এবার আমাদের পাড়ায় আশেপাশের আর কয়েকজনের কথা বলি।
আমাদের বাড়িতেই দেবদাস চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার ভাড়া থাকতেন। উনি ছিলেন বাঁকুড়া ন্যায়ালয়ের করণিক। ওঁর বড়ছেলে তাপসদা কলেজের সাম্মানিক গণিতের ছাত্র ছিলো। আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। তাপসদা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি করার পর আই আই টি খড়্গপুর থেকে পি এইচ ডি করে। আমি ওঁর কাছে অঙ্ক পড়েছি। খুব ভালো পড়াতো। তাপসদা এখন সম্মিলনী কলেজের অধ্যাপক।
ডাঃ লালমোহন গাঙ্গুলীর পরিবারের কথা না বললে আমার কলেজ স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের সঙ্গে ওই পরিবারের প্রায় নিজের ঘরের মতো সম্পর্ক। বাবা ওঁর স্ত্রীকে মা বলেই ডাকতেন। ওঁর চার ছেলেমেয়েই কলেজের পড়ুয়া। বড়ছেলে উজ্জ্বলকাকু বাঁকুড়ার উজ্জ্বল নাট্যব্যক্তিত্ব। বড়মেয়ে কাজল পিসিমণি সাম্মানিক বাংলায় বাবার একেবারে প্রথম দিকের ছাত্রী। ছেটোমেয়ে কুমু পিসিমণি নৃত্যপটীয়সী। নাটকও করতো। ছোটোছেলে সজলকাকুও অভিনয় করতো। কলেজে আমাদের এক বছর জুনিয়র অনুরূপার সঙ্গে সজলকাকুর বিয়ে হয়েছে। এই পরিবারটি বরাবরই অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক। ওঁর বাড়ির আড্ডায় বাবা, লীলাময়বাবু, রমাপ্রসাদবাবু, ঈশ্বর ত্রিপাঠী ও আরও অনেক অধ্যাপক যোগদান করতেন। প্রায়ই নাটকের রিহার্সাল হোতো ওই বাড়ির দোতলায়। প্রাণখোলা ছাতফাটানো হাসিতে সারা পাড়া গমগম করতো।
২০০২ সালে বাবা মারা যাবার পর মধুসূদন দরিপার আর্ষ পত্রিকাগোষ্ঠী গান্ধীবিচার পরিষদের হলঘরে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। লালমোহনদাদু সভাপতি। লীলাময়বাবু, তপনবাবু, ঈশ্বর ত্রিপাঠী, বাবার অনেক ছাত্রছাত্রী ও বাঁকুড়ার অনেক গুণীমানুষ সেই স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রায় শেষে আমাকে কিছু কথা বলতে হয়েছিলো। তারপর সভাপতির বক্তব্য বলতে উঠে ডাক্তারদাদু হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রায় আশি বছর বয়সের অত্যন্ত সফল এক মানুষ কতখানি ভালোবাসলে সবাইকার সামনে ওইভাবে কেঁদে উঠতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। সবাইকার চোখে তখন জল। অন্তরের ভালেবাসায়, চোখের জলে সত্যিই স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন কবি রূপাই সামন্ত।
কাজল পিসিমণির সহপাঠী বন্ধু ছিলো ডঃ হেমাদিত্য রায়চৌধুরী। সাম্মানিক বাংলার উজ্জ্বল ছাত্র। কবিতা, প্রবন্ধ লিখতো। খুব ভালো আবৃত্তিও করতো। আমার সঙ্গে ২০১০ এর শেষে বা ২০১১ র একেবারে প্রথমে দূরভাষে যোগাযোগ হোলো ডাক্তারদাদুর সৌজন্যে। তখন আমার আর বন্ধু ডঃ সুশান্ত কবিরাজের সম্পাদনায় বাবাকে নিয়ে ' স্মরণে ও মননে রবীন্দ্রনাথ ( রূপাই ) সামন্ত ' বইটির কাজ প্রায় শেষের মুখে। বারুইপুরে বাবার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বন্ধু কবি অধ্যাপক উত্তম দাশ এর মহাদিগন্ত প্রেসে প্রায় সব লেখা জমা পড়ে গ্যাছে। হঠাৎ একদিন ডাক্তারদাদু দূরভাষে আমাকে বললেন - রবিবাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্র হেমাদিত্য এসেছে। তোদের উদ্যোগের কথা শুনে লেখা দিতে চাইছে। তুই কী আর লেখা নিতে পারবি? এই বলে হেমাদিত্যকাকুকে ধরিয়ে দিলেন। আলাপ হোলো। খুব দ্রুত লেখা পাঠালেন। আমার সঙ্গে দূরভাষে প্রায়ই কথা হতে লাগলো। জানলাম ওঁর বাড়ি বাঁকুড়ার লালবাজার অঞ্চলে ছিলো। এখন উনি ঝাড়খণ্ডের বীরসা-মুন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান। তারকেশ্বরে গ্রন্থটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে উনি এসেছিলেন। বাবার লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ও বক্তব্য রেখেছিলেন। আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত রূপশালি পত্রিকাতেও ওঁর কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। বাবার স্মৃতিগ্রন্থে ওঁর লেখার শুরুতে একটি কবিতা আছে। সেটি তুলে দিচ্ছি।
আজও তুমি আছ তেমনই উজ্জ্বল;
যদিও কিছু ধুলো পড়েছিল স্মৃতির বাক্সে,
সযত্নে সরিয়ে দিয়েছে তা তোমার আত্মজ।
কত ছন্দে কত ভাবে গড়ে ছিলে যে জীবন
ফুটিয়েছিলে কত ফুল তোমার কবিতায়
সে সবের গন্ধ ঢাকা ছিল রূপকের মোড়কে
সেই মোড়ক খুলে আজ তোমারই দেখা পাই।
এ যেন অচেনাকে পাওয়া চেনার আলোকে
কত স্মৃতি, কত কথা- কে বলে তুমি নাই?
( আবার আসিবো ফিরে )
আমাদের বাড়িতেই দেবদাস চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার ভাড়া থাকতেন। উনি ছিলেন বাঁকুড়া ন্যায়ালয়ের করণিক। ওঁর বড়ছেলে তাপসদা কলেজের সাম্মানিক গণিতের ছাত্র ছিলো। আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। তাপসদা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এস সি করার পর আই আই টি খড়্গপুর থেকে পি এইচ ডি করে। আমি ওঁর কাছে অঙ্ক পড়েছি। খুব ভালো পড়াতো। তাপসদা এখন সম্মিলনী কলেজের অধ্যাপক।
ডাঃ লালমোহন গাঙ্গুলীর পরিবারের কথা না বললে আমার কলেজ স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের সঙ্গে ওই পরিবারের প্রায় নিজের ঘরের মতো সম্পর্ক। বাবা ওঁর স্ত্রীকে মা বলেই ডাকতেন। ওঁর চার ছেলেমেয়েই কলেজের পড়ুয়া। বড়ছেলে উজ্জ্বলকাকু বাঁকুড়ার উজ্জ্বল নাট্যব্যক্তিত্ব। বড়মেয়ে কাজল পিসিমণি সাম্মানিক বাংলায় বাবার একেবারে প্রথম দিকের ছাত্রী। ছেটোমেয়ে কুমু পিসিমণি নৃত্যপটীয়সী। নাটকও করতো। ছোটোছেলে সজলকাকুও অভিনয় করতো। কলেজে আমাদের এক বছর জুনিয়র অনুরূপার সঙ্গে সজলকাকুর বিয়ে হয়েছে। এই পরিবারটি বরাবরই অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক। ওঁর বাড়ির আড্ডায় বাবা, লীলাময়বাবু, রমাপ্রসাদবাবু, ঈশ্বর ত্রিপাঠী ও আরও অনেক অধ্যাপক যোগদান করতেন। প্রায়ই নাটকের রিহার্সাল হোতো ওই বাড়ির দোতলায়। প্রাণখোলা ছাতফাটানো হাসিতে সারা পাড়া গমগম করতো।
২০০২ সালে বাবা মারা যাবার পর মধুসূদন দরিপার আর্ষ পত্রিকাগোষ্ঠী গান্ধীবিচার পরিষদের হলঘরে শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। লালমোহনদাদু সভাপতি। লীলাময়বাবু, তপনবাবু, ঈশ্বর ত্রিপাঠী, বাবার অনেক ছাত্রছাত্রী ও বাঁকুড়ার অনেক গুণীমানুষ সেই স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রায় শেষে আমাকে কিছু কথা বলতে হয়েছিলো। তারপর সভাপতির বক্তব্য বলতে উঠে ডাক্তারদাদু হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রায় আশি বছর বয়সের অত্যন্ত সফল এক মানুষ কতখানি ভালোবাসলে সবাইকার সামনে ওইভাবে কেঁদে উঠতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। সবাইকার চোখে তখন জল। অন্তরের ভালেবাসায়, চোখের জলে সত্যিই স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন কবি রূপাই সামন্ত।
কাজল পিসিমণির সহপাঠী বন্ধু ছিলো ডঃ হেমাদিত্য রায়চৌধুরী। সাম্মানিক বাংলার উজ্জ্বল ছাত্র। কবিতা, প্রবন্ধ লিখতো। খুব ভালো আবৃত্তিও করতো। আমার সঙ্গে ২০১০ এর শেষে বা ২০১১ র একেবারে প্রথমে দূরভাষে যোগাযোগ হোলো ডাক্তারদাদুর সৌজন্যে। তখন আমার আর বন্ধু ডঃ সুশান্ত কবিরাজের সম্পাদনায় বাবাকে নিয়ে ' স্মরণে ও মননে রবীন্দ্রনাথ ( রূপাই ) সামন্ত ' বইটির কাজ প্রায় শেষের মুখে। বারুইপুরে বাবার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বন্ধু কবি অধ্যাপক উত্তম দাশ এর মহাদিগন্ত প্রেসে প্রায় সব লেখা জমা পড়ে গ্যাছে। হঠাৎ একদিন ডাক্তারদাদু দূরভাষে আমাকে বললেন - রবিবাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্র হেমাদিত্য এসেছে। তোদের উদ্যোগের কথা শুনে লেখা দিতে চাইছে। তুই কী আর লেখা নিতে পারবি? এই বলে হেমাদিত্যকাকুকে ধরিয়ে দিলেন। আলাপ হোলো। খুব দ্রুত লেখা পাঠালেন। আমার সঙ্গে দূরভাষে প্রায়ই কথা হতে লাগলো। জানলাম ওঁর বাড়ি বাঁকুড়ার লালবাজার অঞ্চলে ছিলো। এখন উনি ঝাড়খণ্ডের বীরসা-মুন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান। তারকেশ্বরে গ্রন্থটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে উনি এসেছিলেন। বাবার লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন ও বক্তব্য রেখেছিলেন। আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত রূপশালি পত্রিকাতেও ওঁর কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। বাবার স্মৃতিগ্রন্থে ওঁর লেখার শুরুতে একটি কবিতা আছে। সেটি তুলে দিচ্ছি।
আজও তুমি আছ তেমনই উজ্জ্বল;
যদিও কিছু ধুলো পড়েছিল স্মৃতির বাক্সে,
সযত্নে সরিয়ে দিয়েছে তা তোমার আত্মজ।
কত ছন্দে কত ভাবে গড়ে ছিলে যে জীবন
ফুটিয়েছিলে কত ফুল তোমার কবিতায়
সে সবের গন্ধ ঢাকা ছিল রূপকের মোড়কে
সেই মোড়ক খুলে আজ তোমারই দেখা পাই।
এ যেন অচেনাকে পাওয়া চেনার আলোকে
কত স্মৃতি, কত কথা- কে বলে তুমি নাই?
( আবার আসিবো ফিরে )
No comments:
Post a Comment