Thursday, August 4, 2016

কলেজ স্মৃতিকথা-১৪ : রূপক সামন্ত

১৯৮৩ সালে স্কুলে এগারো ক্লাসে পড়ার সময় দেওয়াল পত্রিকা করার ইচ্ছা হোলো আমাদের। বেশ কদিন জোরদার আলোচনা চললো আমাদের মধ্যে। নবগৌরবাবুকে বলতে উনি খুব উৎসাহ দিলেন। স্কুলের প্রার্থনাঘরের নীচের তলার দেওয়ালে নোটিস লাগানোর একটা বোর্ডও ব্যবস্থা করে দেবেন বললেন। আর পায় কে! পুরোদমে তোড়জোড় শুরু হয়ে গ্যালো। শুধু এগারো ক্লাসের ছাত্রদের লেখা নিয়ে হবে পত্রিকাটা। বাবার সঙ্গে আলোচনা করা হোলো। কিভাবে পত্রিকা করতে হয় সে নিয়ে অনেক পরামর্শ দিলেন তিনি। সম্পাদক আমি আর নিউটন। না না ঘাবড়াবার কিছু নেই। নিউটন আমাদের এক বন্ধু। এগারো ক্লাসে এসে ভর্তি হয়েছিলো সুব্রত। ধবধবে ফর্সা আর একমুখ দাড়িগোঁফ। অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে কথা বলতো। আর অদ্ভুত সব ব্যাপার নিয়ে বিচিত্র সব কথা বলতো। সেজন্য খুব রাগানো হোতো ওকে। যাইহোক সেই নিউটন তো অদম্য উৎসাহে লেগে পড়লো। লেখা জোগাড় করা হোলো। একজনের হাতের লেখা খুব সুন্দর। সে বললো- আর্টপেপারে আমি লিখবো। ছবি আঁকার দায়িত্ব শিল্পী রজতের। অনেকগুলো লেখা জমা পড়লো।

আমি একটা ভ্রমণকাহিনী লিখলাম। কিছুদিন আগেই পূজোর সময় বাবা আমাকে দিল্লি, আগ্রা, রাজস্থান ঘুরিয়ে এনেছেন। কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধ্যের অনেকক্ষণ বসেছিলাম তাজমহলের সামনে। সে দৃশ্যমান কল্পময়তা যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন। সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পরেরদিন সকালে তাজমহলের একেবারে ভিতরে মূল সমাধিকক্ষে ঢুকেছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম তাজমহলের গঠন সৌকর্য। আমার লেখাটা ছিলো সেই চাঁদনী আলোর তাজকে নিয়ে। তাজমহলের রূপময়তাকে আমার কেমন যেন বিদেশিনী মেমসাহেবের খোলা হাতের মতো সুন্দর মনে হয়েছিলো। তা আমি বেশ রসিয়ে লিখে ফেললাম সে কথা। বন্ধুরা পড়ে তো একেবারে মোহিত হয়ে গ্যালো। সবাইকার তরুণ মনেই তখন রঙের ছটা। বললে-জ্যেঠুকে, মানে আমার বাবাকে, এটা দেখাতেই হবে। খুব উৎসাহ নিয়ে সে লেখা বাবার হাতে দিলো শুদ্ধশীল। বাবা পড়ছেন। আমি ঢিপঢিপ বুকে বসে আছি। পড়ে বাবা বললেন- কিসসু হয় নি। এটা কোনো লেখাই নয়। বাবুল যে তাজমহল দেখেছে, নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখেছে তার কোনো ছাপই নেই এর মধ্যে। এ লেখা যে কেউ ঘরে বসেই লিখতে পারে। এরজন্য তাজমহল দেখার প্রয়োজন হয় না। তাজমহলের কাছে ছুটে যাবারও দরকার নেই। ব্যস হয়ে গ্যালো! খুশির ফানুস ফুটো হয়ে ধুক করে নিভে গ্যালো বুক ভরা আশা। যাইহোক মনকে সামাল দিয়ে আবার বেশ রসকষহীন ভাবে লিখলাম। বাবা এবারে বললেন- হ্যাঁ, এইতো ঠিক হয়েছে। এ লেখার মধ্যে তোর নিজের হাতে তাজমহল ছোঁয়ার অনুভুতি ফুটে উঠেছে। আমিও বুঝলাম যে আবেগ রোমান্টিকতা এসব বিষবৎ পরিত্যাজ্য এ জীবনে।

যাইহোক সিদ্ধান্ত হোলো যে প্রজাতন্ত্র দিবসে এই পত্রিকা প্রকাশ করা হবে। সব কেনাকাটা হোলো। দুটো আর্টপেপার জুড়ে লেখা হবে। আমাদের বাড়িতে বসেই লেখার কথা। রঙ তুলি স্কেচপেন বোর্ডপিন আঠা সব কেনা শেষ। যার লেখার কথা সে সকাল অবধি ভরসা দিয়ে সন্ধ্যের ঠিক মুখে মুখে বললে আমি লিখবো না। একেই বলে পিছন থেকে ছুরি মারা। এখন কি হবে। রাত পোহালেই প্রজাতন্ত্র দিবস। কেউ লিখতে সাহস করছে না। ভাস্কর, রজত, শুদ্ধশীল -- না, কেউ লিখে মুখ পোড়াতে রাজি নয়। শেষমেষ সিদ্ধান্তই হয়ে গ্যালো যে পত্রিকা হবে না। তখন আমার মনে জেদ চাপলো একটা। বললাম - কাউকে লিখতে হবে না। আমিই লিখবো। আশাকরি লোকে পড়তে পারবে। রজত, তুই ছবিটা আঁক আর নামটা সুন্দর করে লিখে দে। পত্রিকাটার নামটা ছিলো উন্মেষ। তো রজত আঁকলো, যতদূর মনে পড়ে, দুই পাহাড়ের ভাঁজে টকটকে লাল সূর্য। এবার আমার লেখার পালা। কোনটা আগে লিখবো, কারটা কোথায় সাজাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আবার বাবার শরণাগত আমরা। উনি সাজানোর একটা আইডিয়া দিলেন। এবার লেখা শুরু। প্রথম লেখাটায় হাত কাঁপলেও আস্তে আস্তে সড়গড় হয়ে গ্যালো। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ লেখা শেষ হোলো। বেশ রঙচঙে খোলতাই হয়েছে পত্রিকাটা। হলে কি হবে, একটা অসমাধানযোগ্য সমস্যা দাঁড়িয়ে গ্যালো। একেবারে ডানদিকের নীচে একফালি জায়গা খালি রয়ে গ্যালো যে। কি হবে! আর তো লেখা নেই। ওখানে কি একটা ছবি আঁকা হবে! রজত বললে - আমি এঁকে দিতেই পারি। দেখতে কিন্তু মোটেই ভালো লাগবে না। তাহলে উপায়। আবার বাবা। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন - ওখানে কিছু খবর দিতে পারিস। তোদের স্কুল এখন কেমন চলছে তা নিয়েই লিখতে পারিস। বিশপ তো তোদের অনুষ্ঠানে আসবেন। তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করাবি। মাথায় হাজার ভোল্টের বিজলি খেলে গ্যালো। দাঁড়ান না স্যারেরা, যখনতখন মাথায় গাঁট্টা মারা আর কান টেনে লম্বা করার শোধ কেমন করে তুলতে হয় দেখাচ্ছি (অবশ্যই সেইসব মারকুটে মারহাতা স্যারেদের নিপাত করার জন্য কেবল)। সবাইকে বললাম- বাড়ি চলে যা। এটুকু আমি রাতেই করে ফেলবো। খেতে খেতে চিন্তা করে নিলাম যে কি লিখবো। তারপর রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে লিখে ফেললাম যা লেখার। উত্তেজনায় সে রাতে ভালো ঘুম হয়েছিলো কি না তা আর মনে নেই।

পরেরদিন ভোর ভোর স্কুলে গিয়ে নোটিশবোর্ডটা ঝাঁড়পোঁছ করে বোর্ডপিন দিয়ে এঁটে দেওয়া হোলো আমাদের প্রথম পত্রিকা। সামনে একটা পর্দা মতো ঝুলিয়ে আড়াল করে দেওয়া হোলো। ওটা সরিয়েই তো বিশপসাহেব উদ্বোধন করবেন। স্যারেরা কেউ কেউ আমাদের উদ্যোগে কৌতুহলী হয়ে বললেন -কেমন পত্রিকা করলি দেখি। আমাদের বিনীত উত্তর - একটু পরে স্যার। আগে বিশপ উদ্বোধন করুন।

বিশপ তো উদ্বোধন করলেন। তাঁর সঙ্গে অন্যান্য অতিথিবৃন্দ ও স্যারেরা। বিশপ খুব প্রশংসা করলেন। তখন আমাদেরই কেউ একজন সাহস করে সেই সংবাদগুলো পড়ার জন্য অনুরোধ করলো। বিশপ খুব মন দিয়ে পড়ে মুচকি হাসলেন। বললেন- বাহ্, বেশ হয়েছে। খুব খাঁটি কথা লিখেছো তোমরা। ও হেডস্যার, দেখুন কি লিখেছে আপনার ছাত্ররা। এদিকে হেডস্যারের তো চক্ষু চড়কগাছ। স্যারেদের মুখে কালো মেঘের ঘনঘটা। পারলে আমাদের ছিঁড়ে খান। পিঠে ছড়ি ভাঙবার জন্য হাত যে নিশপিশ করছে তা বেশ বুঝতে পারছি। নেহাতই বিশপ রয়েছেন তাই---

সেদিনটা প্রজাতন্ত্র দিবস বলে পার পেয়ে গেলাম। শুধু নবগৌরবাবু খুব ধমক দিয়ে বললেন - এভাবে বাইরের লোকেদের সামনে কেউ স্কুলের মাথা হেঁট করে। তোরা আমাদের বলতে পারতিস। বললাম- আপনারা তো জানেনই। বলাও তো হয়েছে। সুরাহা কিছু হয় নি।

তার পরের দিন স্কুল তোলপাড়। সবাই সেই সংবাদ নিয়ে আলোচনা করছে। স্যারেরা আমাদের দিকে এমনভাবে দেখছেন যেন সদ্য জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছি। ভয়ও লাগছে একটু। এই ছড়ি পড়লো বলে। দ্বিতীয় পিরিয়ডে হেডস্যারের ঘরে আমার আর নিউটনের ডাক পড়লো। তখন রমেনবাবু প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ঘরে অন্যান্য স্যারেরাও কেউ কেউ আছেন। রমেনবাবু তো এই মারেন, সেই মারেন। আর বাঁদর থেকে শুরু করে গাধা পর্যন্ত কোনো বিশেষণই বাদ গ্যালো না। হয়েছিলো কি, তখন বেশ কয়েকজন স্যার একসঙ্গে বি. এড. পড়তে যাওয়ায় আমাদের সেইসব ক্লাসগুলো অফ যেতো। হৈ-হল্লা হোতো। সিলেবাস প্রচুর বাকি। সেই বিষয়টা নিয়েই একটু ব্যঙ্গাত্মকভাবে সংবাদটা লেখা হয়েছিলো। যাইহোক প্রচুর ধমক দিয়ে স্যারেরা ওর উপর কালকের মধ্যেই সাদা কাগজ সাঁটার ফরমান জারি করলেন। মনে চাপা রাগ নিয়ে ফিরে একাম ক্লাসে।

ক্লাসের ছেলেরা সব শুনে গর্জে উঠলো- কখনোই না। আমাদের কি অপরাধ! কি করে দেখা যাবে। ঠ্যাং ভেঙে দেবো। আমাদের ভালোবাসতেন যেসব স্যারেরা তাঁরা আমাদের বোঝালেন। আমরা কিন্তু মরিয়া- যা হবে তা দেখা যাবে কাল সকালে।

বাবার কাছে সন্ধ্যেয় সব জানানো হোলো। তিনি শুনে বললেন - হ্যাঁ তো কি হয়েছে, কাগজ চিটিয়ে দে। শুনে আমরা খুব হতাশ হলাম। বাবা বললেন - তোদের উদ্দেশ্য তো সফল হয়েছে। বিশপ জেনেছেন। সারা বাঁকুড়া জেনেছে। হৈ চৈ চলছে। যা হবার ওতেই হবে। আর স্যারেদের সঙ্গে কোনো বিবাদ করার দরকার নেই। আমরা কিন্তু কিন্তু করে মেনে নিলাম যুক্তিটা।

পরদিন সকালে গিয়ে মহা উৎসাহের সঙ্গে সবাইকার সামনে কাগজ সাঁটিয়ে রমেনবাবুকে ডেকে দ্যাখানো হোলো। কোনো কোনো স্যার মুচকে মুচকে হাসলেন। কারণ ফিনফিনে কাগজটার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার পড়া যাচ্ছিলো আমার হাতের লেখা- সারা বাঁকুড়া ক্লাস অফ ও স্কুল ছুটি প্রতিযোগিতায় বাঁকুড়া খ্রিষ্টান কলেজিয়েট স্কুল প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক লাভ করেছে।।

( আবার আসিবো ফিরে )

No comments:

Post a Comment