জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা ১৯৯৪ সালে। সকাল ছটায় পৌছলাম সুইতজারল্যান্ড এর জ্যুরিখ এয়ারপোর্টে। বিরাট এয়রপোর্ট, সেখানে প্রথম দেখলাম একই লেভেলে যাচায়াতের জন্য চলমান কার্পেট। এখন সর্বত্র দেখি। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস এ তখন এখনকার মত কঠিন ঝামেলা ছিল না। বাইরে বেডিয়ে ভাবতে শুরু করলাম কিভাবে যাব উস্টার শহর, যেটা ওখান থেকে ২০ কিলোমিটার দুরে। যাওয়ার আগে ৭২ বছর বয়স্ক দক্ষিন ভারতীয় বস বলেছিলেন ট্যাক্সি নিয়ে যেতে পার, ১৫-২০ মিনিটের মামলা। কিন্তু জীবনে প্রথম যাত্রার মজা যদি নিতে চাও লোককে জিগ্গেস করে ট্রেনে যেও। আমিও সেরকমই ভাবনা চিন্তা করে রেখেছিলাম। তখন ইন্টারনেট ছিল না, ছিল না গুগল জ্ঞান আর ম্যাপে সমৃদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা। টিকেট কাউন্টারে টিকেট কিনে জানলাম যে জুরিখ হপবানহফে (মেইন স্টেশন) ট্রেন পাল্টে যেতে হবে উস্টার। জ্যুরিখ স্টেশনে ট্রেনে ওঠার সময়ে এক রেলকর্মীকে জিগগেস করে নিশ্চিত হলাম সেই ট্রেনই নিয়ে যাবে ১৫ মিনিটের দুরত্ব উস্টার।উস্টার পৌঁছনোর আগে সেই ভদ্রলোক এসে জানালেন নেক্সট স্টোশন ইজ উস্টার। আমি গেটের কাছে। গিয়ে আমার যাত্রার প্রথম সমস্যার মুখোমুখি। দরজাটা খুলবে কি করে। শনি রবিবার সকালে ওসব দেশে আগের রাতের নেশায় ঝিমোনো এক আধজন লোক ছাডা কারোকে পাওয়া যায় না। দুই কোচ বাদে একজনকে পেলাম। উনি সবুজ এক বাটন দেখিয়ে দিলেন।
স্টেশনে নেমে কাঁধে ঢাউস ব্যাগটা তুলে নিলাম, তখনো ট্রলি ব্যাগ ছিলো এলিট কম্যুনিটির অধিকারে। পকেট থেকে হোটেলের ম্যাপ দেখে ২০০ মিটার দুরের হোটেলে পৌছলাম। আটতলা হোটেলের দোতলায় পৌছে পেলাম এক রেস্তরার কাউন্টারে, কিন্তু আমার দরকার রিসেপসন। কাউন্টার এ কেউ নেই, রেস্তরায় দুই শ্বেতাংগের সাথে এক ভারতীয় দর্শনধারী বসেছিলেন। তাঁকে জিগগেস করতে উনি রেস্তরার কাউন্টারটাই দেখালেন। হোটেল সম্বন্ধীত কোন জ্ঞানেই মেলাতে পারছিলাম না। তবু গেলাম, হঠাত এক বালিকা উদয় হলেন, i m Nadia,how can I help you. আমার সমস্যা বলতেই উনি জানালেন যে আমার নামে ঘর রাখা আছে। আমার পাসপোর্ট নিয়ে এক ফর্ম ধরিয়ে দিলেন। চেক ইন পর্ব সমাধা হতে এক চাবি আমার হাতে এলো। রুম নং ৩০৪। তখনো আজকের মত ইলেকট্রনিক কার্ড এসে চাবিকে তাডায় নি।
হঠাত শুনি are you from india? উত্তর দিলাম, ততক্ষনাৎ প্রশ্ন your name. নাম বলে একই প্রশ্ন আমিও করলাম। উত্তর: তিমির ঘোষ। তারপর দুজনেই মাতৃভাষায় বিচরন শুরু করলাম। জানলাম উনি বছর কুডি জার্মানীর স্টুটগার্ট শহরে বাস করেন। উইক এন্ডে কিছু ছাত্রছাত্রী নিয়ে ইউরোপের কোন শহরে গিয় যোগ শিবির করেন। তারপরই নিমন্ত্রন আসুন খানিক পরে, আমার ঘরে, রুম নং ৭০৩। ওনার ঘরে গিয়ে আলাপ হল কিছু আধবুডো আর আধবুডী ইউরোপীয়ানের সাথে। তারপরই নিমন্ত্রন পেলাম সেই সন্ধে ডিনারের।
সন্ধেতে তিমিরদা এক বিরাট গাডীতে বসিয়ে নিয়ে গেলেন এক চীনা রেস্তরায়। জীবনে প্রথম মার্সিডিজে চডা। পরে জেনেছিলাম সুইস দেশে চীনা আর ভারতীয় রেস্তরা হল লাকজারী।
সন্ধেতে তিমিরদা এক বিরাট গাডীতে বসিয়ে নিয়ে গেলেন এক চীনা রেস্তরায়। জীবনে প্রথম মার্সিডিজে চডা। পরে জেনেছিলাম সুইস দেশে চীনা আর ভারতীয় রেস্তরা হল লাকজারী।
রেস্তারায় বসলাম প্রায় ১২/১৪ জন বিরাট টেবলে, যার মধ্যমনি তিমিরদা। তিনি এক ছাত্র ফরাসীভাসী মধ্যবয়স্ক জ্যা পিয়েরেকে জ্যা পিয়েরে বাবা সম্বোধনেই ডাকছিলেন। মেরি অ্যান বললো যে ঘোষবাবুর মায়ের শ্রাদ্ধে সে কলকাতা এসেছিল।এর মধ্যে খাবারের অর্ডার দেওয়া হল। আমার জন্য প্রন ফ্রায়েড রাইস আর রেড ওয়াইন। ঘোষদা যখন শুনলেন যে আমি বি ই কলেজ প্রডাক্ট চরম উত্তেজিত হয়ে গল্প শুরু করলেন। রেড ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে সেই গল্প শোনা।
আরে আমিও ছোটবেলায় শিবপুরে থাকতাম। বি ই কলেজ মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম। অরুন ঘোষ আর গার্ডেন গেটের রবীন কোলে ছিল আমার বন্ধু। অরুন ঘোষের নাম জানেন তো!
সবিনয়ে জানালাম ভারতকাঁপানো ফুটবলার অরুন ঘোষের নাম না জানাটা অপরাধ। কিন্তু আমার মাথায় গেঁথে গেল রবীন কোলে নামটা।
আরে আমিও ছোটবেলায় শিবপুরে থাকতাম। বি ই কলেজ মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম। অরুন ঘোষ আর গার্ডেন গেটের রবীন কোলে ছিল আমার বন্ধু। অরুন ঘোষের নাম জানেন তো!
সবিনয়ে জানালাম ভারতকাঁপানো ফুটবলার অরুন ঘোষের নাম না জানাটা অপরাধ। কিন্তু আমার মাথায় গেঁথে গেল রবীন কোলে নামটা।
-বুঝলেন আমি কলকাতা লীগে খেলতাম। আমি আর অরুন কত নতুন ছেলেকে তুলে এনেছি। কাজল মুখার্জীর নাম জানেন, ইন্ডিয়া টিমের হাফব্যাক ছিল। ওকে তো আমিই এনেছিলাম মাঠে।
-একাবার এক ছোকরাকে দেখে অরুনকে বললাম ছেলেটার হবে। নিয়ে এলাম ক্লাবে, শিখিয়ে তৈরী করলাম তাকে। মোহনবাগানের সবচেয়ে স্টাইলিস্ট প্লেয়ার প্রনব গাংগুলী। কিন্তু জলদি নস্ট হয়ে গেল।
আমার তখন প্রবোধ সান্যালের বনস্পতির বৈঠক মনে পডছিলো, যেখানে উনি পি সি সরকারকে ম্যাজিকে আনা বা শরতবাবুকে চরিত্রহীন লিখতে বলার দাবী করেছিলেন।
সেই মুহুর্তে ওয়েটর বাঁচিয়ে দিল খাবার এনে।
- জ্যাঁ পিয়েরে বাবা, লেটস ডু প্রেয়ার
সবার অনুকরনে আমিও চোখ বুজে বসে থাকলাম খানিকক্ষন। উপায় ও ছিল না। বিল মেটানোর মত ফ্র্যাংক আমার পকেটে ছিল না।
একটা মনে রাখার মত ডিনার করলাম আমার বিদেশের প্রথম সন্ধেতে।
খাওয়ার মধ্যেই ঘোষদা নিমন্ত্রন করলেন স্টুটগার্টে তাঁর বাসস্থানে। প্ল্যান ও হোল কার্লশ্রুহে থেকে উনি নিয়ে যাবেন আমায়, এক ঘন্টারও কম রাস্তা। একমাস পরে দুর্গাপুজোর একটা দিন ওনার ওখানেই কাটাবো।
-একাবার এক ছোকরাকে দেখে অরুনকে বললাম ছেলেটার হবে। নিয়ে এলাম ক্লাবে, শিখিয়ে তৈরী করলাম তাকে। মোহনবাগানের সবচেয়ে স্টাইলিস্ট প্লেয়ার প্রনব গাংগুলী। কিন্তু জলদি নস্ট হয়ে গেল।
আমার তখন প্রবোধ সান্যালের বনস্পতির বৈঠক মনে পডছিলো, যেখানে উনি পি সি সরকারকে ম্যাজিকে আনা বা শরতবাবুকে চরিত্রহীন লিখতে বলার দাবী করেছিলেন।
সেই মুহুর্তে ওয়েটর বাঁচিয়ে দিল খাবার এনে।
- জ্যাঁ পিয়েরে বাবা, লেটস ডু প্রেয়ার
সবার অনুকরনে আমিও চোখ বুজে বসে থাকলাম খানিকক্ষন। উপায় ও ছিল না। বিল মেটানোর মত ফ্র্যাংক আমার পকেটে ছিল না।
একটা মনে রাখার মত ডিনার করলাম আমার বিদেশের প্রথম সন্ধেতে।
খাওয়ার মধ্যেই ঘোষদা নিমন্ত্রন করলেন স্টুটগার্টে তাঁর বাসস্থানে। প্ল্যান ও হোল কার্লশ্রুহে থেকে উনি নিয়ে যাবেন আমায়, এক ঘন্টারও কম রাস্তা। একমাস পরে দুর্গাপুজোর একটা দিন ওনার ওখানেই কাটাবো।
স্টুটগার্ট যাওয়া হয় নি অন্য সব প্রোগ্রামের চাপে, তিমিরদার সাথে আর দেখা হয় নি। কিন্তু ভুলি নি সেই ডিনারের কথা। পরে বিশ বছরে নোবল হাউস নামের সেই রেস্তরাটার সামনে দিয়ে অনেকবার গেছি, কিন্তু নিজের পকেটের ভরসায় ঢোকার সাহস হয় নি। ৮৬ সুইস ফ্র্যাংকের ডিনার ১৯৯৪ সালে..
প্রায় ৬/৭ বছর পর একবার সুযোগ এলো কলকাতা যাওয়ার। আমরা দিল্লীবাসী, বর্ধমান যাই প্রতি বছর, সেখান থেকেই দিল্লী ফিরে আসা, কলকাতা হাওডা হিসেবের বাইরে। একরাত বি ই কলেজ অ্যালুমনি হাউসে কাটাই। হঠাত মনে পডলো গার্ডেন গেট এর রবীন কোলের নাম। গেলাম বটানিক্যাল গার্ডেন গেটে পুরনো আড্ডা গার্ডেন ভিউ রেস্তরায়। মালিক ভম্পুকে জিগগেস করলাম রবীন কোলেকে চেনে কি না।
-আমার বাবা
গেলাম ওনার কাছে। জিগগেস করলাম তিমির ঘোষের কথা।
- ওকে তো পাবেন না, বিদেশে থাকে।
-ওখানেই দেখা হয়েছিল, আপনার কথা বলছিলেন
- হাঁ, আগে এদিকেই থাকত
- বি ই কলেজ মাঠে ফুটবলের গল্প বলছিলেন। ফার্স্ট ডিভিসনে খেলার কথা
- ওহ, হাঁ, ফুটবল খেলতো বটে
- প্রনব গাংগুলি, কাজল মুখার্জীদের কথা বলছিলেন...
- এখনো স্বভাব গেলো না!
প্রায় ৬/৭ বছর পর একবার সুযোগ এলো কলকাতা যাওয়ার। আমরা দিল্লীবাসী, বর্ধমান যাই প্রতি বছর, সেখান থেকেই দিল্লী ফিরে আসা, কলকাতা হাওডা হিসেবের বাইরে। একরাত বি ই কলেজ অ্যালুমনি হাউসে কাটাই। হঠাত মনে পডলো গার্ডেন গেট এর রবীন কোলের নাম। গেলাম বটানিক্যাল গার্ডেন গেটে পুরনো আড্ডা গার্ডেন ভিউ রেস্তরায়। মালিক ভম্পুকে জিগগেস করলাম রবীন কোলেকে চেনে কি না।
-আমার বাবা
গেলাম ওনার কাছে। জিগগেস করলাম তিমির ঘোষের কথা।
- ওকে তো পাবেন না, বিদেশে থাকে।
-ওখানেই দেখা হয়েছিল, আপনার কথা বলছিলেন
- হাঁ, আগে এদিকেই থাকত
- বি ই কলেজ মাঠে ফুটবলের গল্প বলছিলেন। ফার্স্ট ডিভিসনে খেলার কথা
- ওহ, হাঁ, ফুটবল খেলতো বটে
- প্রনব গাংগুলি, কাজল মুখার্জীদের কথা বলছিলেন...
- এখনো স্বভাব গেলো না!
সেবারই ফেরার সময় দমদমে এক বৃদ্ধকে দেখে চিত্রার্পিত হয়েছিলাম। বাংলা খেলার জগতের রাজপুত্র, গ্ল্যামার বয় চুনী গোস্বামী। হা করে দেখছিলাম। ছোটেবলা থেকে পুজো করেছি যাকে, রনজী আর সন্তোষ ট্রফি দুইয়েরই ফাইনালে খেলা একমাত্র খেলোয়ার আমার দশ ফুট দুরে, পাশে এক লম্বামতন লোক। ভালো করে দেখে চমকে উঠলাম; আরে এই তো অরুন ঘোষ।
সাহস করে এগোলাম।
-আপনার এক বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিল আমার, নাম তিমির ঘোষ
- ও তো জার্মানীতে থাকে
-হাঁ, আপনার কথা অনেক বলছিলেন।
- আমি ওর ওখানে তিন বছর আগে থেকে এসেছি।
-আপনার এক বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিল আমার, নাম তিমির ঘোষ
- ও তো জার্মানীতে থাকে
-হাঁ, আপনার কথা অনেক বলছিলেন।
- আমি ওর ওখানে তিন বছর আগে থেকে এসেছি।
তারপর আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে বললেন, সত্যি, ও আমার বন্ধু।
No comments:
Post a Comment