Wednesday, August 3, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-৪ : রূপক সামন্ত

এবার আমাদের বাড়ির আশেপাশে যে সব অধ্যাপকরা থাকতেন তাঁদের কথা একটু বলি।

রামপুর মনোহরতলার রাস্তায় নেমে গেলে পড়তো সহদেববাবুর বাড়ি। স্যার খুবই সাধাসিধে ভালোমানুষ। খুব কম কথা বলতেন আর ভীষণ আস্তে কথা বলতেন। পাশকোর্সের অঙ্ক ক্লাস নিতেন সায়েন্সের দিকের গ্যালারিতে। এতো আস্তে বলতেন যে কিছুই প্রায় শোনা যেতো না। ফলে ওঁর ক্লাসে খুব গল্পগুজব হোতো। অঙ্ক কেউ করতো না। স্যারের মেয়ে, নামটা এখন মনে আসছে না, বারো ক্লাসের পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করে যাদবপুরে ইণ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলো। সেও ছিলো কলেজের ছাত্রী।

আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিলো ব্যানার্জীদের বিরাট বাড়ি। তারপাশেই রসায়নের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক প্রফুল্লবাবুর বাড়ি। আমি যখন পাকাপাকিভাবে বাঁকুড়ায় যাই, ১৯৭৬ সালে, তখন মনে হয় উনি অবসর নিয়েছেন। তবে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ওঁর কাছে পড়তো। এমনকি আমরা যখন ১৯৮৩-১৯৮৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পড়ছি তখনও আমার অনেক বন্ধু ওঁর কাছে পড়তো। জৈব রসায়ন নাকি ওঁর মতো কেউ পড়াতে পারতেন না। জৈব রসায়নের ভজকট রূপান্তরগুলোর (ট্রান্সফরমেশন) জন্য ওঁর এক আর্টপেপার জোড়া সব ছক ছিলো। ছাত্র-ছাত্রীরা সেই ছকগুলো পাওয়ার জন্য হা-পিত্যেশ করতো। পেলে গাঁতিয়ে মুখস্থ করতো। তাতে কি ফল হোতো তারাই বলতে পারবে। আমি কখনও ওঁর কাছে পড়িনি।

প্রফুল্লবাবুর বাড়ি ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে মাঠের শেষে ছিলো তারাপদ ধর বাবুর বাড়ি। বাবার সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই আলাপ ছিলো বলে শুনেছি। তারাপদবাবু অর্থনীতি কেমন পড়াতেন জানি না, তবে কবিতা লিখতেন দারুণ। ওঁর মেয়ে মিতু আমার বড় বোনের এবং আমারও ছেলেবেলার খেলার সাথী ছিলো। মিতুর সাথে আবার আমার সহপাঠী বন্ধু সাম্মানিক বাংলার প্রভাতকুসুম রায়ের বিয়ে হয়েছে। তারাপদবাবুর ভাই নয়ন ধরের নালন্দা প্রেস ও বিখ্যাত ছিলো।

তারাপদবাবুর বাড়ির একটু আগে একটা সুন্দর জায়গা কিনেছিলেন বাবা। বর্তমানের বিখ্যাত সন্তুরবাদক শুদ্ধশীল চট্টোপাধ্যায়ের বাবা রামানন্দকাকু এই জায়গা কিনিয়ে দিয়েছিলেন। শুদ্ধশীলও কিছুদিন খ্রিশ্চান কলেজে সাম্মানিক রসায়নেরর ছাত্র ছিলো। নীচু পাঁচিল দিয়ে জায়গাটাকে ঘিরে ছিলেন বাবা। কুয়োও কাটা হয়েছিলো। তারপর হঠাৎ আমাদের না জানিয়েই বাবা জায়গাটা বিক্রি করে দিলেন। বাঁকুড়ায় নিজেদের পা রাখার জায়গাটা চলে গ্যালো চিরতরে।

আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে বাঁপাশে ছিলো অধ্যাপক হরিদাস আচার্য্যের বাড়ি। ওঁর মেয়ে কাকলী আমার বোনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কাকলীও কলেজের ছাত্রী। এই বাড়িটা এক ঐতিহাসিক বাড়ি। এ বাড়ি ছিলো বাঁকুড়ার এক কিংবদন্তী রত্ন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সোনার মোহর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। হরিদাসবাবু আর একজনের সঙ্গে এই বিরাট লম্বাটে বাড়িটা ওঁর কাছ থেকে কিনে নেন। সামনের অংশটা হরিদাসবাবুর আর পিছনের অংশটা সহদেবকাকুর, মানে সেই ভদ্রলোকের। হরিদাসবাবু নিজেও এক রত্ন বিশেষ। অর্থনীতির মতো জটিল বিষয়ে সোনার মেডেল ছিলো তাঁর গলায়। অর্থনীতির বইও লিখেছিলেন। এছাড়াও একসময়ে তিনি সাহিত্যচর্চাও করতেন। বাবার সম্পাদনায় প্রকাশিত বিখ্যাত অবান্তর পত্রিকা গেষ্ঠীর মধ্যে প্রথমদিকে তারাপদবাবু, বিবেকবাবু, তপনবাবুর সঙ্গে হরিদাসবাবুও ছিলেন। পরে তারাপদবাবু, বিবেকবাবু, হরিদাসবাবু এঁরা আলাদা পত্রিকাগোষ্ঠী তৈরী করেন। আমার মনে হয় হরিদাসবাবুর এই বাড়িটা হেরিটেজ বাড়ির মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য।

No comments:

Post a Comment