই আজ বিকেল থেকেই সব ভুলে যাবো। বনের মোষ তাড়াবো, এন্তার বুলি ঝাড়বো সুযোগ পেলেই। মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কবিতা লিখবো। আর সুযোগ পেলেই ছিনিয়ে নেবো যা পাওয়া যায় লুটের মাল। আর হ্যাঁ কাজ বাগাতে তেল দিতে কোনো দ্বিধা করবো না। আজীবন কর্তাভজা স্বভাব কিনা আমার।।

No comments:

Post a Comment