Wednesday, August 3, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-৫ : রূপক সামন্ত

হরিদাসবাবুর বাড়ি ছাড়িয়ে আর একটা বাড়ি পেরোলেই শুভ্রবাবুর দোতলা বাড়ি। খ্রিশ্চান কলেজে আমার দেখা অধ্যাপকদের মধ্যে শুভ্রবাবু উল্লেখযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব। সেই সত্তরের দশকে শুভ্রবাবু ছিলেন পূর্ণ যুবক। অত্যন্ত উজ্জ্বল গায়ের রঙ। চোখে কালো চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। মানানসই প্যাণ্ট- সার্টে স্যারকে খুব সুন্দর দেখতে লাগতো। তবে স্যার বিখ্যাত ছিলেন তাঁর সেই বিচিত্র গলায় বলা নানাধরণের উক্তির জন্য। আমার প্রিয় বন্ধু বিকাশ স্যারের গলা খুব ভালো নকল করতে পারতো। স্যারের একটা উক্তি ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলো। একবার কোনো এক ছাত্র চাঁদমারিডাঙার রাস্তা দিয়ে সিগারেট টানতে টানতে আসছে। হঠাৎ সামনে স্যারকে দেখতে পেয়ে অল্প খাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে মাথা নীচু করে পালাবার রাস্তা ধরেছে। স্যার ডেকে বললেন- ওহে ছোকরা শোনো। এই সিগারেটটার দাম একটাকা। এখনও বারো আনার টান বাকি আছে। আমাকে দেখে সিগারেটটা লুকোলেই চলবে। ফেলার দরকার নেই। বুঝেছ। নাও ওটা কুড়িয়ে নাও। ছেলেটির তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। কোনোরকমে সিগারেট টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে চোঁ চাঁ দৌড়। স্যার আর একটা উক্তি মনে হয় সব ব্যাচেই করতেন। গ্যালারির ক্লাসে প্রথমদিনেই বলতেন- ওহে ছেলেরা আর মেয়েরা শোনো। এটা খ্রিশ্চান কলেজ। এই কলেজের প্রতিটা গ্যালারিরুমের দুটো দরজা - একটা ঢোকার, একটা বেরোনোর। এই কলেজে অনেক গাছ আছে। প্রতিটা গাছের একটা করে গাছতলা আছে। ক্লাসে যদি ভালো না লাগে তবে বেরোনোর দরজা দিয়ে সোজা বেরিয়ে গাছতলায় চলে যাবে। আমি কিছু মনে করবো না। স্যারের এমন অনেক শ্লেষ মাখানো উক্তি ছাত্র-ছাত্রী মহলে খুব প্রচলিত ছিলো। তবে আমার মনে হয় স্যার এগুলো কৌতুক করার জন্যই বলতেন।

আমার কলেজে সাম্মানিক পড়াকালীন (১৯৮৫-৮৮) কাঁঠালের আমসত্ত্ব জাতীয় একটা বিষয় পড়তে হোতো। সেটা হোলো ঐচ্ছিক-আবশ্যিক বাংলা বা ইংরাজি। আমার ছিলো বাংলা। স্যার পড়িয়েছিলেন মোট দুটো ক্লাস এবং দারুণ পড়িয়েছিলেন। সবাই আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। তবে ওইটুকুই। স্যারের কাছে আর কিছু পড়ার আমার সুযোগ হয় নি। সেদিন সঙ্ঘমিত্র বললো স্যার আর নেই। শেষদিকটায় নাকি কথা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কথার জন্য বিখ্যাত মানুষটার এই শেষ পরিণতি খুবই বেদনাদায়ক।

আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে বিখ্যাত রকেট গলি যা আমাদের সময়ে প্রেমগলি নামে বেশি পরিচিত ছিলো। এই গলির রাস্তায় সোজা নেমে গেলে মাঠের ঠিক আগে ডানদিকে ছিলো অধ্যাপক মতিবাবুর বাড়ি। ছোট্টখাট্টো কোঁকড়ানো চুল মানুষটি ছিলেন মৃদুভাষী। ওঁর বাড়ির সামনের ছোট বাগানটায় অনেক গাছ ছিলো। বাবার সঙ্গে মোতিবাবুর খুব হৃদ্যতা ছিলো। কাকীমা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। সবসময় সেজেগুজে থাকতেন। ওঁর বাড়িতে গেলেই অনেককিছু খেতে দিতেন। স্যারের বড়ো মেয়ে মণি আমার চেয়ে ছোটো। ও এখন শিক্ষিকা হয়েছে, যতদূর মনে পড়ছে মিশন গার্লস স্কুলে। আমাদের বাড়ির একটু দূরে রামপুর যাবার গলিতে থাকতেন রমাপ্রসাদ পাত্রকর্মকার। কলেজের রসায়ন বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর। উনিও সাহিত্য জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভালো নাটক করতেন ও নির্দেশনা করতেন। লেখালেখির জগতে বাবার সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা ছিলো অম্লমধুর।

( আবার আসিবো ফিরে )

No comments:

Post a Comment